॥ আনোয়ার আল হক ॥
জ্ঞানের চূড়ান্ত ও মৌলিক প্রকাশ ঘটে ভাষায়। যে কোনো ক্ষেত্রেই হোক জ্ঞান অর্জনের তাৎপর্যপূর্ণ বহিঃপ্রকাশ ভাষার মধ্যেই প্রতিফলিত হয়। সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে মানুষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ যোগ্যতা তার ভাষা। অন্যান্য জীবেরও ভাষা আছে, কিন্তু তার তুলনায় মানব-ভাষার বৈচিত্র, গভীরতা আর বহুমাত্রিক শ্রেষ্ঠত্ব অপরিমেয়। ভাষার মাধ্যমেই অনাদিকাল ধরে মানুষ তার অভিজ্ঞতা-জ্ঞান প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দিতে পেরেছে; গড়ে তুলতে পেরেছে গৌরবময় সমুন্নত সভ্যতা। পারস্পরিক যোগাযোগ থেকে শুরু করে মানবজীবনের সর্বস্তরে ভাষা; প্রধানত মাতৃভাষার গুরুত্ব ও মহিমা তাই বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না।
আমাদের অসামান্য গৌরব যে, আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। পৃথিবীর বিপুল সংখ্যক মানুষ আজ বাংলা ভাষাভাষী। অন্যতম আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার বিষয়টি বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে আজ আর কল্পনামাত্র নয়, বরং এর বাস্তব ও বিজ্ঞানসম্মত কার্যকারণ রয়েছে। জাতি-রাষ্ট্র-ভাষা এই তিনের মেলবন্ধনে বাংলাদেশই বিশ্বব্যাপী বাংলা ভাষা সুবিস্তারের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠবে বলে ধারণা করা যায়। মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার গৌরব যেমন ঐকান্তিকভাবে আমাদের, তেমনি সে গৌরবের সমগ্রপ্রসারী প্রতীক সুমহান একুশে ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে মানব সভ্যতার অহংকারেরও অংশ।
আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে ঘিরে ১৯৫২ সালে সংঘটিত বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর নতুন মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়। এই দিনে ইউনেসকো ২১শে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে আমাদের ভাষা আন্দোলনকে পৃথিবীর মানুষের গৌরবিত উত্তরাধিকারে রূপান্তরিত করে। ১লা মে যেমন আন্তর্জাতিক মে দিবস, যা পালিত হয় পৃথিবীর সব দেশে; ২০০০ সাল থেকে ২১শে ফেব্রুয়ারি দিনটিও তেমনি পালিত হচ্ছে বিশ্বজুড়ে, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের বাইরে বাঙালি জাতির জীবনে এমন গৌরবোজ্জ্বল অর্জন আর ঘটেনি। ভাষা আন্দোলনের শহীদ রফিক-বরকত-সালামরা এখন বিশ্ব মানুষের গৌরবিত অহংকার। এই দিবস ঘিরেই এখন থেকে পৃথিবীজুড়ে বিভিন্ন জাতিসত্তার মাতৃভাষা নিয়ে তৈরি হচ্ছে নতুন সচেতনতা। পৃথিবীর মানুষের সামনে আকাশছোঁয়া উচ্চতায় উঠে যাচ্ছে রফিক-সালাম-বরকতরা-একুশের ভোরে বিশ্বজুড়ে ঐক্যতান উঠছে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’। তাই আমাদের মাতৃভাষাকে নিজের করে পাওয়ার; নিজস্ব স্বকীয়তায় উজ্জিবীত করার সোনালী অধ্যায় ‘একুশ’ আমাদের অস্থিমজ্জায় এমনভাবে প্রথিত যে, একুশ আমাদের চেতনার অংশ, একুশ আমাদের প্রেরণার উৎস, একুশ আমাদের শিখিয়েছে কিভাবে একটি জাতি তার আত্ম মর্যাদায় স্বকীয় থাকতে পরে, কিভাবে ছিনিয়ে আনতে পারে তার হৃত অধিকার। একুশ আমাদের মাঝে সেই চেতনার জন্ম দিয়েছে যা একটি জাতিকে মাথা উঁচু করে বাঁচার সঞ্জীবনী দান করেছে।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যে জাতির মাতৃভাষা যত উন্নত, সে জাতি সব দিক থেকেই তত উন্নত।
মাতৃভাষা বিশেষ কোনো ব্যক্তি-মানুষের যেমন অন্যতম পরিচয়-উৎস, তেমনি তা একটি জাতিসত্তার অস্তিত্বেরও শ্রেষ্ঠ স্মারক। মানুষের কাছে যেসব বিষয় তার প্রাণের মতই প্রিয়, মাতৃভাষা তার অন্যতম। বস্তুত মাতৃভাষাই একজন মানুষের পরিচয়ের শ্রেষ্ঠতম উৎস। মাতৃভাষার মাধ্যমে বিশেষ কোনো মানুষ নিজেকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরে, তুলে ধরে তার জাতিসত্তার পরিচয়। মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করে কোনো জাতিই মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না, পারে না নিজের পরিচয়কে পৃথিবীতে উজ্জ্বল করে প্রকাশ করতে।
ভাষা সম্পর্কে আমার জ্ঞান একেবারে সীমিত পর্যায়ের হলেও আমি নিদির্¦ধায় বলতে পারি: স্বীয় মাতৃভাষার প্রতি আমার ভালোবাসা অত্যন্ত প্রখর এবং সুতীব্র। সেই ভালোবাসা থেকেই এই ভাষার প্রতি যে দায়বদ্ধতা আমার উপর বর্তায় তাকে আমি কোনোভাবেই খাটো করে দেখতে পারি না। আর এই দায়বদ্ধতা থেকেই আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, আমাদের দেশে মাতৃভাষায় উপযুক্ত সামর্থ অর্জন করার বিষয়টি প্রজন্মের সর্বপর্যায়ে গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হচ্ছে না অন্ততঃ তিন দশক ধরে। আমার পর্যবেক্ষণ বলে গত তিন দশকে ক্রমে ক্রমে মাতৃভাষার প্রতি আমাদের প্রজন্মগুলোর দায়বদ্ধতা এবং স্বকীয়ভাবে ভাষাকে ধারণ করার আগ্রহটা যেন ক্রমেই মিইয়ে যাচ্ছে। এটি যে একেবারে সর্বগ্রাসী বা সকল পর্যায়ে; তা না হলেও শুদ্ধভাবে বাংলার উচ্চারণ, শুদ্ধ বানানে বাংলা লিখা এবং সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে নিজ মাতৃভাষার প্রতি দায়বদ্ধ থাকার প্রবণতায় কোথায় যেন ভাটা পড়ে গেছে। অথচ অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় আমাদের জাতিতে শিক্ষিতের হার যেমন বেড়েছে, তেমনি সাহিত্য চর্চা বা কাব্যচর্চার প্রতিও গত দুই প্রজন্মের আগ্রহটাও অনেক খানিই বেড়েছে। প্রতি বছর একুশে বই মেলায় দর্শক উপস্থিতি এবং বই প্রকাশের সংখ্যা বিবেচনায় নিলে আমার এ বিবৃতির সাথে হয়তো কেউ দ্বিমত করবেন না। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় নিবেদিতপ্রাণ আমাদের মেধাবী ও সৃষ্টিশীল মানুষদের নিজস্ব অর্জন ও অবদান যে প্রখরতা নিয়ে এগিয়ে চলেছে, তা যেন একটি গন্ডির মধ্যেই আবদ্ধ হয়ে পড়ছে।
অনেকে হয়তো স্বপ্রতিভ হয়ে বলতে পারেন, বই প্রকাশের সংখ্যা বাড়লেও তথ্য প্রযুক্তির উৎকর্ষতার অধুনা সময়ে পাঠক সেভাবে বাড়েনি। বিষয়টি নিয়ে নানা বিতর্ক করাই যায়। বলতে পারেন, আজকের নতুন প্রজন্ম ফেসবুক- টুইটার আর ভার্চুয়াল গেমিং নিয়ে যেভাবে মেতে থাকে সে তুলনায় বইয়ের প্রতি বা পাঠ অভ্যাসের বিষয়ে যথেষ্ট সময় দেওয়ার সময় তাদের হাতে কতটুকুই বা থাকে। এই যুক্তিগুলো মেনে নিলেও কোনো সন্দেহ নেই যে, তারপরও আজ কাব্যচর্চার যে ব্যপ্তি তা কিন্তু কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না। তা ছাড়া ফেসবুক-টুইটার এর মতো সামাজিক মাধ্যমগুলো যেমন প্রজন্মকে বই থেকে কিছুটা দুরে সরিয়ে নিয়ে গেছে, তেমনি এই মাধ্যমগুলোই আবার তাদের কাব্য-সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে নতুন মাত্রাও যোগ করেছে। সেই বয়ঃসন্ধি সময়ের আবেগঘণ মূহুর্তে কোনো সহাপাঠি বা কোনো নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে দু’একটি কবিতা লেখার পর যিনি পাঁচ দশ বছর আর কাব্যের ধারে-কাছেও ঘেঁষেননি; খোঁজ নিয়ে দেখুন, ফেসবুকের কল্যাণে তিনিই আবার কবিতা লিখতে শুরু করেছেন। প্রতিনিয়ত ফেসবুকে অসংখ্য ছড়াগ্রুপ, কবিগ্রুপ, সাহিত্যসেবি গ্রুপ এবং বিরামহীন বিবৃতি আর মন্তব্য আমাদের সেই জানানই দিচ্ছে যে, আগামী দিনের বাংলা সাহিত্য আরো সমৃদ্ধ এবং সম্প্রসারিতই হতে চলেছে। এর উপরে রয়েছে বিভিন্ন ব্লগ; ব্লগগুলোতে যে তরুণ-তরুণীরা দিনরাত লিখে চলেছেন নেশার মতো। তাদের এই লেখালেখি অন্য কোনোভাবে তার জীবন গঠনে বা সমাজের কোথাও কিঞ্চিত ছন্দপতন ঘটালেও এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, সাহিত্যের এই নিবেদিত প্রাণ অধুনা প্রজন্ম বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধই করছে।
কিন্তু আমার আশঙ্কা হলো অন্য জায়গায়; সেই কথাটা পাড়ার জন্যই এতো বাগড়ম্বরতা। আর সেটা হলো এই ধাবমান সাহিত্য চর্চার ডামাডোলে যে আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে সেই জায়গায় কারো তেমন নজরদারি না থাকা বা দায়িত্বহীনতার বিষয়ে। সাতিহ্য চর্চা, নাগরিক সাংবাদিকতা (সিটিজেন জার্নালিজম) বা ছড়া-কবিতা লেখার প্রতি বর্তমান প্রজন্মের যে ঝোঁক একে আমি সর্বান্তকরণে শ্রদ্ধা করি। আমি বিশ্বাস করি যে, এভাবে আমাদের সাহিত্য সম্ভার নিশ্চয়ই সমৃদ্ধ হবে। কিন্তু যে ভাষা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সঞ্চরিত হবে সেই প্রিয় ভাষা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে যেন বিকৃত রূপ নিয়ে উপস্থিত না হয়। বা তাদের ভাষা সম্পর্কে দ্বিধান্বিত না করে, সেজন্য আজ যারা সাহিত্য চর্চা বা ওয়েব জগতে লেখালেখি করছেন, তাদের প্রতি আমার একটাই মিনতি নিজের ভাষা বিকৃত হওয়ার আগে সতর্ক হোন। দেশ ও জাতির প্রতি দায়বদ্ধতার পাশাপাশি ভাষার প্রতিও যে আপনার আমার দায়বদ্ধতা আছে তার প্রতি যতœশীল হোন। তা না হলে- একুশ ঘিরে আমাদের যে অহংবোধ, তা একদিন কোনো এক প্রান্তসীমায় আপনাকে আমাকে ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেই।
কারণ মানুষের ভাষা ব্যবহারের সংখ্যাতাত্ত্বিক হিসেবে বিশ্বে বাংলা ভাষার অবস্থান চতুর্থ। আমাদের মাতৃভাষার জন্য এ এক বিশাল গৌরব। পৃথিবীতে চার সহ¯্রাধিক ভাষার মধ্যে চতুর্থ স্থানে থাকা বাংলা ভাষা প্রকৃত অর্থেই দাবি করতে পারে গৌরবের আসন। প্রায় ২৫ কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। এ সংখ্যাতত্ত্বও আমাদের মাতৃভাষায় গৌরবের অন্যতম ভিত্তি-উৎস। সেই ভাষাকে আমরা যদি নিছক অবহেলায় বিকৃত করে দেই, তা কিন্তু আমাদের রক্ত ঝরার ইতিহাসকে বিক্ষুব্ধ করবে।
জাতীয় মাতৃভাষা হিসেবে বাংলাই শিক্ষিত সমাজের কাছে অগ্রাধিকার পাবে। আর অঞ্চল ভিত্তিক আমার যে মাতৃভাষা সে ভাষার প্রতিও আমার প্রেম আমার টান থাকবেই এটা খুবই স্বাভাবিক। কারণ ভাষা কোন বিজ্ঞান নয়, নয় কোনো প্রযুক্তি। মোটাদাগে বললে ভাষার মূল উপযোগীতা অপরের বোধগম্য উপায়ে যোগাযোগ করা, সেক্ষেত্রে তো আঞ্চলিক ভাষার বিকল্প নেই। কিন্তু আর একটু এগুলে ভাষার অন্যান্য উপযোগীতাগুলোর মধ্যে রয়েছে অনুভূতি ও ভাবাবেগের আদান প্রদান, তথ্যের প্রচার ও উদ্বুদ্ধকরণ, প্রশিক্ষণ প্রদান-গ্রহণ অথবা শিল্প সাহিত্য চর্চা এবং তথ্য সংরক্ষণ। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, প্রাত্যহিক যোগাযোগে যেমন, তেমনি জ্ঞানচর্চা, আত্ম-আবিস্কার, যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলা, ইতিহাস-সংস্কৃতি সম্পর্কে জানা সবকিছুরই অন্যতম মৌলিক মাধ্যম বস্তুত ভাষা। বিশেষ করে দেশপ্রেমের ধারণাটি ভাষার সাথে ওতপ্রোত জড়িত। বিভিন্ন শাখায় আমরা যে বিশেষায়িত দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করি, পেশাগত দিক থেকেও তার অনেক অনেক প্রকরণ রয়েছে। তাই ভাষা ব্যবহারে সচেতনভাবেই আমাদের সবাইকে যতœশীল হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। আর এই যতœশীল হওয়ার জন্য চর্যাপদ চর্চা বা প্রকৃতি-প্রত্যয়-উপসর্গ নিয়ে একেবারে পন্ডিত হওয়ারও প্রয়োজন নেই। বা তৎসম- তদ্ভব নিয়ে বিতর্কে জড়ানোর প্রয়োজন নেই। মোটাদাগে ওয়েব জগতে আমার তথ্য অন্যের মাঝে সঞ্চরিত করা বা আমার আবেগ অনভূতি ও কাব্যচর্চার ক্ষেত্র বিস্তৃত করার জন্য আমার যে বিচরণ ক্ষেত্র- সেখানে চলনসই, যুৎসই এবং মোক্ষম শব্দটি বসানোর বিষয়ে সচেতন থাকা এবং বাংলা বানানের আধুনিক ধারা অনুসরণের মানসিকতা তৈরির এখনই সময়। বানানের শুদ্ধতা নিয়ে শিক্ষিত সমাজের এই নির্বিকার ভাব আমাদের দায়বদ্ধতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে।