শামীমুল আহসান- ঢাকা ব্যুরো অফিস, দৈনিক রাঙামাটি : ১৯৭১ সালে ৯ মাসের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহিদের বিনিময় পাকিস্তান থেকে বিভক্ত হয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যূদয় ঘটে। বাংলার আপামর জনসাধারণ দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র সংগ্রাম করে বাংলাদেশকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত করে ১৯৭১সালের ১৬ ডিসেম্বর। স্বাধীনতার ৪৬ বছর অতিবাহিত হতে চলেছে, কিন্তু বাংলাদেশ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিক দিয়ে এখনও স্থিতিশীল হতে পারেনি। শিক্ষার পরিবেশ নাই, শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস। আইনের শাসন ও ন্যায় বিচার ভুলুন্ঠিত। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও যোগাযোগের অভাবে দারিদ্রসীমার নীচে সাধারণভাবে দৈনন্দিন জীবন অতিবাহিত করে আসছে। স্বাধীনতাসংগ্রামের পর দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যারা অবদান রাখছেন মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন আবু তাদের একজন। এই প্রতিবেদনে সংক্ষেপে তার বর্নাঠ্য কর্ম ও রাজনৈতিক জীবনের অংশ বিশেষ তুলে ধর হল।
মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন। বাল্য নাম ছিল আবু তাহের। ছোট বেলায় মা-বাবা তাকে আবু ডাকতেন। তিনি বাংলা ১৩৫৮ সালের ৬ ফাল্গুন মঙ্গলবার সকাল ১০ ঘটিকার টাঙ্গাইল জেলার দেলদুয়ার থানার সেহড়াতৈল গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা মৌলভী খোরশেদ আলী একজন সমাজ সেবক ও ধার্মিক ব্যাক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। দাদা- মরহুম রিয়াজ উদ্দিন সরকার, দাদী- আমেনা খাতুন। নানা- কাজী এখলাস উদ্দিন, নানী-হালিমা খাতুন। ১৯৯৪ সালে ১৪ আগষ্ট তার পিতা ইন্তেকাল করেন। সেহড়াতৈল গ্রামের পারিবারিক গোরস্থানে তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। তার মা রাবেয়া খাতুন সেহড়াতৈল গ্রামে বসবাস করছেন। তিনি পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে দ্বিতীয়। বড় ভাই মরহুম আবদুর রাজ্জাক জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপক ছিলেন। ছোট বোন ছাহেরা খাতুন আঙ্গুর। ছোট ভাই আসাদ ইবনে খোরশেদ (বাবু) একটি সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন। সর্বকনিষ্ট বোন নাসরিন সুলতানা রেনু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করছেন। বাংলা ১৩৮২ সালের ১ বৈশাখ স্ত্রী আঞ্জুমানআরা হাওয়ার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বর্তমানে তিনি একজন সুগৃহিনী।
মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন আবু’র বয়স যখন ৪ বছর তখন তার পিতা মরহুম মৌলভী খোরশেদ আলী টাংগাইল সদর থানার দেলদুয়ার ইউনিয়নের সেহড়াতৈল গ্রাম থেকে এসে কাতুলী ইউনিয়নের খরশিলা গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। শৈশব থেকেই মেধাবী ছাত্র ছিলেন তিনি। ১৯৬৪ সালে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করার পর তাকে আনুহলা জুনিয়র হাই স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হয়। সেই প্রতিষ্ঠান থেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া সমাপ্ত করার পর তার বাবা-মা ১৯৬৭ সালে তাকে টাঙ্গাইল জেলার বর্তমান দেলদুয়ার থানার ছিলিমপুরের এম.এ করিম উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণীতে বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি করে দেন।
আবুল হোসেন আবু ১৯৬৯ সালে দশম শ্রেণীর মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষার পরীক্ষার্থী তখন পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসক ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে মাওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দেশের সর্বত্র গণঅভ্যূত্থান ঘটে। ছাত্রলীগের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে নির্বাচনী পরীক্ষা (টেষ্ট) সমাপ্ত করেই টাঙ্গাইলের গণঅভ্যূত্থানে যোগ দেন। এ সময় তিনি মাওলানা ভাসানীর সান্নিধ্যে আসেন।
১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ আইয়ুব খান সেনাবাহিনী প্রধান ইয়াহিয়া খানের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করায় সামরিক শাসন জারী হলে সারা পশ্চিম টাংগাইলে ব্যাপক ধরপাকড় আরম্ভ হয়। ছাত্র জনতার অনেকে গ্রেফতার হন। পাক সামরিক বাহিনী তাদের উপর অমানুষিক নির্যাতন করে। নিরীহ জনসাধারণের উপর নির্যাতন বন্ধ করার জন্য তিনি ন্যাপ সভাপতি মাওলানা ভাসানীর শরনাপন্ন হন। মাওলানা ভাসানীর হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি আয়ত্বে আসে।
নির্বাচনী পরীক্ষার পর তিনি আর লেখাপড়া করতে পারেননি। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব শাহী ও ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেয়ার ফলে গ্রেফতার এড়ানোর জন্যে তাকে একটানা ৬ মাস পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে। ১৯৬৯ সএল তাকে পলাতক অবস্থায় এস.এস.সি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়। যার ফলে তিনি এস.এস.সি পরীক্ষায় আশানুরূপ ফল লাভ করতে পারেননি। এ সময় তার বন্ধুদের অনেকে পাক সেনা কর্তৃক বন্দী হন এবং জেলাখানা থেকেই এস.এস.সি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন।
এ গণঅভ্যুত্থানের ঢেউ লাগে টাঙ্গাইলেও। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর অনুসারী আবুল হোসেন আবু’র শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মো. নূরুল ইসলাম নূরু এবং তৎকালীন করটিয়া সাদত কলেজ থেকে আগত দু’জন ছাত্রলীগ নেতার নেতৃত্বে এম.এ করিম উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র সমাজ আইয়ুব বিরোধী গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করে। আবুল হোসেন তাদের সাথে যোগদেন এবং ছাত্রলীগ তথা সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্য হিসেবে বিভিন্ন সভা-সমাবেশ ও মিছিলে অংশগ্রহণ করেন। এ সময় তিনি মাওলানা ভাসানীর সান্নিধ্যে আসেন এবং মাওলানা ভাসানীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এর সাথে তার পরিচয় ঘটে।
এদিকে নির্বাচনের পূর্বেই ১২ নভেম্বর ১৯৭০ সালে ঘূর্নিঝড় ও জলোচ্ছাসে ভোলা ও নোয়াখালীসহ উপকূলীয় দ্বীপসমূহের জানমাল গৃহাদির ব্যাপক ক্ষতি হয়। সে সময় ঘূর্নিদূর্গত উপকূলীয় এলাকায় ক্ষতিগ্রস্থ জনসাধারণের সাহায্যে আবুল হোসেনও স্থানীয়ভাবে ত্রাণ কমিটি গঠন করেন এবং টাঙ্গাইল থেকে ত্রাণ সংগ্রহ করে ঘূর্নিদূর্গত এলাকায় প্রেরণ করেন।
মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন আবু’র বড় ভাই আব্দুর রাজ্জাক তখন ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে লেখা-পড়া করতেন। ঢাকার রাজনৈতিক অবস্থা ছিল টলমলে। আবুল হোসেন ৩ মার্চ ঢাকায় আসেন এবং ১০ মার্চ ঢাকায় অবস্থান করেন। এসময়ে তিনি তার বড় ভাইূেয়র সাথে ৩ মার্চ শেখ মুজিবের পল্টন ময়দানের জনসভায় ও ৭ মার্চ শেখ মুজিবের রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় এবং ৯ মার্চ মওলানা ভাসানীর পল্টন ময়দানের জনসভায় যোগদান করেন।
পরবর্তীতে তিনি তার বড় ভাই আবদুর রাজ্জাককে টাঙ্গাইলের গ্রামের বাড়ীতে ফিরিয়ে নিতে পুনরায় ১৭ মার্চ ঢাকায় আসেন। ঢাকার রাজনৈতিক পরিবেশ তখন খুবই উত্তপ্ত। ইতোমধ্যে বাঙালী-পাঞ্জাবী, বিহারী দাঙ্গা হয়েছে। কিন্তু বড় ভাই বাড়ী ফিরতে রাজী হলেন না। ঢাকার সর্বশেষ পরিস্থিতি তিনি নিজ চক্ষে দেখতে চান। তিনি দেখতে চান শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে। প্রতিদিনই সভা-সমাবেশ মিছিল হচ্ছে ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে শেখ মুজিবের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্যে। ঢাকা শহরের প্রতিটি ঘরে ঘরে যেন দূর্গ গড়ে উঠেছে, থমথমে অবস্থা। আবুল হোসেন ৪ দিন ঢাকায় থেকে বড় ভাইয়ের সাথে থেকে ২১ মার্চ বাড়ী ফিরলেন।
২৫ মার্চের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রায় সকল নেতৃবৃন্দ করাচী চলে গেলেন। রয়ে গেলেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভূট্টো। সরল বিশ্বাসে শেখ মুজিব ও তার দল যখন ২৫ মার্চের জাতীয় পরিষদ অধিবেশনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ঠিক সেই মুহুর্তে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালো রাতে ১২.২৫ মিঃ পাকিস্তানের সামরিক সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার বাসভবন হতে গ্রেফতার করে।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবের পক্ষে প্রথমে আওয়ামী লীগ নেতা এম.এ. হান্নান, ও পরে মেজর জিয়াউর রহমান জিয়া ২৭ মার্চ, স্বাধীনতা ঘোষণা পাঠ করেন। তাতে জনসাধারণ মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণে উদ্বুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন এম.এ. হান্নান ও মেজর জিয়ার ভাষণ রেডিওতে শুনেছিলেন। তা এখনো তার স্মৃতিতে বিদ্যমান বলে জানিয়েছেন।
রেডিওতে তাদের ভাষণ শুনে উদ্ভুদ্ধ হয়ে মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন আবু ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বিকেল ৪টায় টাঙ্গাইল জেলার সদর উপজেলার কাতুলী ইউনিয়নের খরশিলা গ্রামের ঈদগাঁমাঠে আনুমানিক ২/৩ হাজার লোকের সমাবেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
পরবর্তিতে আবুল হোসেন আগষ্ট মাসে টাঙ্গাইলের চর অঞ্চলের ২৩৭ জন যুবককে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ভারতে যান। ভারতের মেঘালয়ের (বৃহত্তর আসাম) তুরার ক্যাম্পে ব্রিগেডিয়ার সানসিং বাবাজীর তত্ত্বাবধানে সামরিক প্রশিক্ষণ শেষে সহযোদ্ধাদের নিয়ে কর্ণেল তাহেরের নেতৃত্বাধীন ১১ নং সেক্টরের অধীনে ভারতের সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ কমান্ডে ইনফ্যানট্রি ব্যাটালিয়নে তৎকালীন বৃহত্তর ময়মনসিংহ সেক্টরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধকালীন সময়ে তিনি গোয়েন্দ বিভাগের দায়িত্বে থাকার সুবাদে তার ভারতীয় গোয়েন্দ বিভাগের ক্যাপ্টেন গোল্ড ব্লাডার ও ক্যাপ্টেন বি.কে. পানওয়ার, রেজিমেন্ট কমান্ডার লে. কর্ণেল কে.এস. ব্রার, ৯৫ মাউনটেইন ব্রিগেডের ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার সানসিং বাবাজীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সুযোগ হয়। অতঃপর যুদ্ধকালীন গোয়েন্দা কর্মকান্ডের কোন এক পর্যায়ে সানসিং বাবাজীর মাধ্যমে ভারতের ৯৫ মাউনটেইন ও ছত্রীসেনা (জঙ্গী পল্টন) ব্রিগেডের সমন্বয়ে গঠিত ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল গান্দব নাগরার সাথে তার পরিচয়ের পর সখ্য গড়ে উঠে। এতে করে তিনি বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার পুরো সীমান্ত এলাকায় তার কার্যক্রম চালিয়ে যেতে সুযোগ পান। যুদ্ধকালীন তার সাথি মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন টাঙ্গাইল শহরের থানাপাড়ার মো. শাহজাহান মিয়া, চৌবাড়ীয়ার দেলবর আনসারী, অলোয়ার আবদুল কাদের, কাতুলীর আব্দুস সামাদ মাষ্টার ও আবু সাঈদ, দিঘুলিয়ার বেলাল হোসেন (আলী), আনুহলার কোরবান আলী, পাথরাইলের ময়েজ বি.এস.সি, মামুদপুরের (কুঁচিয়ামুড়ির) আব্দুল জলিল, কাকুয়ার (হুগড়ার) মোকাদ্দেস আল-মামুন, জাঙ্গালীয়ার ছানোয়ার হোসেন খান, দেলদুয়ারের মনোরঞ্জন ধর, রুদ্র জুগনীর মাহমুদ আলী, খরশিলার আবু হাছান মাষ্টার (হাছেন আলী), রূপসীযাত্রার মোহাম্মদ সেলিম, সন্তোষের ইমান আলী, চকগোপালের রফিকুল ইসলাম ও সানোয়ার হোসেন, কুকুরিয়ার আব্দুল মান্নান অন্যতম।
মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন আবু শেরপুর, জামালপুর ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের ১১ নং সেক্টরের অধীনে অনেকগুলো যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি সতের আঠারটি যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। এ সকল যুদ্ধের মধ্যে কয়েকটি ছিল ভয়াবহ যুদ্ধ। ধানুয়া-কামালপুর, শ্রীবর্দী-ভায়াডাঙ্গা ও ময়মনসিংহ-হালুয়াঘাট যুদ্ধ ছিল আবুল হোসেনের সহযোগী নেতৃত্বাধীন ভয়াবহ ও স্মরণীয় যুদ্ধ। শেরপুর জেলার শ্রীবর্দী-ভায়াডাঙ্গায় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে তার সহযোগী তিন জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ভায়াডাঙ্গা যুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ছিলেন আবু তাহের, আব্দুল গনি ও অপর একজনের নাম জানা যায়নি। বিজয়ের আগ পর্যন্ত তিনি বেশ কয়েকটি যুদ্ধে অঙশ নেন। এই সল্প পরিসরে সে ইতিহাস বর্ননা করা সম্ভব নয়। সে বিষয় পরে আলোকপাত করা হবে।
১৯৭১ সালে যুদ্ধের কারনে এপ্রিলের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা ১৯৭২ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত হয়। পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে উচ্চতর গণিতসহ কয়েকটি বিষয়ে লেটার মার্কস পেয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ১ম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। পরে তিনি টাঙ্গাইলের বাগবাড়ী চৌবাড়ীয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান শিক্ষক হিসেবে প্রায় ১ বছর ৬ মাস শিক্ষকতা করেন।
১৯৭২ সালে তিনি তার নিজ গ্রাম টাঙ্গাইল সদর থানার খরশিলায় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। উক্ত বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। এসময় তিনি মাওলানা ভাসানীর সাথে ঘনিষ্ট হয়ে উঠেন এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি’র (ভাসানী) রাজনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িত হয়ে পড়েন।
এসময় আবুল হোসেন আবু’র তার বন্ধু মুক্তিযোদ্ধা আবু হাছান মাষ্টারের (মো. হাছেন আলী) পরামর্শে শিক্ষকতা বাদ দিয়ে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ম বর্ষে ভর্তি হন। একই বছর ৭ মার্চ বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তিনি জাতীয় সংসদ নির্বাচনী এলাকা- ১৩৭, টাঙ্গাইল- ৫, টাঙ্গাইল সদর- দেলদুয়ার আসনে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সিনিয়র সহ-সভাপতি ড. আলীম আল রাজীর পক্ষে পশ্চিম টাঙ্গাইলে নির্বাচনী প্রচারাভিযানে নেতৃত্ব দেন।
১৯৭৩ সালে তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকসু (ঊটঈঝট) নির্বাচনে জাসদ ছাত্রলীগের প্রার্থী হিসেবে সোহরাওয়ার্দী হল সংসদে সহকারী সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্ধিতা করে বিজয়ী হন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নকালীন পুরো সময়ে তিনি এ পদে বহাল থাকেন। এ সময়ে তিনি মেজর জলিলের সান্নিধ্যে আসেন এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে জড়িয়ে পড়েন।
আবুল হোসেন ১৯৭৭ সালে অনুষ্ঠিত ১৯৭৫-৭৬ শিক্ষাবর্ষের বি.এস.সি ইঞ্জিনিয়ারিং(সিভিল)- এর চূড়ান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কর্মজীবনের দিকে ধাবিত হন।
১৯৭৮সালের ১ জানুয়ারী ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন “দি ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড” এর সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে চাকুরীতে যোগদান করেন। সে সময় তিনি বাংলাদেশ অষ্ট্রেলিয়ান ক্যাটল ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট, বরাল রিভার ব্রীজ প্রজেক্ট এবং দি প্যান প্যাসিফিক হোটেল সোনারগাঁও নির্মাণ কাজে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৯-৮১ সালে তিনি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীন জামালপুর জেলা পরিষদে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগে এবং বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্লানিং স্কীম অধিদপ্তরে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পানি উন্নয়ন বোর্ডে দায়িত্বে থাকাকালীন তিনি নেডিকোর সাথে যৌথভাবে বৃহত্তর রাজশাহী, পাবনা ও বগুড়া জেলার ফ্লাড কন্ট্রোল ও ড্রেনেজ সিস্টেম এর প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই করেন। পরবর্তীতে তিনি বিভিন্ন নির্মাণ ও উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠানে উর্ধ্বতন প্রকৌশলী, প্রকল্প পরিচালক ও প্রকৌশল উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
সরকারী চাকুরী ছেড়ে ১৯৮১ সালে তিনি “দি প্রগ্রেসিভ ইঞ্জিনিয়ার্স এন্ড কন্সট্রাকশন লি:” নামে একটি নির্মাণ শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ১৯৮৪ সালে তিনি টাঙ্গাইলের সন্তোষে “আবুল হোসেন পিস্ ফাউন্ডেশন” নামক একটি সমাজ কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান স্থাপন কওে দুঃস্থ মানবতার সেবায় পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৮৭ সালে তিনি “ইষ্টার্ণ ডেভেলপমেন্ট এসোসিয়েশন” নামক একটি সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। ঐ সময় তার মূলধন ৬৫ হাজার টাকা বন্যার্তদেও সাহাজ্যে দান করেন।
এর মধ্যে ১৯৮২ সালে তিনি পুনরায় জাসদের সক্রিয় রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৮৯ সালে তিনি জাসদ (সিরাজ) এর কেন্দ্রীয় কমিটির অর্থ বিষয়ক সম্পাদক নিযুক্ত হন। জাসদ রাজনীতিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য শাজাহান সিরাজের সাথে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সভা সমিতিতে বক্তব্য রাখেন।
১৯৯০ সালে তিনি “দি ইঞ্জিনিয়ারিং কনসালট্যান্টস্ লিমিটেড” নামে একটি উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এছাড়া ১৯৯১ সালে তিনি “বাংলাদেশের রাজনীতি” নামক একটি পুস্তিকার প্রকাশ করেন। সে পুস্তিকায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিবর্তনসমূহ তুলে ধরা হয়।
১৯৯৩ সালে আওয়ামী লীগের একাংশ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির একাংশ, কমিউনিষ্ট পার্টির একাংশ ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (সিরাজ) একত্রিত হয়ে ড. কামাল হোসেন এর নেতৃত্বে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হলে তিনি তাতে অংশগ্রহণ করেন। পরিশেষে ১৯৯৩ সালে ২৯ আগষ্ট এ সকল দলের সমন্বয়ে ড. কামাল হোসেন এর নেতৃত্বে গণফোরাম গঠিত হলে তিনি এ দলের প্রাথমিক সদস্যপদ গ্রহণ করেন।
১৯৯৩ সালে তিনি নামে একটি সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান, যা আবুল হোসেন পীস্ ফাউন্ডেশন এর একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে “লেবু দাতব্য চিকিৎসালয়” স্থাপন করেন এবং ১৯৯৬ সালে “এম. খোরশেদ লাইব্রেরী” নামে আর একটি সমাজকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন।
১৯৯৬ সালে ১২ জুন অনুষ্ঠিত দেশের সাধারণ নির্বাচনে গণফোরামের প্রার্থী হিসেবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনী এলাকা- ১৩৭, টাঙ্গাইল- ৫ (টাঙ্গাইল সদর- দেলদুয়ার) থেকে প্রতিদ্বন্ধিতা করেন।
১৯৯৭ সালে ৩ এপ্রিল মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন আবু’র নেতৃত্বে ‘জাতীয় ছাত্র কংগ্রেস’ নামে একটি নিরপেক্ষ ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়।
ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিতব্য দেশের সাধারণ নির্বাচনে গণফোরামের প্রার্থী হিসেবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনী এলাকা- ১৩৭, টাঙ্গাইল- ৫ (টাঙ্গাইল সদর- দেলদুয়ার) থেকে প্রতিদ্বন্ধিতা করেন।
২০০৩ সালে ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন কৌতুহলি হয়ে চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘এম.বি.এ’ পাশ করেন।
গণতন্ত্র ও শোষনহীন সমাজ ব্যবস্থা কায়েমে সুশীলসমাজসহ দেশের আপামর জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করার প্রয়াসে ২০০৩ সালের ২৩ মার্চ ‘বেঙ্গল জাতীয় কংগ্রেস (বিজেসি)’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। এ সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করায় তাকে সহযোগিতা করেন, কুষ্টিয়ার মুক্তিযোদ্ধা মো: মারফত আলী মাষ্টার, টাঙ্গাইলের আইয়ুব উদ্দিন ভূঞাসহ আরও অনেকে। ঢাকার বিজয় সরণী টাওয়ারের ২য় তলায় সংগঠনের কার্যক্রম শরু হয়।
ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন আবু’র নেতৃত্বে গত ১ নভেম্বর, ২০১৩ রোজ শুক্রবার বিকেল ‘বেঙ্গল জাতীয় কংগ্রেস’ (বিজেসি) বাংলাদেশ জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক অনাড়ম্বর সাংবাদিক সম্মেলনে সংশোধিত ৮ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
বর্তমানে, মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন আবু “বেঙ্গল জাতীয় কংগ্রেস” (বিজেসি) ও জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট (এনডিএ)-র কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারর্সদের দ্বারা গঠিত সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, টাংগাইল জেলা কমিটির সভাপতি দ্বায়িত্ব পালন করছেন।
পোস্ট- ২৬ ডিসেম্বর ২০১৫, দৈনিক রাঙামাটি