॥ আনোয়ার আল হক ॥ শোভা, সৌন্দর্য, প্রশাসন সবই আছে। আছে জনপদ, পাহাড়, ঝর্ণা ও নিসর্গ; আছে সরকারের বিভিন্ন সেবা বিভাগ ও কর্তা ব্যক্তিরা। সর্বপোরী একটি জেলা শহরের উপযোগী সকল প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি রাঙামাটি শহরে রয়েছে তিনটি বিশেষায়িত উচ্চপদের প্রতিষ্ঠান।
কিন্তু এখানে নেই প্রাণের দাম বা জীবনের মূল্য। এই শহরে একজন মানুষ অসুস্থ হয়ে গেলে বারবার এমন অনুভূতিই সবার মাঝে মূর্তিমান হয়ে উঠে।
এভাবে মন্তব্য করার কারণ খোলাসা করার আগে সাম্প্রতিক একটি সঙ্কট মূহুর্তের বিবরণ তুলে ধরতে চাই।
প্রেক্ষাপট: রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতাল; জেলার স্বাস্থ্য সেবায় নিয়োজিত সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তি সিভিল সার্জন নিজেই চিকিৎসকের টেবিলে। আর্ত একজন সাংবাদিক। শুধু সাংবাদিক বললে কম বলা হবে তিনি গোটা পার্বত্য চট্টগ্রামের একজন স্বনামধন্য সংবাদসেবি। প্রথম আলোর রাঙামাটিতে কর্মরত স্টাফ রিপোর্টার হরি কিশোর চাকমা।
গত বৃহস্পতিবার সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার পর তাকে অত্যন্ত সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় রাঙামাটি হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। তার ডান কান দিয়ে অনবরত রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল। প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পরই সিভিল সার্জনসহ উপস্থিত চিকিৎসকগণ পরামর্শ দিলেন তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম নিতে হবে।
স্বাভাবিকভাবেই এমন রুগীর জন্য এ্যাম্বুলেন্স প্রয়োজন, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রায় ঘন্টাখানেক সময় প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালিয়েও হরিদার জন্য একটি এ্যাম্বলেন্স যোগাড় করা গেলো না। সিভিল সার্জন নিজে তো বটেই সেখানে উপস্থিত প্রেসক্লাবের সভাপতি সাধারণ সম্পাদকসহ জনা বিশেক সাংবাদিক, সকল ডাক্তার এবং শহরের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তির প্রচেষ্টা ফেল মারলো।
অবশেষে তাঁকে ঝুঁকি নিয়ে সাধারণ মাইক্রোবাসে চট্টগ্রাম পাঠানো হলো। পরে অবশ্য সেখান থেকে হরি কিশোর চাকমা কে হেলিকপ্টার (এয়ার এ্যাম্বুলেন্স) যোগে ঢাকায় নেওয়া হয়। তার অস্ত্রপচার সফল হয়েছে এবং ‘সর্বশেষ অবস্থা খুব বেশী ভালো’ বলা না গেলেও এ যাত্রায় তিনি সেরে উঠবেন বলেই চিকিৎসকরা মত প্রকাশ করেছেন।
পাহাড়বাসী মনেপ্রাণে কামনা করছেন ‘সকলের প্রিয় হরিদা’ সুস্থ হয়ে আবার রাঙামাটি ফিরে আসুন।
একজন স্বনামধন্য সাংবাদিক বলেই হরিদার জন্য শেষ পর্যন্ত এয়ার এ্যাম্বুলেন্স এর ব্যবস্থা করা গেছে। কিন্তু যখন রুগী একজন সাধারণ মানুষ? তখন অবস্থাটা কি দাঁড়ায় তা ভাবতেও গায়ে কাঁটা দেয়।
রাঙামাটি শহরে জীবন সঙ্কটের সময় এ্যাম্বুলেন্স না পাওয়ার এই অভিজ্ঞতা নতুন নয়। এই অবস্থা চলে আসছে বছরের পর বছর। বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তো কথাই নেই। গতকালও (২ নভেম্বর) রাণীরহাটে একটি সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে কয়েকজন মানুষ রাঙামাটি হাসাপাতলে ভর্তি হয়ে বিপদে পড়েন। তাদের স্বজনদের আহাজারিতে হাসাপাতালের পরিবেশ ভারি হয় বটে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ্যাম্বুলেন্স না পেয়ে তারাও আহতদের বেবীটেক্সীযোগে চট্টগ্রাম নিয়ে যান।
রাঙামাটিতে মেডিকেল কলেজ চালু হলেও বাকি প্রক্রিয়া নানা সমীকরণে দীর্ঘসূত্রিতার বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে রয়েছে। সাধারণ ১০০ শয্যার হাসপাতালে আসলে এর চেয়ে বড় ধরণের চিকিৎসা পাওয়া কঠিন।
এ ধরণের হাসাপাতালে যেমন যন্ত্রপাতির অভাব থাকে, তেমনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সঙ্কটও থাকে স্বাভাবিক ভাবেই। যে কারণে প্রতিনিয়ত রুগী নিয়ে যেতে হয় বড় শহরে, বড় হাসপাতালে।
কিন্তু রুগীকে অন্তত চিকিৎসকের দার পর্যন্ত পৌঁছুতে যে আবশ্যিক যন্ত্রটি প্রয়োজন তার নাম এ্যাম্বুলেন্স। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, রাঙামাটি হাসাপাতালের একমাত্র এ্যাম্বুলেন্সটি বিকল হয়ে পড়ে রয়েছে, দীর্ঘদিন যাবত। এটাই প্রথম বিকল হওয়া নয়।
জনশ্রুতি রয়েছে হাসপাতালের এ্যাম্বুলেন্সটি রাস্তার চেয়ে গ্যারেজেই থেকেছে বেশিদিন। এ ব্যপারে কার স্বার্থ কিভাবে কে রক্ষা করে, সেটা আজকের আলোচ্য বিষয় নয়। আমাদের আক্ষেপ এ্যাম্বুলেন্স মেরামতের দীর্ঘ সূত্রিতা নিয়ে। মাত্র ৫০ হাজার টাকা বাজেটের এই মেরামতে কেন কর্তারা সদয় (তৎপর) হতে পারেন না; বিশেষত সেটা যখন মানুষের জীবন মরণের প্রশ্ন! জেলা পরিষদ চাইলে এমন মেরামত কাজ মৌখিক অর্ডারেও করে ফেলতে পারে বলে মনে করেন সচেতন মহল। আপদকালীন খাদ্যশস্যের কিছু এখানে বরাদ্দ দেয়া হলেও হয়তো খুব বেশী আইনি জটিলতা হবে না।
মেরামত, বিকলের বাইরে প্রশ্ন উঠেছে নতুন এ্যাম্বুলেন্স ক্রয়ের বিষয় নিয়ে। সিভিল সার্জন অবশ্য জানালেন, রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালের জন্য একটি এ্যাম্বুলেন্স প্রদানের বিষয়টি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সক্রিয় বিবেচনায় রয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণলায় থেকে এ্যাম্বুলেন্স পাওয়া সময় সাপেক্ষ হতেই পারে, কারণ তাদের বিবেচনায় থাকে গোটা দেশ।
কিন্তু রাঙামাটির বিষয়ে চিন্তা করার জন্য পার্বত্য জেলা পরিষদ, উন্নয়ন বোর্ড, আঞ্চলিক পরিষদ এবং পার্বত্য মন্ত্রণালয় অতিরিক্ত বা বিশেষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে রয়েছে। পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের গোচরে এনে সকল সংস্থার সমন্বয়ের মাধ্যমে রাঙামাটির মানুষের প্রাণ বাঁচানোর জন্য দু’একটি এ্যাম্বুলেন্স ক্রয় করা সত্যিই কি জটিল প্রক্রিয়া? নাকি সদিচ্ছা বা উদ্যোগের অভাব? সে বিষয়ে এই জেলার মানুষ প্রশ্ন তুলতেই পারে।
বলা বাহুল্য যে, হাসাপাতালের এ্যাম্বুলেন্সটির বাইরে রাঙামাটিতে মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের একটি এ্যাম্বুলেন্স রয়েছে, যেটি প্রয়োজনের সময় কাজে লাগাতে পারা আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতই। এই এ্যাম্বুলেন্সটিও বেশির ভাগ সময় গ্যারেজেই থাকে, কখনও গাড়ি বিকল হয়ে কখনও চালক অচল হয়ে।
বর্তমানে এফপিএবি এবং ফায়ার সার্ভিসের এ্যাম্বুলেন্স দু’টি তথ্যগতভাবে সচল থাকলেও, মাঝে মাঝেই বিকল হয়ে যায়। কারণ এই দু’টির উপর চাপ বেশী; তাই তাদেরও সীমাবদ্ধতা মোকাবেলা করেই সার্ভিস দিতে হয়। এমন বক্তব্য প্রতিষ্ঠান দু’টির সাথে জড়িতদের।
সবকথার সার কথায় স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মনে প্রশ্ন উঠে এই শহরে কি সত্যিই প্রাণের দাম নেই???