রাঙামাটি-কাপ্তাই আঁকাবাকা সড়কটি স্বর্গীয় সৌন্দর্যের প্রতিচ্ছবি

1270
॥ মঈন উদ্দীন বাপ্পী ॥

রাঙামাটি থেকে কাপ্তাই অভিমুখি বিকল্প ১৯ কি:মি: আঁকাবাকা সংযোগ সড়কটি এখন স্বগীয় সৌন্দর্যের প্রতিচ্ছবি। এ সড়কে কোন পর্যটক ঘুরতে আসলে ফিরে যেতে ইচ্ছে করবে না। এক দিকে যেমন মেঘের লুকোচুরি খেলা ঠিক অন্যদিকে পাহাড়-হ্রদের মিতালীর সাথে প্রকৃতির সবুজ অরণ্য মিলে মিশে একাকার।

এ যেন বিধাতার এক অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলা খেলা। আর এ সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে বেলা পার হয়ে কখন সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বলে উঠে তার ইয়াত্তা নেই।

প্রকৃতির এ অপরূপ সৌন্দর্য এত মুগ্ধতা ছড়ায় যে এখানে থেকে যেতে ইচ্ছে করে। কোন পর্যটক এ জেলায় আসলে এ সড়কটি যদি একবার অবলোকন না করে তাহলে তার ভ্রমনটা মাটি হয়ে হয়ে যাবে।

তাইতো এ অপরূপ সৌন্দর্য দেখে প্রাশান্তির মনে বারংবার কবি গুরুর সেই বিখ্যাত গানটি বেজে উঠে………

“গ্রামছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ
আমার মন ভুলায় রে।
ওরে কার পানে মন হাত বাড়িয়ে
লুটিয়ে যায় ধুলায় রে।”………….

এ আঁকাবাকা সড়কটিতে কি নেই। স্বর্গীয় প্রতিচ্ছবি দেখতে পাবেন এ ১৯ কিলো:মি: পুরো সড়ক জুড়ে।

বনভান্তের স্মৃতি মন্দির:

বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের ধর্মীয় গুরু শ্রীমৎ সাধানানন্দ মহাস্থবীর বনভান্তের জন্ম স্থানকে সংরক্ষণে রাখতে জেলা সদরের বড়াদাম এলাকার মোরঘোনায় কাপ্তাই হ্রদে একটি স্মৃতি স্তম্ব তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া এ ধমীয় গুরুর প্রতি সম্মান রেখে মূল সড়কের উপরে বনভান্তের স্মৃতি মন্দির তৈরি করা হয়েছে। এ মন্দির এখন বৌদ্ধধর্মালম্বীদের তীর্থ স্থান হিসেবে পরিণত হয়েছে। এ মন্দিরে হাজার ভক্তরের ভীড় লেগে থাকে। তাই আশাপাশ জুড়ে টি স্টল ও ছোট্ট হাট বাজার বসে প্রতিনিয়ত। পাহাড়ি নারীরা তাদের বিভিন্ন পাহাড়ি তরি-তরকারী নিয়ে হাজির হয় এ হাট বাজারে। হ্রদে দেখতে পারেন, পাহাড়ি ললনাদের মাছ ধরা, মাছ শিকার। এ এলাকা এত মন মুগ্ধকর আপনার মন এক নিমেষে ভুলিয়ে দিবে। ক্লান্তির অবসাদ দূর করতে একটু দাড়িয়ে চা খেয়ে নিতে পারেন আর অপরূপ সৌন্দর্য অবলোকন করতে পারেন।

বড়াদাম থেকে রাঙামাটি শহর দেখা:

এ সড়কের বড়াদাম এলাকায় দাঁড়িয়ে আপনি রাঙামাটি শহরকে এক নিমিষে দেখতে পাবেন। এ সড়কে দাঁড়িয়ে রাঙামাটি শহরকে দেখলে মনে হবে অথৈই সাগরে এ যেন একটি দ্বীপ অঞ্চল।

বড় গাঙ রেস্টুরেন্ট:

সারাদিন ঘুরাঘুরি শেষে ভুঁড়ি ভোজন সারতে পারেন বড়াদম এলাকায় পাহাড়ি বৈচিত্রের ঢঙে গড়ে উঠা ‘বড় গাঙ’ রেস্টুরেন্টে। এক অপরূপ রূপে সাজিয়ে তোলা হয়েছে ব্যক্তি মালিকানাধীন এ হোটেলটিকে। পাহাড়ি খাবার থেকে শুরু করে দেশীয় খাবার পাওয়া যাচ্ছে স্বল্প দামে। ক্লান্তির অবসাদ দূর করতে পারেন এ জায়গায় বসে। খাবার শেষে কফির চুমুকে আড্ডাও জমিয়ে দিতে পারেন। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে বসার স্থানও রয়েছে এ জায়গায়।

বেড়ান্নে রেস্টুরেন্ট:

‘বড় গাঙ’ রেস্টুরেন্ট থেকে ৩০০ গজ দূরত্বে কিছু তরুণ উদ্যোক্তাদের হাত ধরে গড়ে উঠেছে ‘বেড়ান্নে’ (বেড়ানো) রেস্টুরেন্ট। এ হোটেলে খাবার না খেলে বুঝা যাবে না রসনা বিলাস কাকে বলে। এখানে হোটেলের ক্যাবিনে খেতে না চাইলে ঢঙ ঘরে বসে দুপুরের ভূঁিড় ভোজন সারতে পারেন। কফি খাওয়ার আড্ডা জমানোর জন্য রয়েছে হ্রদের পারে সুব্যবস্থা। এ হোটেলের পাশে হ্রদ দেখে মনে হবে যেন থাইল্যান্ডের কোন এক জায়গায় বসে আছেন। এছাড়া সাহসীদের হ্রদ ভ্রমনের জন্য এ হোটেলের অধীনে রয়েছে কয়েকটি প্যাডেল বোট। এ প্যাডেল বোট দিয়ে কাপ্তাই হ্রদ পরিভ্রমণ করতে পারেন।

হোটেল মালিকদের অনুভূতি:

বেড়ান্নে রেস্টুরেন্টের স্বত্তাধিকারী হিল্লোল চাকমা জানান, আমাদের নিজস্ব জায়গায় চলতে বছরের ৫জানুয়ারী ককেজন বন্ধু মিলে ঝুঁকি নিয়ে এ ব্যবসায় নামি। আমি বিশ্বাস করি এ সড়কে যদি নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার ও বিদ্যুৎ সমস্যা দূর করা যায় তাহলে দিনের পাশাপশি রাতেও আমাদের ব্যবসা চাঙা থাকবে।

বড় গাঙ রেস্টুরেন্টের স্বত্তাধিকারী প্রিয় দর্শী চাকমা জানান, অত্যন্ত পরিছন্ন পরিবেশে আমরা পর্যটকদের জন্য খাবার তৈরি করি। স্বাদ এবং সাধ্যর মধ্যে এখানে যে কেউ খেয়ে যেত পারেন। তিনি বলেন, এখানে পাহাড়ি এবং দেশীয় উভয়ই খাবার পাওয়া যায়। যে যেটা খেতে পছন্দ করে সেটা খেতে পারবে। তিনি আরও বলেন, আমরা হোটেলের পূর্ণাঙ্গ কাজ এখনো শেষ করতে পারিনি। পূর্ণাঙ্গ হলে আমাদের হোটেলে খাবারের মেন্যু বাড়ানো হবে।

বড়াদম হাট বাজার:

জেলা সদরের মধ্যে সবচেয়ে পুরনো হাট বাজার বড়াদম। এ বাজার কখন গড়ে উঠেছে কেউ সঠিক সাল বলতে না পারলেও স্থানীয় কয়েকজন পাহাড়ি প্রৌঢ় বলছে ১৯৮৫ সালের দিকে এ হাট বাজার গড়ে উঠেছে। প্রতিদিন এখানে হাট বাজার জমে উঠে। পাহাড়ি বাজার থেকে শুরু করে ফলমূল, শাকসবজি সবই পাওয়া যায়। আর ভ্রমণ শেষে বাড়ির জন্য তাজা শাকসবজি কিনে নিতে পারেন এ হাট বাজার থেকে।

রাঙামাটি-কাপ্তাই সংযোগ ব্রিজ:

কাপ্তাই উপজেলায় যেতে হলে এ ব্রিজ মাড়িয়ে আপনাকে যেতে হবে। আর এ ব্রিজ মাড়িয়ে যাবেন আর এর সৌন্দর্য অবলোকন করবেন না তা কি হয়। অনেক পর্যটক তাই একটু প্রশান্তির ছোঁয়া পেতে কিংবা সেলফি পাগল মানুষেরা নেমে পড়েন সেলফি তুলতে। এছাড়া স্থানীয়রা এ ব্রিজে আড্ডায় মেতে উঠেন অবসর সময়ের ফাঁকে।


আর্জেন্টিনা ব্রিজ:

রাঙামাটি-কাপ্তাই সংযোগ সড়কের ডানপাশে শহরের ভিতরে তৈরি করা হয়েছে এ ব্রিজ। কাপ্তাই হ্রদের উপর নির্মিত ব্রাক্ষণটিলা-আসামবস্তি সংযোগ ব্রিজটি আর্জেন্টিনা পতাকার রঙে রাঙিয়ে তোলার কারণে স্থানীয়রা এ বিজ্রের নাম দিয়েছে আর্জেন্টিনা ব্রিজ। বিকেলে ঢল নামে এ বিজ্রের সৌন্দর্য অবলোকন করার জন্য। আপনি চাইলে এ বিজ্রের সৌন্দর্য অবলোকন করতে পারেন।

সূর্যাস্ত অবলোকন:

সূর্যাস্ত দেখতে পারেন এ সড়কে। আর সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতিকে আপনার বিদায় জানাতে হবে। মন শুধু একটি কথা বলে, ‘হে প্রকৃতি, আজকের মতো বিদায়, আবার দেখা হবে কোন এক সময়’।

 এ সড়কের নিরাপত্তা:

রাঙামাটি-কাপ্তাই সংযোগ সড়কটিতে ভয়েরও কারণ রয়েছে। এ সড়কে সন্ধ্যার পর চলাচলে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। এ সড়কের কাপ্তাই উপজেলার প্রবেশ মুখে বন্য হাতির পাল নেমে আসে। আর ঘটে যেতে পারে যে কোন সময় বড় ধরণের ঘটনা। এছাড়া এ সড়কে বিদ্যুৎ না থাকায় বড় দুর্ভোগ পৌহাতে হয় স্থানীয় অধিবাসীসহ পর্যটকদের। যে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে সন্ধ্যা নামার আগে এ সড়কে অবস্থান না করাই বুদ্ধিমানের কাজ।

পর্যটকদের অভিমত:

ঢাকা থেকে বেড়াতে আসা ৩৫তম বিএসএস পাশ করা পপি জানান, এ সড়কে না আসলে আমি জানতাম না রাঙামাটি এ সুন্দর। এ সড়কে যদি বিদ্যুতের ব্যবস্থা ও পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা যায় তাহলে পর্যটন সম্ভবনার আরেকটি দ্বার উন্মোচিত হবে।

পপির বান্ধবী এনজিও কর্মী ইসরাত জাহান বলেন, যে কোন ঘটনা এড়াতে এ সড়কের পরিধি বাড়াতে হবে। এছাড়া প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে রাত্রী যাপনের জন্য কোন কটেজ নেই। যদি কয়েকটি কটেজ গড়ে তোলা যায় তাহলে এ জায়গা হবে সম্ভাবনাময়ী ট্যুরিস্ট এলাকা।

রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রোমান জানান, আঁকাবাকা রাস্তার সাথে কাপ্তাই হ্রদ মিলে মিশে একাকার। তিনি বলেন, আমি মালদ্বীপে গিয়েও এত সুন্দর জায়গা কম দেখেছি।

চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পারভেজ জানান, এ সড়কটির চারপাশ এত সুন্দর দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। এ এলাকা জুড়ে যদি উন্নত মানের প্যাডেল বোট, সাম্পান নামানো যায় তাহলে পর্যটকরা হ্রদ ভ্রমণ করতে পারবে। এছাড়া এ সড়কে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার এবং রাত্রী যাপনের জন্য কটেজ তৈরি করা যায় তাহলে এ এলাকায় পর্যটন শহর গড়ে উঠবে।

একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সৌরভ রক্ষিত জানান, এ সড়কে আরো কয়েকটি পর্যটন স্পট গড়ে তুলতে হবে সাথে বাড়াতে হবে নিরাপত্তা ব্যবস্থা।

পর্যটন বিশেষজ্ঞদের অভিমত এ সড়টিতে নিরাপত্তা জোরদার করে যদি নানা ধরণের ট্যুরিস্ট স্পট গড়ে তোলা যায় তাহলে এ জেলায় আরেকটি অদ্বিতীয় পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে উঠবে।

এছাড়া এ সড়কে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা, পর্যটকদের থাকার জন্য কটেজ তৈরি করতে হবে। তাহলে পর্যটকদের সমাগম আরো বাড়তে বলে তারা জানান।

বেড়াতে আসবেন যেভাবে:

ঢাকা-চট্টগ্রাম থেকে বাস যোগে এসে রাঙামাটি শহরে নামবেন। তারপর শহর এলাকা থেকে অটোরিক্সা কিংবা মাইক্রো ভাড়া করে চলে যেতে আসতে পারেন শহরের আাসামবস্তি সড়ক পাড়ি দিয়ে রাঙামাটি-কাপ্তাই অভিমূখী বিকল্প পথে। যারা নিজস্ব গাড়ি নিয়ে আসবেন তাদের তো কথা নেই, সোজা চলে যেতে পারেন।

এ বিষয়ে ওই এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা ও রাঙামাটি সদর উপজেলার চেয়ারম্যান অরুণ কান্তি চাকমা জানান, এ এলাকায় বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের মন্দির রয়েছে। আর এ মন্দিরে হাজার ভক্তদের সমাগম ঘটে। এছাড়া সরকারি যদি সুষ্ঠ পরিকল্পনার মাধ্যমে পর্যটন শিল্পের বিকাশে এ এলাকার উন্নয়ন ঘটায় তাহলে এ এলাকায় একদিকে যেমন শহরের ভিতর আরেক পর্যটন শহর গড়ে উঠবে তেমনি ধর্মীয় স্থানটিও সুরক্ষা থাকবে।
এ এলাকায় পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটলে স্থানীয় অধিবাসীদের ভাগ্যর চাকা ঘুরে যাবে বলে চেয়ারম্যান আশাবাদ ব্যক্ত করেন।