এ বছর এইচএসসিতে রাঙামাটি জেলার পাশের হার দেখে হতাশ হয়েছেন জেলার অভিভাবকমহল ও শিক্ষার্থীরা। ফলাফলের হতাশা আগামী দিনে পাহাড়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ঘোর অনানিষা ডেকে আনতে পারে বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা।
কারণ পাহাড়ের শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষাক্ষেত্রে পার্বত্য কোটা পাওয়ার যে সুবিধা রয়েছে, ওই সুবিধা গ্রহণের জন্য এসএসসি এবং এইচএসসি দু’টো পরীক্ষাই পাহাড় থেকে অংশ গ্রহণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু পাহাড়ের কি সরকারি কি বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানই শিক্ষার্থী বা অভিভাবকদের নির্ভরতা অর্জন করতে পারছে না। এতে আগামী দিনের শিক্ষার্থীদের মাঝে সিদ্ধাহিনতা মানসিক রোগ হয়ে দেখা দিতে পারে বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা।
রোববার প্রকাশিত ২০১৭ সালের এইচএসসি ফলাফলে দেখা যায় রাঙামাটি জেলার সার্বিক পাশের হার মাত্র ৪৪.৮৫%। জেলার ১৫টি কলেজ থেকে ৫,২৩৪ জন পরীক্ষার্থী পাশ করেছে। আর এর মধ্যে পুরো জেলায় জিপিএ-৫ পেয়েছে মাত্র ৪জন।
সবচেয়ে হতাশা দেখা দিয়েছে জেলার নারী শিক্ষার একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান রাঙামাটি সরকারি মহিলা কলেজের ফলাফলে। সরকারি বেতনে চলা এই কলেজে পাশের হার মাত্র ৩৪.২০%। যা সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাবলিক কলেজ থেকেও নিম্নমানের। এই কলেজ থেকে মোট ৭৭৯ জন পরীক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিলেও কৃতকার্য হয়েছে মাত্র ২৬৬ জন।
সরকারি মহিলা কলেজের এই ফলাফল পুরো জেলাবাসীকে লজ্জায় ফেলে দিয়েছে। ফলাফলের পূর্বেও এই কলেজ সম্পর্কে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অভিযোগের অন্ত ছিল না। অধ্যাপনার মত মহান পেশায় এসেও এই কলেজের শিক্ষকরা যে দায়িত্বহীনতা, নিজের ক্যারিয়ার সম্পর্কে স্বার্থপরতা এবং কর্তব্যের প্রতি অবহেলা দেখিয়ে চলেছেন তদন্তপূর্বক তার বিচার হওয়া উচিৎ বলে মনে করছে জেলার অভিজ্ঞ এবং অভিভাবকমহল।
এই কলেজের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা প্রশাসন এবং শিক্ষকদের দায়ী মনে করার পাশাপাশি এও জানিয়েছে সেশন জুড়েই এই কলেজে আইসিটি বিষয়ে শিক্ষক না থাকার কারণে শিক্ষার্থীরা বেশি খারাপ করেছে। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী নিজ উদ্যোগে চারজন শিক্ষক পাঠানোর আগ পর্যন্ত অন্ততঃ ৬/৭জন করে শিক্ষক ছিল না। কিন্তু কলেজে যাই শিক্ষক থাক না কেন কখনই ৩টি বা চারটি ক্লাসের বেশী পাঠদান হয় না বলে জানিয়েছে কলেজের একাধিক শিক্ষার্থী। কলেজ লাইব্রেরীটিও অকার্যকর অবস্থায় রয়েছে দীর্ঘদিন।
তবে হতাশার মাঝেও এবার আশা জাগিয়েছে লেকার্স পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ। এই প্রতিষ্ঠান এসএসসিতে বরাবরই সাফল্য দেখিয়ে এসেছে। সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখেই সদ্য শুরু করা এইচএসসিতেও চমকপ্রদ ফলাফল অর্জন করে সকলের ভালোবাসা কেড়ে নিয়েছে। প্রথমবারেই একজন জিপিএ-৫সহ এই কলেজে পাশের হার ৮৩%।
এবছর রাঙামাটি জেলায় সবচেয়ে কম পাশ করেছে বরকল রাগীব রাবেয়া কলেজ থেকে। এই কলেজে পাশের হার ২৫.৪৫ শতাংশ। এ দিকে রাঙামাটি সরকারি কলেজটিও তার শত বছরের ঐতিহ্যের প্রতি সুবিচার করতে পারেনি। এই কলেজের তিনটি বিভাগ থেকে মোট ১১৯৫ জন পরীক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাশ করে ৫৪৩জন। এই কলেজের পাশের হার ৪৫.৪৫%।
আর নানা সমস্যা বুকে নিয়ে ধুকে ধুকে এগিয়ে যাবার চেষ্টায় রত জেলা শহরের অপেক্ষাকৃত নবীন কলেজ ‘রাঙামাটি পাবলিক কলেজ থেকে পাশের হার এসেছে ৩৮.৩৮% এই কলেজ থেকে ১৪১ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাশ করেছে ৫৪ জন। তবে অকৃতকার্যদের বেশির ভাগই এর আগের বারও অকৃতকার্য ছিল। ‘ফেল মারারাই ফেল করেছে’, সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথমবার এদিক সেদিক থেকে কুড়িয়ে নেওয়া যে শিক্ষার্থীদের নিয়ে কলেজটি শুরু হয়েছিল, তাদের বেশিরভাগ গ্রামীণ এবং সহজ সরল শিক্ষার্থী। তাদের অনেকেরই মূল স্বপ্ন আসলে পাশ করা পর্যন্ত। ভালো ফলাফল অর্জন তাদের পক্ষে যেমন অসম্ভব সে বিষয়ে তাদের পরিকল্পনাও নেই। তাই নানা সমীকরণে এই কলেজের ফলাফল নিয়ে অভিভাবকদের মাঝে নেতিবাচক মনোভাবের চেয়ে আগামী দিনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সহানুভূতি এবং নতুন পরিকল্পনার উপর গুরুত্বারোপ করেছে ওয়াকিবহাল মহল।
এদিকে জেলার বাইরের কলেজগুলোর মধ্যেও তেমন আশা জাগানিয়া কোনো চিত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে লংগদু উপজেলার রাবেতা মডেল কলেজটিতে পাশের হার এসেছে ৬৭%। যা একটি উপজেলা পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বেশ ভালো। বরং সার্বিক ফলাফলে এই কলেজে জেলা সদরের চেয়ে ভালো করেছে। ২৭৯জন পরীক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাশ করেছে ১৮৭ জন। পাশের হার বিবেচনায় এই কলেজ জেলার মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে।
রাজস্থলী সরকারি কলেজ এবারই সরকারি হিসেবে প্রথম। এই কলেজের পাশের হারও হতাশাজনক। ২৩১জন পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেছে ৬৮ জন। পাশের হার ২৯.৪৫। অন্যদিকে উপজেলা কলেজের মধ্যে পুরনো কলেজ কাচালং কলেজ থেকে ৫৫১জনের মধ্যে পাশ করেছে ২৮৭ জন। পাশের হার ৫২% এই কলেজটিও এ বছর থেকে সরকারি করণ করা হয়েছে। সরকারি হওয়া উপজেলার কলেজগুলোর মধ্যে কাউখালী কলেজে পাশের হার ৩২.৪৫%, কর্ণফুলি কলেজে ৪৭.১৭% এবং নানিয়ারচর কলেজে ৩০.৪৫%।
সব মিলিয়ে আগামী দিনে রাঙামাটি জেলায় উচ্চ শিক্ষার পথ সুগম করতে কলেজগুলো নিয়ে নতুন পরিকল্পনা প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি বলে মত প্রকাশ করেছে অভিজ্ঞ মহল।