॥ রাঙামাটি রিপোর্ট ॥
সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ পেলেন রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা। বুধবার ( ৬ জুলাই) জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপন বলে এই নিয়োগাদেশ ঘোষণা করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের চুক্তি ও বৈদেশিক নিয়োগ শাখার উপ-সচিব অলিউল্লাহ জারি করেন। এর মধ্য দিয়ে রাঙামাটি জেলার কোনো বাসিন্দা প্রথমবারের মতো উন্নয়ন বোর্ড চেয়ারম্যানের পদে বসছেন। প্রায় অর্ধ শতাব্দীর ইতিহাসে এই পদে আর কখনও রাঙামাটির কোনো নেতা বা কর্মকর্তাকে এ পদে পদায়ন করা হয়নি।
সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর গুলোর সাথে যোগাযোগ করে জানা গেছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে নিখিল কুমার চাকমার নিয়োগ আদেশে প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষর হয় গত ১৩ ই জুন। সে সময় পার্বত্যমন্ত্রী বান্দরবান সফরে থাকায় পরবর্তী প্রক্রিয়াটি শেষ হয়নি। কিন্তু খবরটি রাঙ্গামাটিতে ছড়িয়ে পড়ে পরে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ সহ দলীয় বিভিন্ন সূত্র গুলো নিখিল কুমার চাকমা কে অভিনন্দন জানিয়ে রাঙ্গামাটি শহরে বেশ কয়েকটি তোরণ নির্মাণ করে। কিন্তু জটিলতার কারণে তাদের অভিনন্দন জানানোর অপেক্ষার অবসান হয় না এরপর পেরিয়ে গেছে প্রায় তিন সপ্তাহ। এর মধ্যেই বাজারে নানা রকম খবর ছড়িয়ে পড়ে। রাতারাতি তোরণগুলো রূপ পরিবর্তন করে। অবশেষে সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটল বুধবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জারি করা প্রজ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে। এবারেও উন্নয়ন বোর্ড চেয়ারম্যানকে সচিবের মর্যাদায় নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে। আর্থিক সুবিধা সহ সচিব পদমর্যাদার এ নিয়োগ আগামী দুই বছরের জন্য বলবৎ থাকবে বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে।
ইতোমধ্যে রাঙামাটিতে দলীয় কার্যালয়ের সামনেসহ বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি তোরণ নির্মাণ করে নিখিল কুমার চাকমাকে অভিনন্দন জানানোর প্রতীক্ষায় রয়েছে। দলীয় কিছু টানাপোড়ন থাকলেও নিখিল কুমার চাকমার উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগে বেশ উৎফুল্ল রাঙ্গামাটির মানুষ। ওয়াকিফহাল সূত্রগুলো দাবি করেছে, ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর দীপংকর তালুকদার মন্ত্রী পরিষদ থেকে বাদ পড়েন, এর পর থেকেই অনেকটা হতাশায় দিনাতিপাত করছিল রাঙামাটিবাসী। কারণ মন্ত্রী বান্দরবানে এবং বোর্ডের চেয়ারম্যান খাগড়াছড়িতে, উন্নয়নের মূল প্রতিষ্ঠানে রাঙামাটির কেউ না থাকার কারণেই ছিল এই হতাশা।
পরিসংখ্যান দাবি করছে, বর্তমান সরকারের তিন মেয়াদে পাহাড়ে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। যদিও উন্নয়নের সেই জোয়ার থেকে রাঙামাটিও বাদ যায়নি; তবে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে অন্য দুইজেলার উন্নয়ন কিছুটা বেশি হয়েছে বলেই জনশ্রুতি রয়েছে। এর মধ্যে পর্যটন খাতের নাম সবার আগে উচ্চারিত হয়। তাই উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে রাঙামাটির কোনো নেতা বসুক; দলীয় নেতা কর্মীদের মাঝে এমন বাসনা দীর্ঘদিনের।
আপাতত নাম প্রকাশ করতে না চাইলেও দলীয় একাধিক নেতার সাথে আলাপ করে জানা গেছে, তারা সকলেই আশাবাদী। দলীয় সূত্রমতে, নিখিল কুমার চাকমা একদজন সদালাপি এবং গণমুখি নেতা। সব সময় হাস্যোজ্জল থেকে ঠান্ডা মাথায় কাজ করেন তিনি। এমন একজন মানুষ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে বসলে পাহাড়ের উন্নয়নের গতি ধারায় কোনো ব্যত্যয় তো ঘটবেই না বরং সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত হবে। দলীয় বলয়ের বাইরে সাধারণ মানুষও এমনটাই মনে করছে, কারণ ২০১০ সাল থেকে ২০১৫ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত নিখিল কুমার চাকমা রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করেন। তার দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝে যেমন কোনো অভিযোগ ছিল না। তেমনি জনগণের বড় অংশ সন্তুষ্ট ছিল। পাঁচ সদস্যের সেই সংক্ষিপ্ত পরিষদে তিনি তার যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হন। এই সময় প্রশাসনের সাথে পরিষদের কোনো সম্পর্কের টানাপোরনও ছিল না। সাধরণ মানুষের ধারণা উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবেও তিনি যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হবেন।
প্রসঙ্গত, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড (সংশোধিত) আইন ২০১৪ এর ৬ (২) ধারা বলে উন্নয়ন বোর্ড চেয়ারম্যান নিয়োগের ক্ষমতা সরকারের হাতে ন্যাস্ত। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড পিছিয়ে পড়া তিন পার্বত্য জেলার উন্নয়নের লক্ষ্যে বিশেষভাবে গঠিত একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা। ১৯৭৬ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান জিয়াউর রহমান এক অর্ডিন্যান্স বলে এই প্রতিষ্ঠান চালু করেন। এর মাত্র দু’বছর আগে বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবদ্দশায় রাঙামাটি সফরে এলে পাহাড়ের মানুষের জন্য এ ধরণের একটি বিশেষ উন্নয়ন সংস্থা গঠনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। সামরিক সরকারের অর্ডিন্যান্স বলে বোর্ড গঠিত হলেও শুরুকে বোর্ডের চেয়ারম্যান করা হয় বিভাগীয় কমিশনারকে। এরপরে নির্বাচিত সরকারের সময়ও বিভাগীয় কমিশনাররাই দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৮২ সালে পুণরায় সামরিক সরকার ক্ষমতায় বসার পর ১৯৮৩ সাল থেকে চেয়ারম্যান এর দায়িত্ব চলে যায় সেনাবাহিনীর হাতে। ১৯৮৩ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত মোট ৮জন জেনারেল চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর চুক্তির আলোকে চেয়ারম্যান পদে প্রথম বেসামরিক নেতার পদায়ন ঘটে। চুক্তি স্বাক্ষরকারী তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার বান্দরবান থেকে নির্বাচিত এমপি বীর বাহাদুরকে উপমন্ত্রীর মর্যদায় এই পদে নিয়োগ দেয়। ২০০১ সালের নির্বাচনে ক্ষমতার পট পরিবর্তন হলে বিএনপি সরকারও একই ধারাবাহিকতায় খাগড়াছড়ি থেকে নির্বাচিত এমপি আব্দুল অদুদ ভুঁইয়াকে চেয়ারম্যান নিয়োগ করে।
আবার ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে পুণরায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বীর বাহাদুর এমপিকে আবারও চেয়ারম্যান হিসেবে পদায়ন করে, তবে এবার দেয়া হয় প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা । ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর তিনি পার্বত্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর সেই সময়ে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ে সচিবে দায়িত্বে থাকা সরকারের প্রভাবশালী আমলা নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরাকে এই পদের দায়িত্ব প্রদান করা হয়।
ইতোমধ্যে ২০১৪ সালে ১৯৭৬ সালের অর্ডিন্যান্স রহিত করে আইনটি সংশোধন করে সরকার। ২০১৪ সালের ৮ জুলাই নতুন আইনের প্রজ্ঞাপন জারি করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার। পরে চাকুরি থেকে অবসরে যাওয়ার পর চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা সচিব পূর্ণ চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান। তবে তাকে দেওয়া হয় সিনিয়র সচিবের মর্যাদা। পরপর দুবার তার চেয়ারম্যান পদের মেয়াদ বৃদ্ধির সুযোগ পান এই সাবেক আমলা ও সরকারের আস্থাভাজন কর্মকর্তা এনবিকে ত্রিপুরা।
মেধাবী কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত এই চেয়ারম্যান উন্নয়ন বোর্ডে বেশ কিছু ইনোভেটিভ উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং সুধীজনের প্রশংসা অর্জন করেন। নিখিল কুমার চাকমা নির্বাচিত কোনো প্রতিনিধি নন তবে সরকার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে এর আগেও তিনি সফলভাবে দায়িত্ব পালন করেন। তা ছাড়া চেয়ারম্যান হিসেবে যে কাউকে নিয়োগ প্রদানের এখতিয়ার আছে সরকারের। শুধু এ ক্ষেত্রে একজন উপজাতীয়কে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা আছে আইনে। আইন অনুযায়ী একজন চেয়ারম্যান একজন ভাইস চেয়ারম্যান ও চারজন সদস্য নিয়ে উন্নয়ন বোর্ড গঠিত হয়ে থাকে। এই ছয় জনকেই সরকার নিয়োগ প্রদান করবে। এর অতিরিক্ত ১৪ সদস্যের একটি পরিচালনা বোর্ড রয়েছে। পরিচালনা বোর্ডে এই ছয়জনের বাইরে বাকি আটজন সদস্যই বিভিন্ন পদাধিকার বলে যুক্ত-বিযুক্ত হয়ে থাকেন।
রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগে দীঘদিন সহ সভাপতি হিসেবে দায়িত্বে থাকা জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝেও বেশ জনপ্রিয়। তবে তার ব্যপারে সমালোচনা রয়েছে তিনি সবার সাথে সদ্ভাব রাখায় বিশ্বাসী। এই কারণে আগামী দিনে আধা গণমুখি প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন বোর্ড তার স্বতন্ত্র বৈশিষ্টের ধারাবাহিকতা কতটা বজায় রাখতে সক্ষম হয় তা হয়তো সময়ই বলে দিবে।