সমাজ উন্নয়নে অবদান রেখে জয়িতা পুরস্কার পেলেন সুফিয়া কামাল ঝিমি

244

॥ স্টাফ রিপোর্টার ॥

শুধু ব্যক্তি বা পরিবার নয়, পরিবার জয় করে যিনি জয় করে নিয়েছেন সমাজ; তিনিই জয়িতা। ‘একজন সংগ্রামী অপ্রতিরোধ্য নারীর প্রতীকী নাম জয়িতা’। নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের মূর্ত প্রতীক জয়িতা। এ বছর বেগম রোকেয় দিবসে রাঙামাটি জেলায় জয়িতা পরস্কারে ভূষিত হয়েছেন দৈনিক রাঙামাটির ব্যবস্থাপনা সম্পাদক বেগম সুফিয়া কামাল ঝিমি। একজন নারী হয়েও সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখার স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলাদেশ সরকারের মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর তাকে এই স্বীকৃতি দেয়।

গত ৯ ডিসেম্বর রাঙামাটি জেলাপ্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে এক অনাঢ়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বেগম সুফিয়া কামাল ঝিমিসহ মোট পাঁচজন জয়িতার হাতে সম্মাননা তুলে দেন জেলাপ্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমানসহ অন্যান্য অতিথিরা।

আমাদের সমাজে একটি কথা প্রচলিত আছে ‘যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে। কিন্তু এই কথাটি এখন আর ধোপে টিকেনা, কারণ নারীরা এখন আর শুধু রান্না-বান্না আর সংসার ধর্ম পালনের মধ্যেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেননি। আটপৌড়ে জীবনের গন্ডি ডিঙ্গিয়ে নিজেদের দক্ষতা, যোগ্যতা এবং অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে নারীরা পৌঁছে গেছেন সর্বোচ্চ শেখরে।

বেগম সুফিয়া কামাল ঝিমি তেমনি একজন জয়িতার নাম। যিনি নিজের অদম্য ইচ্ছাকে সম্বল করে চরম প্রতিকূলতাকে জয়ের মাধ্যমে তৃণমূল থেকে গুটি গটি পায়ে সমাজের প্রায় সকল ক্ষেত্রে নিজের জন্য অনন্য সব জায়গা তৈরি করে নিয়েছেন। সমাজের প্রায় সকল ক্ষেত্রে তার অনবদ্য বিচরণ, আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার সরব উপস্থিতি কেড়ে নিয়েছে সহস্র মানুষের প্রাণ। তার সহ¯্র ভক্ত তাই এই জয়িতার স্বীকৃতিতে কেবল আনন্দে উদ্বেলই নন, তাকে অভিনন্দনের বন্যায় ভাসিয়ে চলেছেন প্রতিনিয়ত। ফেসবুকের ওয়ালে ওয়ালে তার স্তুতি এবার অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে তাকে।

কোথাও আগুন লেগে ঘরপোড়া মানুষ যখন নিজেদের অসহায় ভাবতে শুরু করেন, তখনই সেখানে ছুটে যান সবার প্রিয় ঝিমি আপা। অসহায় মানুষকে যতটুকু পারেন সহায়তা করেন, তাকে মানসিকভাবে উজ্জীবীত করে আবার দাঁড়াবার প্রেরণা যোগান। শুধু আগুনে পোড়া নয়, শীতার্ত মানুষ প্রতি বছর যার হাত থেকে উষ্ণ বস্ত্রের যোগান পায়; এমন এক নারীর নাম ঝিমি। তেমনি মানবাধিকার সংগঠন, তরুণদের সামাজিক সংগঠন, নারীদের ব্যবসায়িক এবং স্বাবলম্বী হওয়ার উদ্যোগ, কিংবা সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা সামগ্রী সঙ্কট দূর করতে যে মানুষটি চষে ফিরে পার্বত্য শহর রাঙামাটির এ প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত; তিনিই হলেন বেগম সুফিয়া কামাল ঝিমি।

পাহাড়ের সাহিত্যাঙ্গনেও তার খ্যাতির কমতি নেই। তিনি নিজে লেখালেখি ও কাব্য চর্চার পাশাপাশি গড়ে তুলেছেন বেশ কয়েকটি সাহিত্য ও কবিতা চর্চার সংগঠন। রাঙামাটিতে কবিতা চর্চার আসরে যেন ঝিমি কামাল উপস্থিত না হলে আসরটিই জমে না।

বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতি রাঙামাটি জেলা শাখার নির্বাচিত সহ সভাপতির দায়িত্ব পালনে রত ঝিমি, নারী জাগরণ এবং পরিবার কল্যাণ সেবার বিস্তারে অসামান্য অবদান রাখায় তাকে পরপর দুইবার প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত করেছেন ভোটাররা। আসন্ন নির্বাচনে এবার তিনি নিজে থেকেই এই পদটি ছেড়ে দিয়ে অন্য পদে যাবেন বলে শোনা গেছে।

প্রসঙ্গত, সরকারের মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর ২০১৪ সাল থেকে সারাদেশে জয়িতাদের খুঁজে বের করার উদ্যোগ নেয়। উদ্যোগটির নাম ‘জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ’। জয়িতাদের পাঁচটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছেঃ ১. অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী; ২. শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী; ৩. সফল জননী নারী; ৪. নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন যে নারী; ৫. সমাজ উন্নয়নে অবদান রেখেছেন যে নারী। পর্যায়ক্রমে ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা ও বিভাগভিত্তিক জয়িতা বাছাই কাজটি পরিচালিত হয়। স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তা ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বাছাইয়ের কাজে সম্পৃক্ত থাকেন।
বাংলাদেশের রক্ষণশীল সমাজ একসময় মনে করতো নারীরা সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশ। কিন্তু সমাজের অর্ধেক অংশ নারীদের পিছনে ফেলে সমাজকে উন্নতির সোপানে নিয়ে যাওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এই ধারণা থেকেই বর্তমান সরকার নারী উন্নয়নে নানামুখি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সরকারের এসব পদক্ষেপ যাদের হাত ধরে তরতর করে এগিয়ে চলেছে। নারীদের পৌঁছে দিয়েছে অনন্য উচ্চতায়- তারাই হলো জয়িতা। আর হার না মানা সাহসিকতার মূল সুর যেন একই সুতায় গাঁথা। সশ্রদ্ধ সালাম জয়িতাদের। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, বেগম রোকেয়া আর প্রীতিলতাদের স্মৃতিধন্য বাঙালি নারীরা কালের বিবর্তনে ধৈর্য, সাহস, পরিশ্রম ও শক্তির প্রতীক হয়ে উঠেছেন, সুফিয়া কামাল ঝিমি তেমনি এক অনন্য নাম। জীবনযুদ্ধে স্রোতের প্রতিকূলে চলার কঠিনতম লড়াইয়ে তিনি আজ বিজয়ী। জয়তু জয়িতা।
আমরা বিশ্বাস করি এই জয়িতাদের অনুপ্রেরণামূলক সাফল্যগাথা আরও অনেক নারীকেই অনুপ্রাণিত করবে। হাজারো নারীর মনে হাঁটি হাঁটি পা পা করে উঁকি দেওয়া স্বপ্নগুলো পাখা মেলবে আকাশে; তৈরি হবে লাখো জয়িতা। লাখো জয়িতার মিছিলে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে। এই সফল নারীদের অপরাজেয় রূপ দেখে সমগ্র সমাজ নারী বান্ধব হবে এবং এতে করে সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণও ত্বরান্বিত হবে।
দৈনিক রাঙামাটির ব্যবস্থাপনা সম্পাদক এবং নারী ও সাহিত্য বিষয়ক পাতার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক এবং উদ্যোক্তা সুফিয়া কামাল ঝিমি বরাবরই নারী উদ্যোক্তাদের একান্ত সহচরি হিসেবে রাঙামাটিতে ইতোমধ্যেই বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন। তিনি এফপিএবি’র সহ সভাপতি, জেলা প্রশাসক গঠিত করোনা রেসপন্স টিমের সদস্যা, জেলা প্রশাসনের দূর্যোগ মোকাবেলা কমিটির সদস্যা, আলোর ফুল নামক তরুণ সামাজিক সংগঠনের উপদেষ্টা, ওয়ার্ল্ড পিচ হিউম্যান রাইটস সোসাইটি এর সহ সভাপতি, এশিয়া ছিন্নমূল মানবাধিকার বাস্তবায়ন ফাউন্ডেশন এর সহ সভাপতি, রাঙামাটি কবিতা মঞ্চ এর প্রধান উপদেষ্টা, স্বপ্নযাত্রী ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা, ইয়ুথ নামক তরুণদের সামাজিক সংগঠনের উপদেষ্টা, স্যালভেশন এর উপদেষ্টা, খেলাঘর এর সাবেক সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক, নুতন কুঁড়ি এর সদস্যা, হিল সার্ভিস এর প্রতিষ্টাতা সভাপতি, এ্যপেক্স ক্লাব এর সবলং গ্রুপের সভাপতি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের রাঙামাটি শাখার সাবেক দপ্তর সম্পাদক, রেড ক্রিসেট এর আজীবন সদস্যা/ সাবেক ভলান্টিয়ার, রাঙামাটি ব্লাড ব্যাংক এর সদস্যা, সন্ধানী’র আজীবন সদস্যা। এমনি আরো অনেক সংগঠনের সাথে তিনি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষাভাবে কাজ করে চলেছেন নিরলসভাবে।
একান্ত আলাপচারিতায় বেগম সুফিয়া কামাল ঝিমি জানান, তার লক্ষ্য এখানেই স্থির নয় তার। দৃঢ়তা, কর্মদক্ষতা, সৃজনশীলতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে আজীবন সামিজিত দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি প্রতিবন্ধী ও সুবিধাবঞ্চিতদের পাশে দাঁড়াতে চান এই কীর্তিমান জয়িতা। জয়তু জয়িতা।
“সবার মাঝে ঐক্য গড়ি, নারী ও শিশু নির্যাতন বন্ধ করি” প্রতিপাদ্যে গত ৯ ডিসেম্বর রাঙামাটিতে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ও বেগম রোকেয়া দিবস পালিত হয়। দিবসটি ঘিরে সকালে জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উদ্যোগে ও জেলা প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। বক্তব্যে রাখেন, পুলিশ সুপার মীর আবু তৌহিদ বিপিএম (বার), সনাক সভাপতি নিরুপা দেওয়ান, প্রেসক্লাব সভাপতি শাখাওয়াত হোসেন রুবেল, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপ-পরিচালক হোসনে আরা বেগম, জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কানিজ জান্নাত, জেলা পরিষদ সদস্য ঝর্ণা খীসা। এসময় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) সাইফুল ইসলাম, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এস. এম. ফেরদৌস ইসলাম সহ সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সভা শেষে সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখায় সুফিয়া কামাল ঝিমি, অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী হিসেবে সামেত্রী চাকমা, শিক্ষা ও চাকুরীর ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনে সেলিনা আক্তার রিপা, সফল জননী হিসাবে চন্দ্রা চাকমা, নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যেমে জীবন শুরু করায় ঝর্ণা খীসাকে শ্রেষ্ঠ জয়িতার সম্মাননা প্রদান করা হয়।