সম্ভাবনা অপার কিন্তু অগ্রগতি নেই রাঙামাটির ট্যুরিজমে

104

সবুজ-শ্যামল প্রকৃতি ঘেরা রাঙামাটি পর্যটকদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। হীমবাহের আগমনী জানিয়ে বিদায় নিচ্ছে হেমন্ত, বাতাস এখন ঈষদুষ্ণ। বেড়ানোর জন্য এটাই উপযুক্ত সময়। বাচ্চাদের পরীক্ষাও শেষ হচ্ছে। এদিকে প্রকৃতি সাজছে নতুন সাজে।

সারাদিনের কর্মব্যস্ততার মাঝেও মানুষ প্রকৃতির কোলে হারিয়ে গিয়ে একটুখানি প্রাণভরে শ্বাস নিতে চায়। কিছুক্ষণের জন্য কাজের কথা ভুলে স্বস্তির নিশ্বাস নিতে চায়। তা ছাড়া যন্ত্রদানবের মতো সারাক্ষণ কাজ করাটা বিজ্ঞান সম্মতও নয়। নিজের যেমন রিলাক্স প্রয়োজন, তেমনি পরিবারের সদস্যদের সাথে নিয়ে একটু ঘুরে আসা; তাদের জন্য কিছুটা সময় একান্তভাবে ব্যয় করা সুখী সংসারের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে প্রকৃতির রাণী রাঙামাটি প্রায় সকলেরই প্রথম পছন্দের তালিকায় থাকে। হ্রদ-পাহাড়ের মিতালী ঘেরা রাঙামাটিতে একই সাথে প্রকৃতির সোঁদা গন্ধ, পাখির কলকাকলী এবং সাগর বেলার পরিবেশ পাওয়া যায়। ‘পলওয়েল ন্যাচারাল পার্ক’ এর কাঠের তাকিয়াগুলোতে শুয়ে বা হেলান দিয়ে ছবি তুললে মনে হবে আপনি কোনো সমুদ্র সৈকতে ছবি তুলেছেন। চাইলে সাধারণ ইঞ্জিন চালিত নৌকা বা স্পীড বোটে করে খানিকটা ঘুরেও আসতে পারেন। তাতে সবাই মিলে বাড়তি এক প্রাকৃতিক অনভূতি পাবেন।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে অপরূপ লীলা নিকেতন পার্বত্য রাঙামাটি। লীলাময়ী প্রকৃতি যেন আপন হাতে সাজিয়েছেন এর রূপ মাধুরী। সবুজ চাদর পরে দাঁড়িয়ে থাকা নিশ্চল পাহাড়, পাহাড়ের পাদদেশে কুল কুল নাদে বয়ে চলা প্রাকৃতিক ছড়া, সর্পিল এঁকে বেঁকে দূর পাহাড়ের বাঁকে হারিয়ে যাওয়া মেঠোপথ, পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা ঝর্ণার স্বচ্ছ জল, কর্ণফুলীর ¯্রােত, কাপ্তাই হ্রদের শান্তজলে ¯্রােতহীন ছোট ছোট ঢেউ। পাহাড়ের কঠিন বুকে ঘাম ঝরিয়ে গড়ে তোলা গ্রাম্য নারীর স্বাদের জুম। জুম ক্ষেত্রের বিচিত্র সব্জি বাগান, আর রবিশস্যে সোনালী দোল। ফাঁকে ফাঁকে গড়ে ওঠা প্রাকৃতিক ও সৃজিত বন বাগান। বুনো ফুলের মন মাতানো সৌরভ, অতিথি পাখির কিচির-মিচির ডাক, বানর ডাহুক আর হরিণের দুর্লভ মিতালী এমন বর্ণনাতীত বিচিত্র সৌন্দর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের পার্বত্য রাঙামাটি। তাইতো কবি সাহিত্যকরা আদর করে এর নাম রেখেছে প্রকৃতির রাণী।

দেশ বিদেশ থেকে প্রতিনিয়ত হাজারো প্রকৃতি প্রেমি এই সবুজাভ বৃষ্টি¯œাত পাহাড় আর পাহাড় সন্নিহিত অর্বাচিন রূপমাধুরী অবলোকন করতে ছুটে আসেন এক অমোঘ সুতোর টানে। আবহমান বাংলার সর্বাঙ্গজুড়েই সবুজের সমারোহ সারা বিশ্বে এক আলোচিত অনুসঙ্গ, তার মাঝেই পার্বত্য রাঙামাটিসহ তিন পার্বত্য জেলা যেন প্রস্ফুটিত রংধনু। যারা এর সৌন্দর্য সুধা পান করে একবার চমৎকৃত হয়েছেন, তিনি বার বার ছুটে আসতে বাধ্য হন এই প্রকৃতির কোলে। ছবির মতো সবুজে ঘেরা পাহাড় আর কাপ্তাই হ্রদের বিশাল স্থির নীল পানি রাশি রাঙামাটিকে বাংলার সৌন্দর্য্যরে স্বর্গে পরিণত করেছে। নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যের অপার আঁধার পার্বত্য জেলা রাঙামাটি। তাই পার্বত্য শহর রাঙামাটি পর্যটকদের কাছে অতি প্রিয় একটি নাম।

বর্তমান সময়ের গতিময় জীবন প্রবাহে কাজের অবসরে যারা প্রতিনিয়ত খুঁজে ফেরেন রোমাঞ্চকর এমন কোনো স্থান যেখানে রয়েছে প্রাকৃতিক নৈসর্গে ঘেরা সবুজ পাহাড় আর নীল আকাশে মেঘের মিতালি! তাদের মন থেকে রাঙামাটি কখনই মুছে যায় না। সবুজ-শ্যামল চোখ জুড়ানো প্রাকৃতিক দৃশ্য সম্বলিত এই অপরূপ রাঙামাটিতে যাদের আসার সুযোগ হয়নি, তারা হয়তো বাংলাদেশের প্রকৃত সৌন্দর্য কখনই চিত্রিত করতে পারবেন না। লীলাময়ী প্রকৃতি যেন আপন হাতে এ অঞ্চলে তার সৌন্দর্য সুধা ঢেলে দিয়েছেন। এখানকার দিগন্ত বিস্তৃত বনরাজির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে ভাবুক মন খেই হারিয়ে ফেলে- ‘সবুজের কত রং হতে পারে’। হালকা সবুজ, গাঢ় সবুজ, ফিকে সবুজ, শ্যামল সবুজ.. এভাবে নামকরণ করতে বলা হলে হয়তো কারো পক্ষেই এই সবুজের বিশেষণ নির্ধারণ করা সম্ভব হবে না। সবুজের শেষ প্রান্তে মেঘ বালিকার মিতালি, উঁচু-নিচু, আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ, আর তুলির আঁচড়ের মতো মাঝে মাঝে সবুজের বুক চিরে বয়ে যাওয়া কাচালং নদী আর পাহাড়ি ছড়া, যে কোনো নিরস মনকেও ভাবুক আর উদাস বানিয়ে দেয়; কিছুক্ষণের জন্য হলেও। নগর জীবনের আয়েসী জীবন যাপনে অভ্যস্ত আক্ষরিক অর্থে সভ্য মানুষ এই রূপ ভুলতেই পারেন না। এই শহরের প্রবেশদ্বারে রয়েছে সাপছড়ির ফুরোমোন পাহাড়, আর শেষ প্রান্তে ডিসি বাংলো।

প্রকৃতির রাণী রাঙামাটিতে ভ্রমণ করার জন্য বর্তমানে যে সব দর্শনীয় স্থান রয়েছে, এর মধ্যে সুখী নীলগঞ্জ এবং ফুরমোন অনতম আকর্ষণীয়। এ ছাড়া কাপ্তাই হ্রদ, পর্যটন মোটেল, ডিসি বাংলো, ঝুলন্ত ব্রিজ, সাজেক, পেদা টিংটিং, সুবলং ঝর্ণা, রাজবাড়ি, রাজবন বিহার, উপজাতীয় জাদুঘর, কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ প্রকল্প, কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

কিন্তু পার্বত্য শহর রাঙামাটি পর্যটকদের কাছে অতি প্রিয় একটি নাম হলেও রাঙামাটি শহরকে এখনো পর্যন্ত পর্যটকদের জন্য খুব বেশি একটা আকর্ষনীয় করে গড়ে তোলা যায়নি। বিগত কয়েক দশকেও এই অঞ্চলে পর্যটকদের জন্য সরকারিভাবে গড়ে উঠেনি পর্যটন সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো। সম্ভাবনা থাকার পরও রাঙামাটির পর্যটন খাতের উন্নয়ন হয়নি। ফলে আগ্রহ হারাচ্ছে পর্যটকরা। স্থানীয়দের অভিযোগ, সরকারের উদ্যোগ পরিকল্পনার বৃত্তে আটকে থাকায় কাঙ্খিত উন্নয়ন হচ্ছে না।

১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধ তৈরির পর হ্রদকে ঘিরে পর্যটন এলাকা গড়ে তোলার পরিকল্পনা ছিল সরকারের। ১৯৮৩ সালে দুই পাহাড়ের মাঝখানে ঝুলন্ত সেতু তৈরি করে যাত্রা শুরু করে পর্যটন করপোরেশন। মাঝে সেখানে সামান্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও এরপর পর্যটন শিল্প বিকাশে সরকারিভাবে আর কোনও উদ্যোগ দেখা যায়নি। সেনাবাহিনী ও পুলিশ সাংগঠনিকভাবে আরণ্যক, পলওয়েল, সাজেক ভ্যালির মতো কিছু উদ্যোগ নিলেও এ জেলায় সম্ভাবনার তুলনায় তা নিতান্তই কম। অবকাঠামো উন্নয়ন তেমন একটা নেই বললেই চলে, নতুন পর্যটন স্পট তৈরির কোনো উদ্যোগ নেই।

আসন্ন পর্যটন মৌসুমে রাঙামাটিতে প্রবেশ ঘটবে কয়েক লাখ পর্যটকের। কিন্তু রাঙামাটিতে একদিন অবস্থানের পর পর্যটকদের সময় কাটানো বা বিনোদন পাওয়ার জন্য তেমন কেনো ব্যবস্থা নেই। পর্যটকদের সার্বিক সুযোগ সুবিধা নিশ্চিতকরণসহ রাঙামাটির পর্যটন খাতকে আরো সম্মৃদ্ধশীল করার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দা ও ট্যুরিজম ব্যবসার সাথে জড়িতরা। তাদের মতে হ্রদ ও পাহাড়ের মনোরম প্রকৃতি কাজে লাগিয়ে রাঙামাটিতে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা সম্ভব। কিন্তু তা হচ্ছে না। বিদেশী পর্যটকদের প্রবেশের ক্ষেত্রে রয়েছে নানা সীমাবদ্ধতা।

এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করে স্থানীয় জনগোষ্ঠির শিক্ষিত বেকারদের পর্যটন খাতের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত করতে পারলে রাঙামাটির পর্যটন খাতের চিত্রই পাল্টে যাবে, এখানকার মানুষের জীবনমানেও আমূল পরিবর্তন আসবে বলে মনে করছে পর্যবেক্ষক মহল। পার্বত্য এই জেলার পর্যটন শিল্প বিকাশে দ্রুত দৃশ্যমান উদ্যোগ নেবে সরকার এমনটাই প্রত্যাশা সকলের।