॥ আনোয়ার আল হক ॥
আইনের বেড়াজালে বাধা পড়ে বেকার হয়ে পড়ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের ঠিকাদারেরা। সরকারি ক্রয় কমিটির এক চোখা নীতি এবং দুই শ’ বছরের পুরণো পার্বত্য শাসনবিধির বৈষম্য নীতির কারণে পাহাড়ের বাঙালি ঠিকাদাররা এখন অনেকটা বেকার জীবন যাপন করছে। পুঁজি ভেঙ্গে খেতে খেতে ঋণের ভারে ভারানত হচ্ছে অনেকেই। কেউবা অন্য পেশা বেছে নিয়ে জীবীকা নির্বাহের চেষ্টা চালাচ্ছে। এতে নষ্ট হচ্ছে স্থানীয় অর্থনীতির ভারসাম্য।
ঠিকাদারিতে ‘টার্ন ওভার’ শব্দটিকে অভিশাপ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন স্থানীয় ঠিকাদারেরা। পক্ষান্তরে পার্বত্য তিন জেলায় উপজাতীয় ঠিকাদারদের জন্য আয়কর মওকুফ থাকলেও একই এলাকায় বসবাস করা বাঙালি ঠিকাদারেরা আয়কর দিয়ে কাজ করার কারণে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়ছে। এতে বাঙালি ঠিকাদারেরা প্রতিযোগীতায় যেমন পিছিয়ে পড়ছে, তেমনি ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে উপজাতীয় ঠিকাদারদের লাইসেন্স ধার নিয়ে কাজ করার কারণে আবার নিজের প্রতিষ্ঠানের টার্নওভার হারিয়ে ফেলছে। এই উভয় সঙ্কটে এখন দিশেহারা এ এলাকার বাঙালি ঠিকাদারেরা। পাশাপাশি পাহাড়ে চাঁদাবাজির বিষয়টি তো মরার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে রয়েছেই। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাহাড়ের চাঁদাবাজিতে একাধিক গ্রুপের দাবি মেটাতে গিয়ে প্রত্যন্ত এলাকার উন্নয়ন কাজগুলো থেকে নিরবে সরে দাঁড়াচ্ছে বাঙালি ঠিকাদাররা। কারণ তিন বা চার গ্রুপকে চাঁদা দেওয়া, বড় ঠিকাদারের বখরা পরিশোধ করা এবং অফিস খরচ মেটানোর পর মুনাফার পরিমান একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে ঠেকেছে বর্তমান সময়ে, এতে দিন দিন বেকার ও নিঃস্ব হচ্ছেন তারা। বিষয়গুলো মাথায় নিয়ে নেতৃবৃন্দ, সরকার এবং কর্মকর্তারা এখনি সক্রিয় পদক্ষেপ না নিলে পাহাড়ের অর্থনীতিতে বড় ধরণের ধস নামতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ঠিকাদারেরা।
তিন পার্বত্য জেলার অর্ধশতাধিক ঠিাকাদার জানান, বর্তমানে ঠেকাদারী কাজে যুক্ত বেশির ভাগ যুবকই উচ্চ শিক্ষিত, তারা চাকুরীর উপর চাপ কমাতে স্বাধীন পেশা হিসেবে ঠিকাদারী বেছে নিয়েছিলেন। এই ব্যবসায় সময় দিয়ে চাকুরীর বয়স শেষ হয়ে যাওয়ায় এখন তারা বিপাকে। পার্বত্য তিন জেলার অর্থপ্রবাহকে কৃষি নির্ভর হিসেবে আখ্যায়িত করা হলেও এ এলাকায় রপ্তানী নির্ভর কৃষির পরিমাণ আসলে সীমিত; নেই তেমন কোনো শিল্প কারখানা। মূলত: গাছ, বাঁশ এবং মাছের ব্যবসার পরিধিটাই একটু বড়। এর বাইরে বড় ব্যবসা হিসেবে ধরা হতো ঠিকাদারিকে। সেই ঠিকাদারী এখন অনিশ্চয়তায় পড়ায় উঠতি যুবকেরা হতাশ হয়ে পড়ছে।
‘টার্ন ওভার’ সমস্যাটি যদিও পাহাড়ের কোনো স্বাতন্ত্র সমস্যা নয়, এই সমস্যা দেশব্যপী একই রকম। তবে পাহাড়ের ঠিকাদারদের মত হলো, যেহেতু পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিশেষ অঞ্চল বিবেচনায় অনেক কিছুর ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড়ের উদাহারণ রয়েছে। ঠিকাদারী কাজের ক্ষেত্রেও টার্ন ওভার সমস্যাটিকে পাহাড়ের জন্য বিশেষ দৃষ্টিতে বিবেচনা করা সময়ের দাবি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমান ই টেন্ডারিং পদ্ধতিতে একজন ঠিকাদারের বার্ষিক লেনদেন বা কাজের মূল্যমানকে প্রচলিত ভাষায় ‘টার্নওভার’ বলা হয়ে থাকে। কোনো কাজের ঠিকাদার নির্বাচনের জন্য টার্ন ওভারকে মূখ্য হিসেবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে (যদিও আরো ৭টি সূচক রয়েছে)। ওপেন টেন্ডার ম্যাথডে (ওটিএম) একটি কাজ সকল শ্রেণির ঠেকাদারের জন্য উন্মুক্ত থাকায় ‘টার্ন ওভার’ দেখিয়ে বাইরের বড় বড় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ই-টেন্ডারের মাধ্যমে জেলার কাজ বাগিয়ে নিচ্ছেন। স্থানীয় ঠিকাদাররা সেখানে গণায় পড়ছে না।
কাজ না পাওয়ায় ছোট ও মাঝারি ঠিকাদারদের অভিজ্ঞতা যেমন বাড়ছে না, তেমনি বার্ষিক লেনদেনেও (টার্নওভার) উন্নতি হচ্ছে না। এতে দিন দিন বেকার ও নিঃস্ব হচ্ছেন তারা। কেউ কেউ অন্য কোনো আয়ের উৎস না পেয়ে হতাশায় ভুগছেন। স্থানীয় এবং প্রান্তিক শ্রেণির ঠিকাদাররা দিশেহারা হয়ে কর্মকর্তাদের টেবিলে টেবিলে ঘুরছেন এলটিএম এর আশায়।
এ বিষয়ে বাঙালি ঠিকাদার কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজি মোঃ শাহ আলম দৈনিক রাঙামাটিকে জানান, টার্ন ওভারের বিষয়টি সারাদেশের সমস্যা হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে একে বিশেষ দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ ছিল। কিন্তু আমাদের আহাজারি সম্ভবত সঠিক জায়গায় পৌঁছছে না। তিনি বলেন, আয় করের বিষয়ে যে বৈষিম্য নীতি তা দুইশ’ বছরের পুরনো। বিশেষ অঞ্চল হিসেবে এ আইন যদি থাকতে পারে, টার্ন ওভারের ক্ষেত্রে কেন তা নেই।
রাঙামাটি জেলার প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার ও সালেহা এন্টারপ্রাইজের স্বত্ত্বাধিকারী মোঃ জাহাঙ্গীর কামাল বলেন, সরকারির টার্নওভারের সিদ্ধান্তটি জনবান্ধব হয়নি। এতে বড়লোক আরো বড় হচ্ছে আর গরীবরা চলে যাচ্ছে প্রান্তিক পর্যায়ে। সরকারের নিয়মের কারণেই ছোট ছোট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মূলত বেকার হয়ে পড়ছে। সরকারের ই-টেন্ডার আইনে বড় কাজের জন্য দরপত্র দাখিলের সময় যোগ্যতা প্রমাণে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার সনদ চাওয়া হচ্ছে, অথচ ছোট ঠিকাদারদের পক্ষে বিপুল পরিমাণের টাকার কাজের জন্য যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা সনদ প্রদান করা সম্ভব হয় না।
বিভিন্ন দপ্তরে সংক্ষিপ্ত কথা বলে জানা গেছে, তিন পার্বত্য জেলায় বিভিন্ন বিভাগের আওতায় বর্তমানে অন্তত দুই হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প চলমান রয়েছে, যা বিভিন্ন সময়ে অনুমোদিত ও শুরু হওয়া। এর বেশির ভাগ কাজেরই মূল ঠিকাদার বাইরের। স্থানীয় ঠিকাদারেরা তাদের বখরা দিয়ে নাম মাত্র লাভে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাঙামাটি সড়ক ও জনপথ বিভাগ তথা সড়ক বিভাগের আওতায় বর্তমানে অন্তত: ২৬০ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ চলমান রয়েছে। এর মধ্যে স্থানীয় ঠিকাদারের নামে মাত্র একটি কাজ রয়েছে; তাও আবার বড় ঠিকাদারের সাথে অংশিদারির ভিত্তিতে।
প্রসঙ্গত, সরকারি ক্রয় নীতি উন্নত করণের আওতায় ২০০৬ সালে পিপিএ-২০০৬ প্রণয়ন করা হয়। পরে ২০০৮ সালে পাবলিক প্রক্রিয়রমেন্ট রুলস ২০০৮ নামে একটি নতুন আইন করা হয়। বর্তমানে চলমান ইজিপি সিস্টেমের টেন্ডার পদ্ধতি এই আইনের নির্দেশনা অনুযায়ী চলছে। সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট (সিপিটিইউ) নামে একটি জাতীয় পর্যায়ের কমিটি এ প্রক্রিয়ার মূল ধারক।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাঙামাটি সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ শাহে আরেফীন বলেন, ই-টেন্ডারিংয়ের চলমান সমস্যা স্বীকৃত, চিহ্নিত এবং সরকারের উচ্চমহল এ সম্পর্কে অবগত আছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত হওয়ার পর এ বিষয়ে নতুন চিন্তাভাবনা করার জন্য সিপিটিইউ কে নির্দেশনা দিয়েছেন। নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, আমি যতদুর জানতে পেরেছি, ‘এই সমস্যাটি দ্রুত সমাধানের চেষ্টা চলছে। আগামী অর্থ বছরে হয়তো নতুন কিছু দেখা যাবে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, রাঙামাটিতে অন্যান্য অনেক বিভাগে এলটিএম (লিমিটেড টেন্ডার ম্যাথডের) সুবিধা থাকলেও সড়ক বিভাগে এলটিএম সুযোগ নেই। এলটিএম পদ্ধতি মূলত ছোট ঠিকাদারদের জন্য। তিনি বিষয়টি উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছেন বলে জানান।
বাঙালি ঠিকাদারদের উন্নয়ন কাজের বিপরীতে আয়কর দিতে হয় কাজ ভেদে সাড়ে ৩% থেকে ১০% পর্যন্ত। অথচ উপজাতীয় ঠিকাদরদের কোনো আয়কর দিতে হয় না। এ নিয়ে ঠিকাদারেরা তাদের দুঃখের কথা তুলে ধরেন এই প্রতিবেদকের কাছে। [চলবে…]