সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও মৌলিক অধিকারের দাবিতে রাঙামাটিতে ‘আদিবাসী দিবস’ উদযাপন

229

॥ মনু মারমা ॥

ব্যাপক আয়োজ এবং বিপুল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতিতে রাঙামাটিতে বিশ্ব আদিবাসী দিবস পালন করেছে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মানুষ। আদিবাসী ফোরামের আয়োজনে মঙ্গলবার (৮ আগষ্ট) সকালে “ঐতিহ্যগত বিদ্যা সংরক্ষণ ও বিকাশে আদিবাসী নারী সমাজের ভূমিকা” শ্লোগানে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন সাবেক সংসদ সদস্য উষাতন তালুকদার।

কর্মসূচির শুরুতে রাঙামাটি পৌরসভা প্রাঙ্গণে বেলুন উড়িয়ে দিবসটির উদ্বোধন করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য মাধবীলতা চাকমা। আলোচনা সভাশেষে বিপুল সংখ্যক পাহাড়ি নারী পুরুষের অংশ গ্রহণের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয় বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা।

উষাতন তালুকদার তার বক্তব্যে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত আদিবাসী শব্দ ব্যবহার না করা প্রজ্ঞাপনের নিন্দা জানিয়ে বলেন, প্রতিবছর বাংলাদেশে আদিবাসী দিবস উদযাপিত হয়ে থাকে। তিনি বলেন, পঞ্চদশ সংশোধনিতে সংবিধানের (২৩) ক ধারায় রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্বা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অন্যান্য বৈশিষ্টপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা করিবে”। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র আদিবাসী শব্দটি যাতে ব্যবহার করা না হয় প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া কোন সংবিধানে নেই। উপজাতি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, ক্ষুদ্র জাতিসত্বা ও সম্প্রদায় হিসেবে সংরক্ষণ ও উন্নয়ন বিকাশের কথা সংবিধানে সামান্য জায়গা দেয়া হয়েছে। আমাদের দাবি ছিল, সংবিধানে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া এবং বাংলাদেশের যেসমস্ত ক্ষুদ্র জাতিসত্বার মধ্যে জাতিগত সংখ্যালঘুদের। তাঁদের বাংলাদেশের সংবিধানে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তারপরও চালাকি করে উপজাতি শব্দটি বসিয়ে দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের সভাপতি প্রকৃতি রঞ্জন চাকমার সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরুপা দেওয়ান, এমএন লারমা মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনের সভাপতি বিজয় কেতন চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম আদিবাসী লেখক ফোরামের সাবেক সভাপতি শিশির চাকমা ও সিএইচটি হেডম্যান নেটওয়ার্কের সহ-সভাপতি এডভোকেট ভবতোষ দেওয়ান, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ রাঙ্গামাটি শাখার সভাপতি দীপন কুমার ঘোষসহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা।

সাবেক সাংসদ সদস্য উষাতন তালুকদার আরো বলেন, আদিবাসীরা যাতে তাদের পরিচয় চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ও ভবিষ্যৎ বংশধররা ভূলে যায়; সেজন্য এখন উপজাতি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী জোর করে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। এভাবে জোর করে বসিয়ে দেয়ার বিধান কোথাও নেই। ২০০৭ সালে গৃহীত আদিবাসী জাতির অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষপত্রে আদিবাসীদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার স্বীকৃত রয়েছে। এই অধিকারের ফলে তাঁরা স্বাধীনভাবে রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্ণয় করতে পারে এবং স্বাধীনভাবে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে পারে। এই ঘোষণাপত্রে আদিবাসীদের জোর করে নিজস্ব ভূমি থেকে উচ্ছেদ না করা, নিজস্ব মাতৃভাষায় প্রবর্তন, উন্নয়নের অগ্রাধিকার ও কর্মকৌশল নির্ধারণ।

তিনি আরও বলেন, আদিবাসীদের নাগরিকত্ব, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, অধিকারের সমতা মর্যাদা, নারী-পুরুষ, তরুণ-তরুণী ও প্রবীণদের বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ জাতিসংঘ ঘোষণাপত্রে স্বীকৃতি রয়েছে। তবে রাষ্ট্র চায় যে, এই উল্লেখ্যযোগ্য প্রতিফলন আমাদের অযৌক্তিক। আদিবাসীদের ভূমি উচ্ছেদ করে সেখানে অবকাঠামো নির্মাণ, কিন্তু সরকারিভাবে ক্ষতিপূরণও দেয়া হয়নি। এতে আদিবাসী জনগণ মাঠে নেমে প্রতিবাদ করেছে। রাষ্ট্র তাঁর শক্তির জোরে উচ্ছেদ করা হয়। এ সময় আদিবাসীদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিতে হবে মন্তব্য করেন তিনি।

সমাবেশে বক্তারা বলেন, সরকার আদিবাসী শব্দ ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে পরিস্থিতিকে উসকে দিচ্ছে। একই সাথে আদিবাসীদের সাংবিধানিক আধিকার হরন করছে। পাহাড়ে যে নির্যাতন দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে তার জন্য পার্বত্য শান্তি বাস্তবায়ন না হওয়াকেই দায়ী করেন বক্তারা। একই সাথে দ্রুত আদিবাসী সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদানের পাশাপাশি চুক্তির পুর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের জোড় দাবি জানান বক্তারা।

আলোচনা সভা শেষে শহরে একটি বর্ণাঢ্য র‌্যালী বের করা হয়। র‌্যালিটি রাঙামাটি পৌরসভা চত্বর থেকে শুরু হয়ে শহরের প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে জেলা শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে গিয়ে শেষ হয়। এতে তাদের ঐতিহ্যবাহী নিজস্ব পোশাকে হাজার হাজার জনতার ঢল নামে। ব্যানার, ফেষ্টুন, প্লেকার্ড হাতে নিয়ে প্রতিবাদ মূখর শ্লোগানের জয়জোয়ারে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির পাহাড়ী নারী-পুরুষেরা অংশগ্রহণে মূখরিত হয়ে ওঠে রাঙ্গামাটির রাজপথ।