॥ আনোয়ার আল হক ॥
প্রমত্ত পদ্মাকে শাসনের বেড়াজালে বেঁধে ফেলার সাহস আর জাতীয় গৌরবের প্রতীক, দেশের বৃহত্তম যোগাযোগ অবকাঠামো পদ্মা বহুমুখী সেতুর শুভ উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্য দিয়ে শুরু হল স্বপ্ন সেতুর গৌরবময় যাত্রা। খুলল দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে সড়কপথে যোগাযোগের অনন্য দুয়ার। শনিবার (২৫ জুন) ১২টার দিকে ১৬ কোটি বাঙালির স্বপ্ন পূরণ করেন তিনি। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনে রচিত হলো বাঙালির আরেক ইতিহাস।
আজ রোববার (২৬ জুন) থেকে যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়াা হবে স্বপ্নের এ সেতু। মাওয়া প্রান্তের মঞ্চে প্রাথমিক বক্তব্য শেষে মাওয়া পয়েন্টে টোল পরিশোধের পর উদ্বোধনী ফলক ও ম্যুরাল-১ উন্মোচনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী।
এর আগে সেতু উদ্বোধন করতে সকাল ৯টা ৫৫ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী হেলিকপ্টারে যোগে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে পৌঁছান। সেখানে বেলা পৌনে ১১টায় সুধী সমাবেশে বক্তব্য দেন। ভাষণের পর তিনি সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে স্মারক ডাকটিকিট উন্মোচন করেন। সুধী সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এমপি। আর স্বাগত বক্তব্য রাখেন মন্ত্রী পরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে কাঠাঁলবাড়ি ঘাটে শিবচরে আয়োজিত জনসভায় বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে তিনি বলেন, বাবা-মা ভাই সবাইকে হারিয়ে আমি আপনাদের পেয়েছি। আপনাদের মধ্যেই আমি পেয়েছি বাবা ও মায়ের স্নেহ। আপনাদের জীবন পরিবর্তনে আমি যেকোনো ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত। আপনাদের জন্য প্রয়োজনে আমি আমার জীবনও দিয়ে দেবো।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ২০০১ সালে আমি পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করি। কিন্তু খালেদা জিয়া এসে তা বন্ধ করে দিয়েছিল। পরে আবার ক্ষমতায় এসে শুরু করি। এখন মনে হচ্ছে খালেদা জিয়াকে বলি, আসুন, এসে দেখে যান পদ্মা সেতু নির্মিত হয়েছে কিনা।
দুর্নীতির অভিযোগের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্ব ব্যাংকের কাছে তদবির করে, আমেরিকার কাছে তদবির করে পদ্মা সেতুর কাজ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, দুর্নীতি করা হয়েছে। কে দুর্নীতি করেছে? যে সেতুর সাথে মানুষের জীবন জাড়িত, ভাগ্য জড়িত সেই সেতু নিয়ে কে দুর্নীতি করেছে? তখন আমি ঘোষণা দিলাম, টাকা বন্ধ করে দিয়েছো ঠিক আছে। বাংলাদেশ বসে থাকে না। সেতু আমরা নিজের টাকায় করবো। তখন অনেকেই আমাকে বলেছিলেন আমি পারবো না।
পদ্মার পাড়ে বৃক্ষরোপণ থেকে শুরু করে সামগ্রিকভাবে উৎপাদন বৃদ্ধির প্রতি জোর দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অনেক দেশেই খাদ্যের অভাব দেখা গেছে। কিন্তু বাংলাদেশে যাতে খাদ্যের কোনো অভাব দেখা না দেয়। এক ইঞ্চি জমিও যাতে বাদ না থাকে। যার যা আছে সেখানেই বৃক্ষরোপন করুন, উৎপাদন বাড়ান। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে বাংলাদেশ।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্পীকার, মন্ত্রী পরিষদের সদস্যবৃন্দ, বিদেশী কুটনীতিকবৃন্দ, সেনাবাহিনী প্রধানসহ উর্ধতন সরকারি কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন দলীয় প্রধান ও দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন।
প্রকল্পের বিবরণ অনুযায়ী, মূল সেতু নির্মাণের কাজটি করেছে চীনের ঠিকাদার কোম্পানি চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি) এবং নদীশাসন করেছে চীনের সিনো হাইড্রো করপোরেশন। ৩০ হাজার ১৯৩ দশমিক ৩৯ কোটি টাকা ব্যয় স্ব-অর্থায়নে সেতু প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়েছে। মূল সেতু নির্মাণের ব্যয় ১২,১৩৩.৩৯ কোটি টাকা (৪০০ কেভি ট্রান্সমিশন লাইন টাওয়ার এবং গ্যাস লাইনের জন্য ১০০০ কোটি টাকাসহ) এবং ১৩.৮ কিলোমিটার নদীশাসন কাজের ব্যয় ৯,৪০০০.০ কোটি টাকা।
টোল প্লাজা এবং এসএ-২সহ ১২ কিমি অ্যাপ্রোচ রোডের নির্মাণ ব্যয় ১,৯০৭.৬৮ কোটি টাকা (২টি টোল প্লাজা, ২টি থানা ভবন এবং ৩টি পরিষেবা এলাকাসহ) যেখানে পুনর্বাসনের ব্যয় ১,৫১৫.০০ কোটি টাকা, ২৬৯৩.২৬ কোটি টাকা ব্যয় জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। পরিবেশ রক্ষায় ব্যয় ১২৯০.৩ কোটি টাকা, কনসালটেন্সি ৬৭৮৩.৭ কোটি টাকা এবং অন্যান্য (বেতন, পরিবহন, সিডি ভ্যাট এবং ট্যাক্স, ফিজিক্যাল এবং প্রাইস কন্টিনজেন্সি, ইন্টারেস্ট ইত্যাদি) ১,৭৩১.১৭ টাকা।
পদ্মা বহুমুখী সেতু ব্যবহারের জন্য এরই মধ্যে টোল ঘোষণা করেছে সরকার। গত ১৭ মে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীন সেতু বিভাগ এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু পার হতে একটি মোটরসাইকেল ১০০ টাকা, একটি গাড়ি ও একটি জীপ ৭৫০ টাকা।
টোল চার্ট অনুযায়ী, একটি পিকআপের জন্য ১,২০০ টাকা, একটি মাইক্রোবাসের জন্য ১,৩০০ টাকা, একটি ছোট বাসের জন্য (৩১-সিটের জন্য ১,৪০০ টাকা), একটি মাঝারি আকারের বাসের জন্য ২,০০০ টাকা (৩২ আসনের বেশি) এবং একটি বড় বাসের জন্য (তিন-অ্যাক্সেল) ২,৪০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ছোট ট্রাকের (৫ টন পর্যন্ত) জন্য ১,৬০০ টাকা, একটি মাঝারি ট্রাকের (৫-৮ টন) জন্য ২,১০০ টাকা এবং ৮-১১ টন ওজনের একটি ট্রাকের জন্য ২,৮০০ টাকা, একটি ট্রাকের (থ্রি-অ্যাক্সেল) জন্য ৫,৫০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে এবং একটি ট্রেলারের (চার-অ্যাক্সেল) জন্য ৬,০০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয় যে চার-অ্যাক্সেল ট্রেলারের উপরে প্রতিটি এক্সেলের জন্য ৬,০০০ টাকার সঙ্গে অতিরিক্ত ১,০০০ টাকা যোগ করা হবে।
প্রথমদিন পদ্মা সেতুতে ১৬ হাজার ৪০০ টাকা টোল দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্যে নিজের গাড়ির জন্য ৭৫০ টাকা টোল দিয়েছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহরে ১৮ টি গাড়ি ছিল।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন পদ্মা সেতু অতিক্রম করেন তখন বিমান বাহীনির ছয়টি হেলিকপ্টার তাকে অভিবাদন জানায়। এর পর ওই হেলিকপ্টারগুলো কাঠালবাড়ি ঘাটে জনসভা মঞ্চের ওপর দিয়ে চক্কর দেয়। এর একটিতে জাতীয় পতাকা, একটিতে বঙ্গবন্ধু, একটিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, পদ্মা সেতু, আওয়ামী লীগের দলীয় পতাকা বহন করছিল। আরেকটি হেলিকপ্টার থেকে ফুল ছিটিয়ে জনসভায় আসা মানুষদের অভিবাদন জানানো হচ্ছিল। পদ্মা সেতুতে দাঁড়িয়ে তিনি বিমান বাহিনীর মহড়া দেখেন। এরপর ১২ টা ২৬ মিনিটের দিকে তিনি আবার গাড়িতে ওঠেন। সেখান থেকে তিনি জাজিরা প্রান্তে পৌছান।
২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর সেতুর নির্মান কাজে ৩৭ এবং ৩৮ নম্বর পিলারে প্রথম স্প্যান বসানোর মাধ্যমে পদ্মা সেতুর অংশ দৃশ্যমান হয়। পরে একের পর এক ৪২টি পিলারের ওপর বসানো হয় ৪১টি স্প্যান। ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর শেষ ৪১তম স্প্যান স্থাপনের মাধ্যমে বহুমুখী ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার পদ্মা সেতুর সম্পূর্ণ কাঠামো দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।