ঢাকা ব্যুরো অফিস, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৫, দৈনিক রাঙামাটি : জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের বিনম্র শ্রদ্ধা জানানোর মধ্য দিয়ে আজ সারা দেশে মহান বিজয়ের ৪৪তম বার্ষিকী উদযাপিত হয়েছে। আজ সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে কৃতজ্ঞ জাতি তাদের এই আন্তরিক শ্রদ্ধা জানানোর জন্য সমবেত হয়। শোক আর রক্তের ঋণ শোধ করার গর্ব নিয়ে উজ্জ্বীবিত জাতি দিবসটি উদযাপন করে অন্যরকম অনুভূতি নিয়ে।
এবছর এমন একটি প্রেক্ষাপটে বিজয় দিবস পালিত হয়েছে যখন একাত্তরের সেই যুদ্ধাপরাধী ও বুদ্ধিজীবী হত্যার সাথে সংশ্লিষ্টদের বিচার কাজ এগিয়ে চলছে। এরমধ্যে মানবতাবিরোধী হত্যা মামলায় দন্ডিত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা ফাঁসির দন্ড কার্যকর হয়েছে। জামায়াতের অপর নেতা মো. কামারুজ্জামান এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার অন্যতম হোতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদসহ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে অতি সম্প্রতি।
শীতের কুয়াশা ও ঠান্ডা বাতাস উপেক্ষা করে স্বাধীনতা বিরোধীদের বিচারের রায় কার্যকর হচ্ছে এই স্বস্তি নিয়ে সর্বস্তরের মানুষ ভোর থেকেই সাভারের স্মৃতি স্মৃতিসৌধের বাইরে ও আশেপাশের মহাসড়ক এলাকা এবং ধানমন্ডিস্থ বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে সমবেত হতে থাকে।
জাতীয় স্মৃতিসৌধ থেকে লাখো মানুষের দৃপ্তকণ্ঠে আওয়াজ উঠে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নেয়ায় পাকিস্তানের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন, জামায়াতকে নিষিদ্ধ এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দ্রুত শেষ করার।
ভোরের সূর্য ওঠার আগেই হাতে ফুল, মাথায় বিজয় দিবস লেখা ব্যান্ড, মুখে একাত্তরের ঘাতকদের বিচার দাবির স্লোগানে স্মৃতিসৌধে নেমেছিল জনতার এই ঢল। বিন¤্র শ্রদ্ধাবোনত চিত্তে সমগ্র জাতি ত্রিশ লাখ শহীদকে আরও একবার জানিয়ে দিল ‘আমরা তোমাদের ভুলব না।’
দিবসটি উপলক্ষে সরকারি-বেসরকারিভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে ভোরে ৩১ বার তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে বিজয় দিবসের কর্মসূচি শুরু হয়। সশস্ত্র বাহিনীর কুচকাওয়াজ পরিদর্শন ও সালাম গ্রহণ করেন রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ভোর ৬টা ৩৪ মিনিটে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে স্মৃতিস্তম্ভের বেদিতে রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে শুরু হয় শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন। এ সময় শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। বিউগলে বেজে ওঠে করুণ সুর। পরে শেখ হাসিনা দলীয় প্রধান হিসাবে দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
এসময় অন্যান্যের মধ্যে স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, প্রধান বিচারপতি, মন্ত্রীবৃন্দ, সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা, প্রতিমন্ত্রীবৃন্দ, তিন বাহিনীর প্রধানগণ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, মুক্তিযোদ্ধা, কূটনীতিক, বিভিন্ন উন্নয়ন অংশীদারদের প্রতিনিধি এবং উচ্চপর্যায়ের সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী স্মৃতিসৌধস্থল ত্যাগ করার পর সর্ব সাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য খুলে দিলে সাধারণ মানুষের ঢল নামে। দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া।
একদিকে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা ও অন্যদিকে বিজয় উল্লাসে বুধবার জাতীয় স্মৃতিসৌধ চত্বর মুখর ছিল বিভিন্ন বয়সী মানুষের পদচারণায়। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির ধ্বংসাত্মক, নৈরাজ্যকর কর্মকান্ড প্রতিহত করতে নানা স্লোগান, দেশাত্মবোধক গান চলছিল বিরামহীনভাবে। জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে আসা জনতার এই ঢল অব্যাহত থাকে দুপুর ১টা পর্যন্ত।
একে একে বেদীতে শ্রদ্ধা জানায় কেন্দ্রীয় ১৪ দল, শহীদ পরিবারের সন্তান ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বে জাসদ, উপাচার্য ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, সভাপতি জামাল উদ্দীন ও রাজু আহমেদের নেতৃত্বে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, সৈয়দ আবু জাফর আহমেদের নেতৃত্বে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি, জাতীয় স্মৃতিসৌধে শহীদদের প্রতি বিন¤্র শ্রদ্ধা জানায়।
এ ছাড়া বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগ, কৃষক লীগ, যুব মহিলা লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি (জেপি), ছাত্র ইউনিয়ন, যুব ইউনিয়ন, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ-’৭১, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, ঢাকা ইউনিভার্সিটি ফটোগ্রাফিক সোসাইটি, আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, মুক্তিযোদ্ধা যুব কমান্ড, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন মঞ্চ ও প্রজন্ম মঞ্চ, জাকের পার্টি, মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ সহ বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন হলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও স্মৃতিসৌধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়।
পরে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধানমন্ডিন্থ ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে রক্ষিত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর দলীয় নেতাদের নিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তিনি জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানান। দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা এসময় বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
এদিকে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণের স্থান ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখো কণ্ঠে জাতীয় সংগীত ও শপথ বাক্য পাঠ অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিকেল ৪টা ৩১ মিনিটে জাতীয় সংগীত শুরু হয়। এ সময় লাখো মানুষ অংশ নেন। পরে শপথ বাক্য পাঠ করান অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত।
এছাড়াও মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে আজ সকালে জাতীয় প্রেসক্লাব এবং মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক কমান্ড জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে। রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে রক্ষিত বঙ্গবন্ধু প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে এ শ্রদ্ধা জানানো হয়।
বিকালে রাজধানীতে লাখো মানুষের অংশগ্রহণে মহান বিজয় দিবসে রাজধানীতে বড় শোভাযাত্রা বের করে আওয়ামী লীগ। ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধু ভবনস্থ এই দীর্ঘ সাড়ে তিন কিলোমিটার সড়কজুড়েই মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটির বর্ণাঢ্য মনেলোভা বিজয় র্যালিতে মানুষের ঢল নামে ।
দিনটি উপলক্ষে সকল সরকারি-আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনায় আলোকসজ্জার ব্যবস্থা হয়েছে। রাজধানী ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন শহরের প্রধান সড়ক ও সড়ক দ্বীপগুলো জাতীয় পতাকা ও রঙ-বেরঙের পতাকায় সাজানো হয়।
এদিকে জাতির শান্তি, সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি কামনা করে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডাসহ সব ধর্মের উপাসনালয়ে বিশেষ মোনাজাত ও প্রার্থনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। হাসপাতাল, জেলখানা, বৃদ্ধাশ্রম, এতিমখানা, শিশু পরিবার ও ভবঘুরে প্রতিষ্ঠানগুলোয় উন্নতমানের খাবার সরবরাহ করা হয়।
পোস্ট করেন- শামীমুল আহসান, ঢাকা ব্যুরোপ্রধান। সূত্র- অন্য মিডিয়া