১৩ এপ্রিল ২০২৫, ঢাকা ব্যুরো অফিস, দৈনিক রাঙামাটি
শামিমুল আহসান :
বাংলা লোকসংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ এবং বাংলা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ উৎযাপনের অন্যতম উপজীব্য ‘বাঁশের বাঁশি’ তৈরিতে চারশত বছরেরও বেশী সময়ের ঐতিহ্য হারিয়ে কালের স্বাক্ষীতে পরিণত হচ্ছে কুমিল্লা জেলার হোমনা উপজেলার শ্রীমুদ্দি গ্রামের নুমুইল্লাপাড়া। বাঁশের বাঁশি তৈরিতে এমন ঐতিহ্য ভারত বর্ষে আর নেই। ১৯৯৮ সালে এ তথ্য দিয়েছিলেন এ গ্রামের বাঁশের বাঁশি তৈরির কারিগর স্বর্গীয় শ্রী হরচন্দ্র বিশ^াস ও ভগবান বিশ^াস সহ তাঁদের সমবয়সিরা। ঐ বছর জাতীয় পত্রিকা ‘দৈনিক জনপদ’ এ এতথ্য প্রকাশ করা হয়। সে সময় এ গ্রামের অর্ধশত হিন্দু পরিবার ও প্রায় ২০টির মত মুসলিম পরিবারের প্রায় দুই শতাধিক কারিগর বাঁেশর বাঁশি তৈরির কাজ করতেন। প্রায় ২৮ বছরের ব্যবধানে শ্রীমুদ্দি গ্রামে গিয়ে জানাগেছে মাত্র দুটি হিন্দু পরিবার ও ৩-৪টি মুসলিম পরিবারের সদস্যরা মিলে অনেকটা জোর করে টিকিয়ে রাখছেন বাঁশের বাঁশি তৈরির ঐতিহ্য।
শ্রীমুদ্দি গ্রামের বাঁশি তৈরির কারিগর (স্বর্গীয় শ্রী হরচন্দ্র বিশ^াসের বড় ছেলে) অনিল বিশ^াস জানান, দেশে মোবাইল ফোনের প্রভাব বাড়ায় বাঁশের বাঁশির বাজার কমে গেছে। বাঁশের বাঁশির মূলক্রেতা শিশু ও তরুণ প্রজন্মের হাতে মোবাইল ফোন আশায় তারা বাঁশি বিমূখ হয়ে পড়েন। এ কারণে তরুণ প্রজন্মের কাছে বাঁশের বাঁশির গুরুত্ব নেই। বংশ পরম্পরায় অনেকটা জোর করেই টিকে আছেন তাদের পরিবার। বর্তমানে অনিলের ছোট ভাই প্রমিল বিশ^াস, গোপাল বিশ^াস ও রতন বিশ^াস এবং তার জেঠাতো ভাই (স্বর্গীয় শ্রী ভগবান বিশ^াসের ছেলে) যতিন বিশ^াস ও চিত্ত রঞ্জন বিশ^াস তাদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বাঁশি তৈরির কাজ করে থাকেন। অন্যসব পরিবার এই পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। অপর দিকে এ গ্রামের মুসলিম পরিবারগুলোর মধ্যে ৩-৪টি মুসলিম পরিবার তাদের সদস্যদের নিয়ে এ শিল্পটি টিকিয়ে রেখেছেন। তাদের মধ্যে মো. সোলায়মানের ছেলে মো. আবুল কাসেম মোটামুটি ভালো অবস্থানে রয়েছেন।
মেলা-উৎসব এবং বাঁশের বাঁশির বাজার :
লোকসংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ বাঁশের বাঁশি সাংস্কৃতিক অঙ্গন ছাড়িয়ে দেশের ঐতিহ্যবাহী মেলা-উৎসবে অন্যতম উপজীব্য। বাংলাদেশের প্রধান উৎসব পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে দেশজুড়ে আয়োজিত বৈশাখী মেলা ছাড়াও হোমনার মিরাশের মেলা, শ্রীমুদ্দির কালী বাড়ীর মেলা, দাউদকান্দির আইনুদ্দিন শাহ মেলা, কচুয়ার সাচারের রথমেলা, ধামরাইয়ের রথমেলা, মতলবের বেলতুলীর লেংটার মেলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার খরমপুরের মেলা, চট্টগ্রামের জব্বারের বলী খেলা উপলক্ষে আয়োজিত মেলা, নারায়নগঞ্জের লাঙ্গলবন্দের অষ্টমী ¯œান, সাতক্ষীরার পূজার মেলা, কুষ্টিয়ার লালন মেলা, তিতাসের গাজীপুরে মৌসুমিতে বাঁশি বিক্রি ছাড়াও সারা বছরই দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, শহর, বন্দর, হাট-বাজারে তাদের বাঁশি বিক্রয় হয়ে থাকে। এসব বড় বড় মেলায় বাঁশের বাঁশি বিক্রির বড় জোগান দেয়া হয় কুমিল্লার হোমনা উপজেলার শ্রীমুদ্দি গ্রাম থেকে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা খুচরা বিক্রেতা-হকার ও পাইকাররা শ্রীমুদ্দি থেকে বাঁশি নিয়ে বিক্রয় করে থাকেন। মেলায় বিক্রির জন্য প্রতিটি সাধারণ বাঁশের বাঁশি ৫ টাকা থেকে শুরু করে ১৫০ টাকা পর্যন্ত পাইকারী দরে বিক্রি হয়। যা পাইকার ও খুচরা বিক্রেতা-হকাররা ২০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করে থাকেন। মেলার মূল ক্রেতা হলো শিশু ও তরুল প্রজন্ম। তবে পেশাদার বাঁশিশিল্পীদের জন্য তৈরি বাঁশের বাঁশির মূল্য ১০০ থেকে ২৫০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। এক্ষেত্রে মো. সোলায়মান মিয়ার ছেলে মো. আবুল কাশেম (৬৫) এর সুনাম রয়েছে। ঢাকার লাবু, লাল মিয়া ও সারুলিয়ার জয়নাল শ্রীমুদ্দি থেকে ওয়ার্ডার দিয়ে বিষেশ ধরণের বাঁশি বানিয়ে এনে তা নিজেদের মত করে পেশাদার বাঁশিশিল্পীদের কাছে বিক্রি করেন।
বাংলা দেশের মেলা-পার্বণ ছাড়াও পার্শবর্তী দেশ ভারত, মালয়শিয়া, দুবাই, ওমান, জাপান, ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের ২০-২৫টি দেশে শ্রীমুদ্দির বাঁশি শিল্পের খ্যাতি রয়েছে।
শ্রীমুদ্দিতে এক সময় বাঁশের বাঁশি বিক্রিতে উম্মুক্ত বাজার ব্যবস্থা থাকলেও এখন তা নেই। কারণ, বাঁশি তৈরির ব্যপকতা কমে আসায় উম্মুক্ত বাজার ব্যবস্থা সংকীর্ণ হয়ে পূর্ব ওয়ার্ডার ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। এছাড়া- মহাজন, এনজিও ও দাদন ব্যবসায়ীদের ঋণের বোঝা নিয়ে বাঁশিশিল্পীদের পুঁজি উঠিয়ে ব্যবসা করতে হিমশিম খেতে হয়।
বাঁশ সংগ্রহ ও বাঁশি তৈরির কারিগরিতা :
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি, সীতাকুন্ড ও মিরসরাই এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান থেকে বাঁশ ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে মুলি বাঁশ কিনে শ্রমুদ্দি গ্রামে আনা হয়। কারিগড়দের বাঁশ কিনতে মহাজনের সরণাপন্ন হতে হয়।
পরে বিভিন্ন মাপ অনুযায়ী মুলি বাঁশ কেটে টুকরা করা হয়। এরপর টুকরাগুলো রোদে শুকিয়ে পরে পানিতে ধুয়ে ফিনিশ করে রং করে নেয়া হয়। শ্রমুদ্দি গ্রামের বাঁশের বাঁশির কারিগর-শিল্পীরা আড় বাঁশি, মুখ বাঁশি, বেলুন বাঁশিসহ প্রায় ১৪/১৫ ধরনের বাঁশি তৈরি করে থাকেন। মুখ বাঁশি, বেলুন বাঁশি তৈরিতে মান্দার/মান্দাল কাঠ দিয়ে কডি তৈরি করে বাঁশের মাথায় আটকিয়ে দেওয়া হয় যা, সহজে সূর তুলতে সহায়ক হয়। কাঠ বার্নিশ ও তরল কাঁদামাটি ব্যবহারে টুকরো বাঁশের কভারে রং ও বিশেষ ধরণের সুতা দ্বারা বাঁশির উপর বিভিন্ন ডিজাইন করে বাজারজাত করা হয়। আড় বাঁশি ও মুখ বাঁশিসহ সব ধরণের বাঁশির ছিদ্র করতে মটার চালিত বিশেষ ধরণের চুলায় কয়লার আগুনে আঙ্গার করা সুচারু লোহার রড দ্বারা সারেগামা স্কেলের মাপ অনুযায়ী বাঁশে ছিদ্র করা হয়। এক্ষেত্রে আগে বাঁশের টুকরায় মূল কারিগরকে সারেগামা স্কেলে মাপ ঠিক করে নিতে হয়। সাধারণত পরিবারের অভিজ্ঞ পুরুষ কারিগরাই স্কেলে মাপের কাজটি করে থাকেন। তবে পরিবারের পাঁচ বছরের শিশুসহ সব বয়সের সদস্যরা কোনোনা কোনোভাবে বাঁশি তৈরিতে সহযোগিতা করে থাকেন।
উল্লেখ করা প্রয়োজন, বানিজ্যিক ভিত্তিতে এই শিল্পটি টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। এটি পরিবার ভিত্তিক একটি লোকজশিল্প। এই শিল্পটিকে টিকিয়ে রাখতে এখানকার বাঁশিশিল্পীদের (কারিগর) সরকারী অনুদান/প্রনোদনা দেয়া প্রয়োজন।
আপলোড, শামিমুল আহসান
ঢাকা ব্যুরো প্রধান, দৈনিক রাঙামাটি