॥ আনোয়ার আল হক ॥
এক অভূতপূর্ব ঘটনা প্রত্যক্ষ করলাম। দুর্ঘটনার শিকার এক পাহাড়ি শিশুর চিকিৎসার জন্য স্বপ্রণোদিত হয়ে ২৫,০০০/- টাকা অনুদান দিয়ে ‘দৃষ্টান্ত সৃষ্টি’ করলেন ডিসি মামুনুর রশিদ স্যার। অগ্নিদগ্ধ চাকমা শিশুটি এখন ঢাকায় চিকিৎসা নিতে পারবে।
ফ্যাক্টঃ লংগদুর অখ্যাত গাঁয়ের শিশু ‘কাহিনী চাকমা’ ; শীত নিবারণে আগুন পোহাতে গিয়ে দগ্ধ হয়। চিকিৎসাধীন ছিল বাঘাইছড়ি হাসপাতালে, রেফার করা হয় চট্টগ্রাম হয়ে ঢাকায়। দরীদ্র শিশুটির পরিবারের পক্ষে চিকিৎসা করানো সম্ভব ছিল না; এই দেখে ফেসবুকে পোস্ট দেয় অনুজ সাংবাদিক ওমর ফারুক সুমন। ফেসবুকের পোস্ট দেখে স্বপ্রণোদিত হয়ে এই সহায়তা দিলেন ডিসি মামুন স্যার। এ জন্য তাঁর কাছে কেউ সাহায্যের আবেদন জানায়নি। স্ট্যাটাস দেওয়ার ২০ মিনিটের মধ্যেই সাড়া দেন তিনি।
এটা নতুন কোনো ঘটনা নয়। এমন অনুদান ডিসি একেএম মামুনুর রশিদ স্যার বিগত তিন বছরে বহুবার দিয়েছেন। কিন্তু আমি একে ‘দৃষ্টান্ত সৃষ্টি’র কথা বললাম এই কারণে যে, তিনি ইতোমধ্যে রাঙামাটি থেকে বদলি হয়ে গেছেন। তাঁর উত্তরসূরি আসা পর্যন্ত বাড়তি কয়েকদিন আছেন মাত্র। এই সময়ে তাঁর রুটিন ওয়ার্কও সংকুচিত হওয়ার কথা। পেশাগত জীবনে রাঙামাটিতে বেশ কয়েকজন ডিসিকে কাছ থেকে দেখেছি।
রাঙামাটিবাসীর ভাগ্য ভালো তাদের বেশির ভাগ স্যারই দক্ষ এবং ভালো মানুষ ছিলেন। তবে ডিসি স্যারেরা যাওয়ার সময় সাধারণত গোছানোয় ব্যস্ত থাকেন। বিদায়কালীন সমৃদ্ধির বিষয়টিও তাদের মাথায় থাকে। এমন প্রেক্ষাপটে স্বপ্রণোদিত হয়ে কাউকে অর্থ সহয়তার কথা তিনিই ভাবতে পারেন; যে মানুষটি আপাদমস্তক মানবিক। তাঁর মানবিক মনটি ওই অসহায় ছোট্টশিশুটির জন্য কতখানি ব্যকুলতা প্রকাশ করেছে তা স্বল্প সময়ে যোগাযোগ এবং অনুদান হস্তান্তরের ঘটনা থেকে অনুমেয়।
আরো কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করতে ইচ্ছা করছে- প্রথমত: জেলাপ্রশাসকের চেয়ারে বসে থাকা একজন মানুষের ব্যস্ততা কতখানি, তা বলার অপেক্ষা রখে না। কিন্তু এতো ব্যস্ততার মাঝেও ডিসি মামুন স্যার নিয়মিত ফেসবুক চেক করেন এবং সচেতনভাবেই খুঁজে দেখেন- তার আর কোনো করনীয় আছে কিনা। ফেসবুকের স্ট্যাটাস দেখে তিনি গত তিন বছরে রাঙামাটির অসংখ্য অসহায় মানুষকে সহায়তা করেছেন। আমরা তার প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী। আমার নিজের পোস্ট দেখেও স্যার কয়েকজনকে সহায়তা করেছেন এবং বেশ কিছু বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়েছেন। এর মধ্যে অসহায় আউস মিয়ার চিকিৎসা সহায়তার বিষয়টি আমিসহ আমার পরিচিত অনেকের মনে বেশ দাগ কেটেছে।
দ্বিতীয়ত: গণশুনানীতে ডিসি স্যার রাঙামাটির অসংখ্য ছাত্রছাত্রীর পড়ালেখায় সহযোগীতা করে অনেককেই ছাত্রত্ব হারানোর বেদনা থেকে রক্ষা করেছেন। অনেক অসহায় মানুষের যুগ যুগের সমস্যা এক নিমিষে সমাধান করে দিয়েছেন। তার তালিকা বেশ লম্বা।
তৃতীয়ত: যে কথাটি না বললে নিজেকে ছোট মনে হবে তা হলো, তিনি দায়িত্ব পালনকালীন আমি এবং আমার সতীর্থদের অনেকেই নানাজনের হরেক রকম সমস্যা নিয়ে যখনই স্যারের কাছে গিয়েছি, কখনই তিনি হতাশ করেননি। আমি নিজের জন্য কখনও কোনো অনুরোধ নিয়ে স্যারের কাছে যাইনি। কিন্তু যার জন্যই গিয়েছি, তিনি আন্তরিকভাবে সাড়া দিয়েছেন। কখনও কখনও স্যারের সেই অংশগ্রহণ প্রত্যশিত মাত্রার বেশ উপরে ছিল। এ কথাগুলো হয়তো কখনও স্যারকে বলা হবে না; ধন্যবাদ দেওয়ার জন্য। কিন্তু আজ এই প্রত্যন্ত শিশুটির সহায়তায় এই মানবিক অফিসার যা করে গেলেন, তার মহিমা যেন অতীতের সব উপকারকে ছাপিয়ে গেলো। আমরা আভিভূত, তাই দু’কলম লেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। আর, একটু বলতে গিয়ে অনেক কিছু লিখে ফেললাম। তবে এ কথাও নির্দ্বিধায় বলতে পারি, লিখা হলো না স্যারের অনেক গুণের কথা। কারণ বেশি লিখলে কেউ পড়বে না।
‘দোষে-গুণে মানুষ’ আমার দৃষ্টিতে কোনো দোষ ধরা না পড়লেও কারো দৃষ্টিতে তেমন কিছু থাকতেও পারে। তবে স্যারের গুণের ভারে সেগুলো হয়তো গোনায় পড়বে না। আমার মতো এতো ছোট মানুষের এই কথাগুলো হয়তো সমাজে তেমন কোনো প্রভাবও ফেলবে না। তবুও আজ মনেপ্রাণে একটি কামনা উচ্চারণ করছি, ‘এমন মানবিক অফিসার পদায়িত হোক প্রশাসনের প্রতিটি চেয়ারে’। পিছিয়ে পড়া এ পার্বত্য জেলায় এমন মানুষ বার বার আসুন; আর ডিসি মামুন স্যারদের মতো মানুষ উচ্চ পদেও যথাযোগ্য স্থানে পদায়িত হোন যেন জাতির উপকার করতে পারেন।
সবশেষে বাঘাইছড়ির প্রিয় অনুজ সাংবাদিক ওমর ফারুককে ধন্যবাদ- অসহায় ‘কাহিনী চাকমা’র পাশে দাঁড়ানোর জন্য। সুস্থ হয়ে উঠুক “কাহিনী” তার জন্য শুভ কামনা।
প্রসঙ্গত, কাহিনী চাকমা আটারকছড়া ইউনিয়নের উল্টাছড়ি গ্রামের হতদরিদ্র জুম চাষী লিটন চাকমার মেয়ে। সে গত ১৫ দিন পূর্বে শীত নিবারনের চেষ্টায় আগুন পোহাতে গিয়ে অগ্নিদগ্ধ হয়ে স্থানীয় গ্রাম্য হাতুড়ে বৈদ্যের কাছে চিকিৎসা নেয়। কিন্তু অপচিকিৎসার শিকার হয়ে অবস্থার অবনতি হলে বাঘাইছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হয়। পরে বাঘাইছড়ির সাংবাদিক ওমর ফারুক সুমন কাহিনী চাকমার অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করলে শিশুটির চিকিৎসা সহায়তায় এগিয়ে আসেন বাঘাইছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান সুদর্সশন চাকমা, ওয়ার্ল্ড বুড্ডিস্ট এসোসিয়েশনসহ স্থানীয় বেশ কয়েকজন সহৃদয়বান ব্যক্তি। পরে সকলের প্রচেষ্টায় কাহিনী চাকমাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়। সেখানে দুইদিন চিকিৎসায় অবস্থার পরিবর্তন না হওয়ায় চিকিৎসকরা তাকে ঢাকায় প্রেরণের পরামর্শ দেন বলে জানায় কাহিনী চাকমার বাবা লিটন চাকমা। এতে মোটা অংকের অর্থের প্রয়োজন দেখা দেয়ায় চিন্তিত হয়ে পরেন হতদরিদ্র জুম চাষী লিটন চাকমা। তিনি চেয়েছেন সকলের সহায়তা কামনা করেন।
এই দেখে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দেয় বাঘাইছড়ি সাংবাদিক ওমর ফারুক সুমন। পোস্ট দেখে জেলাপ্রশাসক তার সাথে যোগাযোগ করেন এবং সোমবার (২২ ফেব্রুয়ারী) সকাল ১১ টায় এই সহায়ত সুমনের হাতে তুলে দেন।