॥ মাওলানা ক্বারী মোঃ ওসমান গনি চৌধুরী ॥
সম্প্রতি এক শ্রেণীর লোক ধর্মীয় ক্ষেত্রে এমন কিছু বিষয় সংযোজন করেছেন যা ঈমান-আকিদার পরিপন্থী। সর্বজনগ্রাহ্য মাযহাবের ইমামের গবেষণালব্ধ সঠিক কর্মপদ্ধতি বাদ দিয়ে এরা নিজস্ব কিছু নীতি প্রচলন করেছে এবং সাধারণ মুসলমানদের বিভ্রান্ত করছে, এর মধ্যে সাম্প্রতিককালে নামাজে অন্তর্ভুক্ত কিছু বিতর্কিত বিষয়ে সঠিক সমাধান সংক্ষেপে নিম্নে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
আল্লাহর ওয়াস্তে নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর দিকে লক্ষ্য করুন:
১। আল-কুরআনের নাসেখ ও মানসুখের মত হাদিসেও আমলযোগ্য এবং আমলঅযোগ্য হাদীস রয়েছে। তাই আল্লাহর নবী (সাঃ) কোরআনের সাথে “হাদিস” শব্দ না বলে ইহকাল ত্যাগের সময় তোমাদের জন্য “সুন্নাহ” রেখে গেলাম বলেছেন। উল্লেখ্য উম্মত যে সব হাদিস অনুসারে আমল করতে পারে, ওই সব হাদিকে সুন্নাহ বলে। ১৪৩৫ হিজরিতে এসে তাবেঈ ও তবে তাবেঈদের যুগে প্রতিষ্ঠিত মাযহাবকে হাদিসের কথা বলে এ বাহানায় অস্বীকার করা যাবে না। মাযহাবের ইমামগণ অনেক সহি হাদিস পাননি, যা এখন কেউ কেউ পাচ্ছেন।
২। বর্তমানে কোন কোন জ্ঞানপাপী স্বঘোষিত তথাকথিত সনদহীন মুহাদ্দিস মাযহাবকে কোরআন-হাদিসের পরিপন্থী ও সহি হাদিসকে জয়ীফ প্রমাণের অপচেষ্টা করার মতো নানা কর্মকাণ্ড করে দেশ হতে বহিস্কৃত হয়ে ১৯৯৯ সালে জর্দানে গিয়ে মারা গিয়েছে। আবার কেউ কেউ কয়েক মাযহাবকে একসাথে অনুসরণ করে নতুন রূপে উপস্থাপন বা জগাখিচুড়ি করে ফেলেছেন। অথচ সাহাবীদের যুগেও মুজতাহিদ ফকীহ ছিলেন। তাবেঈ ও তবে তাবেঈদের যুগে হতে ৪ মাযহাব স্বীকৃতি প্রাপ্ত হয়ে আসছে। পরবর্তী বিশ্ববরেণ্য মুজতাহিদ, মুজাদ্দেদ, ফকীহ, ইমাম, মুহাদ্দিস, মুফাসসিরগণ কর্তৃক শতাব্দি পরম্পরায় অদ্যবদি এটি প্রচলিত আছে। এমনকি প্রত্যেক মুহাদ্দিস ও মাশায়েখ মাযহাবের অনুসারী ছিলেন। তারা কোরআনে বর্ণিত উলুল আমর ও আহলুয যিকরে সর্বসম্মতভাবে অন্তর্ভুক্ত।
৩। ইমাম গাযযালী ইজতেহাদ ওয়াল মুজতাহেদ কিতাবের ৬৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন যে, ইমামগণ আমাদের জন্য হাদিস প্রাপ্তির মাধ্যম, বিধায় তাদের অনুসরণ আয়াত ও হাদীসের অনুসরণের নামান্তর এবং শাহ অলিউল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলভী তার লিখিত ইকদুল জৈয়দ কিতাবের ৩৮ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, এই চার মাযহাবের অনুসরণ মূলত হাদিসের নির্দেশনা অনুযায়ী বড় দলের অনুসরণ এবং তাদের অবাধ্যতা হাদিস ও বড় দলের অবাধ্যতা, তিনি ফয়জুল হেরমাইন কিতাবে লিখেছেন, আল্লাহর নবী (সা:) স্বপ্নে তাকে মাযহাবের স্বীকৃতি এবং হানাফী মাযহাব বেশি সুন্নত সমৃদ্ধ বলেছেন। অনেকের মত আরও এক অনুসরণীয় ইমাম ইবনুল হুমাম ফাতহুল কাদীরে লিখেছেন এই মাযহাব চতুষ্ঠয়ের বিপরীতে অন্য মাযহাবের অনুসরণ না করার জন্য উম্মতের ইজমা হয়েছে। আধুনিক সমাজ বিজ্ঞানের জনক উম্মতে মুসলিমার তৎকালীন ইমাম আল্লামা ইবনে খালদুন বহু পূর্বেই তার লিখিত আল মুকাদ্দামার ৪৪৮ পৃষ্ঠায় এই চার ইমামের যে কোনো একজনের তাকলদি ও ইমাম না বদলানোর উপর জোর দিয়ে বিস্তারিত নির্দেশনা দিয়েছেন যে, ৪ মাযহাব আল্লাহতালা বিশেষ অনুগ্রহ বলে প্রসিদ্ধ তাফসীরে আহমদীর ৩৪৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে। উল্লেখিত অনুবাদসমুহের আরবিসহ এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত বিবরণের ইচ্ছা থাকলে মাকালাতে আল ইমামী দেখার অনুরোধ রইলো।
৪। তবে ইমাম হানাফী মাযহাবকে অনুসরণ কেন করি, জবাবে বলা যায় যে, অন্য ইমামগণ কোরআন হাদিস বা শুধু তথ্যনির্ভর হয়ে মাসআলা আবিষ্কার করেছেন, কিন্তু তৎকালীন বিশ্বের বড় ইমাম হিসেবে স্বীকৃতি প্রাপ্ত অন্য ইমামদের উস্তাদ সমতুল্য ইমাম আযম আবু হানিফা (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) তথ্য বা নকলের সাথে সাথে মাসআলা উদ্ভাবনের প্রসিদ্ধ হাদিস অনুযায়ী আকল ও বিবেককেও স্থান দিয়েছেন। প্রসঙ্গত বলা যায় প্রখ্যত মুহাদ্দিসহযরত সোলেমান আমাস (র) একবার ইমাম আযমকে প্রশ্ন করলেন যে, আপনি ফিকহী মাসায়েল উদ্ভাবনের অংশ হিসেবে বর্ণিত সমাধান কিভাবে দিলেন? জবাবে ইমাম সাহেব বললেন, হযরত আপনি যে হাদীসটি আমাকে শোনালেন আমি সেই হাদিস থেকে মাসআলা উদ্ভাবন করেছি। তখন তিনি আশ্চর্য হয়ে বললেন যে, আপনারা হলেন শিক্ষক আর আমরা হলাম ঔষধ সরবরাহকারী। যিনি ২২জন সাহাবীর সাথে সাক্ষাত ও ৮জন সাহাবী হতে হাদিস সংগ্রহ করে সর্বমোট ৪০০০০ হাদিস বাছাই করে সর্বপ্রথম হাদিসের হাদিসে কিতাবুল আসার উপহার দিয়েছেন। হযরত আবু হুরায়রার বর্ণনায় আল্লাহর নবী বলেন, পারস্যের এক ব্যক্তি আকাশের দুর্গম সুরাইয়া তারকা হতে দ্বীনত্বে আতœস্থ করতে সক্ষম হবে। (বুখারীর হাদিস নম্বর ৪৮৯৭ ও মুসলিম হাদিস নম্বর ২৫৪৬)
৫। ফলে শতাব্দি পরম্পরা চলে আসা হানাফী মাযহাবের মুকাল্লিদগণ ইমাম সাহেব কেরাত বড় করে পড়ুক মুসল্লিগণ নীরব থাকবে, যারা উল্টা বলে বা করে স্বশব্দে কিরাত পড়ার নামাজের বড় জামাতের পিছনের কাতারে ইমামের আওয়াজ শুনা না গেলে তারা ফাতেহা পড়ে? নামাজির হাত ও মহিলাদের মত বুকে না বেধে নাভির নিচে বাধবে, পুরুষ ও মহিলাদের শারীরিক পার্থক্যের কারণে সারা শরীর ঢাকার মতো নামাজেও তাদের কিছু কিছু পার্থক্য রয়েছে। কেননা ইমামের কেরাত মুক্তাদির কেরাত এবং হুযুর (সা:) “ওয়ালাদ দোয়াল্লীন” প্রসিদ্ধ সাহাবাদের আমলের কারণে অত্যাধিক আমলযোগ্য বলেই ইমাম আজম এসবকে সুন্নত হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন এবং পুরুষের নাভির নিচে হাত বাধাও এভাবে প্রমাণিত। তাই ফাতুহুল গফুরের ১৮ পৃষ্ঠায় হযরত বড়পীর (র:) নাভীর নিচে হাত বাধতে বলেছেন। যারা উল্টা বলে বা করে তাদের জন্য শিক্ষণীয় ব্যাপার যে, খোদ ইমাম শাফি (র:) একবার ইমাম আজমের জিয়ারত গিয়ে ১ম তাকবীরের পর আর কোন তাকবীরে হাত না তোলায় তার শিষ্যদের জবাবে তিনি বলেন যে, ইমাম আজমের এলাকায় তার মাযহাবকে শ্রদ্ধা করলাম। তিনি আরো বলেন যে, ফিকাহ জানতে ইচ্ছুক ব্যক্তি যেন আবু হানিফা ও তার অনুসারীদের খুঁজে। ফিকাহ এর জগতে বিশ্ব মুসলিম আবু হানিফার উত্তরাধিকারী। ১৪০০ বছর পর ঈদের নামাযের তাকবীর ১২ টি এবং তারাবির নামাজ ৮ রাকাত বলে (নাউজুবিল্লাহ) নাম প্রচারে ইচ্ছুক এসব ইবাদত নিয়ে মশকরাকারীদের দলভুক্ত হওয়া যাবে না। কারণ ইসলামের খলিফা, সাহাবী ও তাবেঈদের মত তারাবি ২০ রাকাত ও ঈদের তাকবীর ৬টি ১৩/১৪ বছর হতে প্রচলিত। যা অদ্যাবধি উভয় হেরম শরীফে চালু আছে।
৬। কোন মাজুর মুসল্লি চেয়ারে বসেও দাঁড়াতে পারলে তাকে কাতার বরাবর দাঁড়াতে হবে, নতুবা জামাতে শরীয়তের প্রতিষ্ঠিত শৃঙ্খলা ও সুন্নাতে মুয়াক্কাদা তরক হবে। মূলত শরীয়তে চেয়ারে বসার কোন সুরত নেই। দরকার হলে বসে বা শুয়ে নামাজ আদায় করবে এবং জুতা রাখার নামে বা কাতার পূর্ণ করার নামে কোন মুসল্লির নামাজের আগ দিয়ে বা কাধের উপর পা দিয়ে যাওয়া যাবে না। যাকে হাদিস শরীফে আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম শয়তান বলে প্রতিহত করতে বলেছেন। জুতার বাক্স পাশে রাখা এবং আগে কাতার পূর্ণ করা সংশ্লিষ্টদের উচিত। আল্লাহর সর্বোপরি আল্লাহর নবীর প্রতিষ্ঠিত বিবাহের পাত্রীকে দৃষ্টিনন্দনভাবে সাজিয়ে সবার জন্য উন্মুক্ত করে বসিয়ে রাখা, খোলাখুলিভাবে ভিডিও, করা মহিলা পুরুষের অবাধ মেলামেশা, পাত্র পক্ষের অলিমার পরিবর্তে পাত্রী পক্ষের বৈরাতী খানা, অপচয়সহ যাবতীয় শরীয়ত বিরোধী কার্যক্রম পরিহার করে পাত্র-পাত্রীর অনাগত ভবিষ্যতের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের রহমত ও সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা সাধনা করার জন্য সকলের প্রতি একান্ত পরামর্শ রইল।
৭। এসব মাযহাব বিরোধী কাজ করতে গিয়ে যারা আল্লাহর ঘরের মুসল্লিদের উদাহরণ দেয়, তাদের নিকট প্রশ্ন ১৩/১৪ শত শতাব্দি পূর্বে এই চার মাযহাবের ইমামদের জন্ম কোথায় ছিল? তারা কি ভারতীয় ছিলেন নাকি বর্তমানে হেরেম শরীফের নামাজের সম্মানিত ইমামদের ইলম তৎকালীন মাযহাবের ইমামদের চেয়েও বেশি?
৮। শত বৎসর পূর্বে আকিদাগত জটিল মাসালা ভারতীয় আলেমগণ তিন দলে বিভক্ত হলেও বর্তমানে আলেমগণ ওগুলোর উপরন্তু মুস্তাহাবি ফাযায়েলী মাসআলার বিরুদ্ধেও বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত। দেশ বিদেশে ইসলামকে মৌলবাদ ও জিহাদকে জঙ্গিবাদ বানাবার এই ক্রান্তিলগ্নে ওলামা-মাশাযয়েখদের প্রতি মাযহাবের ইমামদের মত ইত্বেফাক মায়াল ইখতেলাফের ভিত্তিতে কোরআনুল কারিমের ১১/১২টি আয়াতের আলোকে সুন্নতকে মূলমন্ত্র করে বৃহত্তর ঐক্য গড়ার জন্য সবিনয় অনুরোধ রইল।
সর্বোপরি ওহীর জ্ঞান প্রকৃত জ্ঞান এবং দুনিয়ার সারাজীবন আখেরাতের একদিন বিধায় প্রতিটি পরিবারের একজন ছেলেকে দিনের আলেম বানাবার জন্য মা-বোনদের প্রতি একান্ত পরামর্শ পরামর্শ রইল ।