শান্তি চুক্তির বিরুদ্ধে নয়, পাহাড়ি-বাঙালি দ্বন্ধের যৌক্তিক সমাধানের লক্ষ্যে ‘সমঅধিকার আন্দোলন’ করছি : জাহাঙ্গীর কামাল

744
মো. জাহঙ্গীর কামাল- সমঅধিকার আন্দোলন নেতা
মো. জাহঙ্গীর কামাল- সমঅধিকার আন্দোলন নেতা

শামীমুল আহসান- ঢাকা ব্যুরোপ্রধান, ২৬ নভেম্বর ২০১৫, দৈনিক রাঙামাটি : দেশের সৌন্দর্যের রানী বলে খ্যাত পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলা- রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির উস্কানিতে একটি উপজাতি গ্রুপ বাঙালি জাতিসত্ত্বার বিরোধ করে পার্বত্য উপজাতিয়সত্ত্বার দাবীতে আন্দলনে নামেন। এর পরে তারা শান্তিবাহিনী প্রতিষ্ঠা করে; দিনে দিনে তাদের সে আন্দলন স্বায়ত্বশাসনের দাবিতে পরিনত হয়। পরে দেশের বিগত সরকারগুলো ও পাহাড়ি উপজাতিদের পক্ষে শান্তিবাহিনীর সাথে দীর্ঘদিনের সংঘাত চলতে থাকে। সংঘাতে মারা যান দেশের হাজার হাজার উপজাতি, সাধারণ বাঙালি, পুলিশ ও সেনা সদস্যরা।

চলমান এ সহিংসতা বন্ধের লক্ষে আওয়ামী লীগ  সরকার ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর জনস্বার্থ, রাষ্ট্রের আভ্যান্তরীন শান্তিশৃঙ্খলা ও সার্বভৌমত্ব বজায় রাখতে রাষ্ট্রের সাথে শান্তিবাহিনীর একটি চুক্তি স্বাক্ষরীত। যা শান্তিচুক্তি হিসেবে আখ্যায়িত হয়। অপরদিকে শান্তিচুক্তির ফলে পার্বত্য জেলার বাঙালি স¤প্রদায়ের স্বার্থক্ষুন্ন ও সংবিধান লঙ্গন হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। ফলে বাঙালি স¤প্রদায় সমঅধিকার আন্দোলনের ডাক দেয়। রাঙামাটি পার্বত্য জেলার সমাজকর্মী জাহাঙ্গীর কামাল এ আন্দোলনের কেন্দ্রীয় লিয়াজো কমিটি ও রাঙ্গামাটি জেলার একজন সক্রিয় সদস্য। প্রথম দিকেই তিনি সমঅধিকার আন্দোলনের রাঙ্গামাটি জেলার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। শুরুতে তার নেতৃত্বেই সমঅধিকার আন্দোলন বেগবান হতে থাকে। তার অভিজ্ঞতার আলোকে সমঅধিকার আন্দোলনের গত ১৮ বছরের প্রেক্ষপট তুলে ধরা হলো-

– সমঅধিকার আন্দোলন কেন করছেন ?
* এককথায় পাহাড়ি জনপদ রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবনের সকল বাঙালি স¤প্রদায়ের স্বার্থরক্ষা ও      সাংবিধানিক অধিকার আদায়ের জন্য আমরা ‘সমঅধিকার আন্দোলন’ করছি।

– বলা হয়ে থাকে মূলত: শান্তি চুক্তির বিরুদ্ধে আপনারা ‘সমঅধিকার আন্দোলন’ করছেন ?
* একথা সত্য নয়। শান্তি চুক্তির বিরুদ্ধে নয়, পাহাড়ি-বাঙালি দ্বন্ধের যৌক্তিক সমাধানের লক্ষ্যেই আমরা  ‘সমঅধিকার আন্দোলন’ করছি। অর্থাৎ শান্তি চুক্তির ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালিসম্প্রদায়ের যে সাংবিধানিক অধিকার হরণ করা হয়েছে, তা আদায় করার লক্ষ্যে আমাদেও এ আন্দোলন।

– ১৮ বছর তো পারকরলেন আর কত দিন এ আন্দোলন চলবে ?
* যতদিন পর্যন্ত সমঅধিকার বাস্তবায়ণ না হবে ততদিন।

– শান্তিচুক্তিতে কি ভাবে বাঙালিদের অধিকার হরণ করা হয়েছে বলে মনে করেন ?
* শান্তিচুক্তির প্রেক্ষাপট মুলত দেশের সকল জনগণের কমবেশি জানা আছে। আমরা পাহাড়ি জনপদের বাঙালিরা জন্মগত ও রাষ্ট্রীয় ভাবে স্থায়ী নাগরিক। হাজার বছর ধরে বংশানুক্রমে এখানে বাঙালি স¤প্রদায়ের বসবাস। পক্ষান্তরে উপজাতি স¤প্রদায় ৪০০ বছরের (কমবেশি) বসবাসের ঐতিহ্য নিয়ে এই ভূখন্ডের মূল বসবাসকারী সম্প্রদায় দাবী করে স্বাধীনতার পর থেকে এ অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলেছেন। ইতিহাস তার স্বাক্ষী। ইতিপূর্বে উপজাতিদেরও পাহাড়ি জনপদের বসবাসের ঐতিহ্য তৈরী হয়েছে সত্য। তাদের আলাদা ধর্ম, সংস্কৃতি রয়েছে। তাদের নাগরিক ঐতিহ্য আমরা কিছুতেই অস্বীকার করছি না। কখনো করবও না। কিন্তু তারা বর্তমানে পাহাড়ি জনপদে বাঙালিদের অস্তিত্বসহ্য করতে চাইছেনা। এটাই আপত্তি কর।

শান্তিচুক্তির কিছু কিছু ধারা-উপধারায় বাঙালি স¤প্রদায়ের স্বার্থ সাংবিধানীক ভাবে ক্ষুন্ন করেছে। যেমন: এক. চুক্তির কারনে পাহাড়ি বাঙালি বা অন্য নাগরিকদের পাহাড়ি জনপদে জমি কিনতে হলে হেড ম্যানের অনুমতি দরকার হয়। যা সংবিধানের পরিপন্থি। অথচ পাহাড়ি উপজাতিরা পাহাড়তো বটেই দেশের অন্য কোথাও জমি কিনতে কারো অনুমতির প্রয়োজন হবে না। দুই. চুক্তিতে দেশের স্বাভাবিক রাজনীতিতে নাগরিকদের যে সব রাজনৈতিক সুবিধা দেওয়া আছে তার সব সুবিধা পাহাড়ে বিদ্যমান অবস্থায় চুক্তির মাধ্যমে উপজাতিদের বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়েছে। যার ফলে পাহাড়ে বসবাসরত বাঙালিরা উপজাতিদের কাছে কোনঠাসা হয়ে আছে। তিন. অর্থনৈতিক দিক থেকে পাহাড়ি উপজাতিরা অনেক সুবিধা ভোগ করছেন। চাকরিতে তাদের অগ্রাদীকার দেওয়া হয়েছে। আয়কর মুক্তকরে ব্যবসায় অগ্রাদীকার দেওয়া হয়েছে। শিক্ষ ফ্রি। এনজিওর মাধ্যমে উপজাতিরা অতিরিক্ত অর্থনৈতিক সুবিধা পাচ্ছেন। পক্ষান্তরে বাঙালি স¤প্রদায়কে কোন প্রকার অগ্রাদীকার দেয়া হয়নি। ব্যবসায়ের স্বাভিক আয়কর যুক্ত থাকায় আমরা বাঙ্গালি স¤প্রদায় উপজাতি স¤প্রদায়ের কাছে অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়ছি। এগিয়ে যাচ্ছেন উপজাতিরা। তারা সরকারকে রাজস্ব না দিয়েও সুবিধা ভোগ করছেন। আমরা রাজস্ব দিয়েও সুবিধা বঞ্চিত হচ্ছি। এসব দাবিতেই সমঅধিকার আন্দোলন।

– সমঅধিকার আন্দোলন কতটা সফল বলে মনে করছেন ?
* সফলতা মূলত আপেক্ষিক। শান্তিচুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান করার পর থেকে সফলতার যে আশাকরা হয়েছিলো তা আন্দোলনেই সিমিত রয়েছে। তবে সমঅধিকার আন্দোলন করে আমরা দেশ ও জাতিকে একটা বার্তা দিতে পেরেছি তাতে সন্দেহ নেই।

– উপজাতি স¤প্রদায় শান্তিচুক্তির দ্রুত বাস্তবায়ন চেয়ে আন্দোলন করছে । দেশের নাগরিক সমাজ, সুশিল সমাজ তাদের সাথে স¤পৃক্ত হয়েছেন। আপনার অভিমত কি ?
* শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের দায়িত্ব সরকারের। ইতিমধ্যে ১৮টি বছর পার হয়েছে। সরকারের দাবি শান্তিচুক্তির প্রায় ৯০ ভাগ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। বাকি মাত্র ১০ ভাগ। সেই ১০ ভাগ বাস্তবায়নের জন্য যে আন্দোলন চলছে তাতে মনে হয় শান্তিচুক্তির কোনটাই বাস্তবায়ন হয়নি। মাঝে মধ্যে মনে হয় উপজাতিরা আবার যুদ্ধে যাবেন। গত দুই তিন বছরে পাহাড়ি নেতা শ্রদ্ধেয় সন্তুলারমার বক্তব্যগুলো পর্যালোচনা করলে মনে হয় তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম স্বাধীন করতে যাচ্ছেন। আর নাগরিক সমাজ সুধী সমাজের নামে যারা তাদের আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করছেন তারা মূলত এনজিও ব্যবসায়ী ও বাম রাজনৈতিক মতাদ্বর্শে বিশ্বাসী। এ দেশের বাম রাজনীতির ধারা সবসময় আমাদের সামাজিক চাহিদার বিপরীতমূখী ও ধর্মীয় সমাজ ব্যবস্থার সাথে সাংঘর্সিক। এক্ষেত্রে তারা সমাজটাকে একচোখে দেখেন। তারা মনে করেন সমাজ হবে তাদের দৃষ্টিকোনে। এই জন্য তারা দেশের উপজাতি স¤প্রদায়কে ব্যবহার করতে চাচ্ছেন বলে মনে হয়। তবে ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয় বাম মতাদর্শের প্রভাব কখনই দেশের বৃহত্তর সমাজকে প্রতিনিধিত্ব করেনি। সবসময় নেপথ্যেই বাম রাজনীতি সীমাবদ্ধ থাকে।

– উপজাতিদের ভূমিতে বাঙালীরা অবৈধভাবে দখল নিয়ে অধিকার প্রতিষ্ঠা করছে। এমন অভিযোগ সবসময়ই উপজাতি স¤প্রদায় করে আসছেন। আপনার বক্তব্য কি ?
* এ অভিযোগ মিথ্যা, বানোয়াট ও মনগড়া। জন্মগতভাবে আমরা রাঙ্গামাটি জেলা সদরের বাসিন্দা। আমার বাবা জেলা সদরে স্কুল শিক্ষক ছিলেন। আমার পরিবারের মতো হাজার হাজার পরিবার সমস্ত পাবর্ত্য অঞ্চলে বসবাস করে আসছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাহাড়ি জনপদ আবাদের লক্ষ্যে বিগত সরকার খাস জমি দেশের ভূমিহীন কৃষক ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে লীজদিয়ে, বরাদ্দ দিয়ে আবাদ করে আসছে। সরকারের যে খাস জমিগুলো আবাদের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয় তাতে উপজাতিরাও বরাদ্দ পায়। বিশেষ করে রাবার চাষের জন্য। আমার জানামতে কারো কোন রেকর্ডি জমি সরকার লীজদেয়নি। তবে কোথাও কোথাও লীজপ্রাপ্ত সম্পত্তিতে উপজাতিরা বিনা নোটিশে বসবাস ও ভোগ দখল করতো। এমন কিছু সম্পত্তির বিষয় আপত্তি করায় সরকারকে ভূমি কমিশন গঠন করতে হয়েছে। কমিশন সে বিষয় সিদ্ধান্ত দিবেন।  কিন্তু ঢালাও ভাবে যে অভিযোগ করা হচ্ছে তা সত্যি নয়। এমন অভিযোগ এনে মূলত জাতিকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

-দেশের নাগরিক সমাজের অন্যতম দাবি ‘সেটেলার বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মান জনক ভাবে পূনবাসন’ করার। এ দাবির বিষয়ে আপনার বক্তব্য কি ?
* সেটেলাইট বলতে মরহুম জিয়াউর রহমানের সরকার ও জাতিয় পাটির নেতা এরশাদ সরকারের সময়  যে সকল ভূমিহীন নাগরিকদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চল  থেকে এনে পার্বত্য চট্টগ্রামে পূনর্বাসন করা হয়; তারা। সরকার তাদের প্রত্যেক পরিবারকে যে পাঁচ একর জমি বরাদ্দদেয় তা সরকারী অনাবাদি খাস জমি। কারো রেকর্ডকৃত জমি নয়। কাজেই নাগরিক সমাজের এ দাবি অমানবিক। সেই সাথে মানবাধিকার লঙ্গনের সামিল।

– উপজাতিদের পার্বত্য চট্টগ্রাম শায়ত্ব শাসনের দাবী কতটা যৌক্তিক বলে মনে করেন ?
* স্বাধীনতাযুদ্ধ দেশের বহুস¤প্রদায়ের মানুষের দাবীর ফসল। তা ছিল দেশের ভাষা, অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য। একটি স্বাধীন দেশের অল্প সংখ্যক মানুষের একটি ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বার শায়ত্বশাসন দাবী কোনক্রমেই যৌক্তিক মনে করি না। তারপরও উপজাতি স¤প্রদায়ের বাঙালি জাতিসত্ত্বা না মেনে মন গড়া ভাবে শায়ত্বশাসন দাবী ঐদত্যপূর্ণ এবং রাষ্ট্রদ্রহীতার সামিল মনে করি।

– এ বিষয় আপনার মতামত কি ?
* রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল ব্যক্তি, রাজনীতিবীদ, সুশিল সমাজ ও নাগরিক সমাজকে অবশ্যই এনিয়ে ভাবতে হবে।

Ñ শান্তিচুক্তিতে সাংবিধানিক যে সকল অধিকার হরণ করা হয়েছে তা রক্ষাত্রে সমঅধিকার আন্দোলনের পরবর্তি কার্যক্রম কি হবে ?
* ইতিপূর্বে আমরা যে ভাবে আন্দোলন করে এসেছি তা মূলত শান্তিপূর্ণ ছিল। আগামী দিন গুলিতে তেমনি শান্তিপূর্ণ আন্দোলন আমরা করব। কোন সহিংসতাকে আমরা প্রশ্রয় দেইনি। আগামিতেও কোন সহিংসতাকে আমরা প্রশ্রয় দিব না। কেননা, আমাদের আন্দোলন বাঙালি স¤প্রদায়ের পার্বত্য চট্টগ্রামে সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করে বসবাসের আন্দোলন। কারো ব্যক্তিগত আন্দোলন নয়।

তবে সরকারের কাছে আমি ব্যক্তিগত ভাবে আবেদন করছি, সরকার যেন সমঅধিকারের দাবিগুলো  আমলে নেন।