কাপ্তাই হ্রদের বিস্তীর্ণ এলাকায় এ বছরও কচুরিপানার জঞ্জাল ॥ ব্যাহত নৌ চলাচল

348

॥ স্টাফ রিপোর্টার ॥

এ বছরও রাঙামাটির মানুষের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে কচুরিপানা। হুমকিতে পড়েছে দেশের বৃহত্তম কাপ্তাই হ্রদের পরিবেশ। কর্ণফূলি হ্রদের বিস্তীর্ণ এলাকা কচুরিপানায় ছেয়ে গেছে। এতে যেম ব্যাহত হচ্ছে নৌ চলাচল, তেমনি হুমকিতে পড়েছে মাছের বৃদ্ধি এবং দূষিত হয়ে পড়েছে কাপ্তাই হ্রদের পানি। কয়েক বছর আগে কাপ্তাই হ্রদে এভাবেই কচুরিপানার বিড়ম্বনা দেখা দিলে নানা কসরতে তা অপসারণ করা হয়েছিল। কিন্তু তারপর কোনো ফলোআপ না থাকায় আবারও এই জঞ্জাল দেখা দিয়েছে বলে মনে করছে সাধারণ মানুষ।

জেলার দশটি উপজেলার মধ্যে সাতটির সাথেই যোগাযোগ মূলত নৌ পথেই। ৭৩০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের সুবিশাল কাপ্তাই হ্রদে জালের মতো ঘিরে রেখেছে এই জেলাকে। হ্রদে নৌ যান চলাচল যেমন বিঘিœত হচ্ছে তেমনী কচুরিপানা পঁচে গলে হ্রদের পানিকে দূষিত করে তুলছে। এ অবস্থায় হ্রদের পানি ব্যবহার করে মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

জরজমিনে দেখা যায়, কাপ্তাই হ্রদের অভ্যন্তরে মাইলের পর মাইল এলাকায় ভয়াবহ বিস্তার ঘটেছে কচুরিপানার। হ্রদে জমে থাকা কচুরিপানার জঞ্জালের কারণে শহরের অভ্যন্তরে নৌ চলাচলও বিঘিœত হচ্ছে। দৃশ্যত, কাপ্তাই ও রাঙ্গামাটি শহর ঘিরে থাকা এই হ্রদটি এখন কচুরিপানারই দখলে। জঞ্জালের কারণে সাপ ও মশাও এখানে আবাস গড়ে তুলেছে। বেড়েছে এসবের উপদ্রবও।

বিশেষ করে বর্তমানে যে স্থানটিতে কচুরিপানা বেশি ভোগাচ্ছে যাতায়াতকারিদের সেটি হলো সুবলং চ্যানেল। পাহাড়ে ঘেরা এই স্থানটি পার হয়েই যেতে হয় নয়াভিরাম সুবলং ঝর্ণায়। আর যেটি রাঙামাটিতে বেড়াতে আসা পর্যটকদের অবশ্যাম্ভাবি গন্তব্য।

স্থানীয় ও ভুক্তভোগীরা জানান, প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে সীমান্ত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কচুরিপানা এসে হ্রদে একাকার হয়ে জঞ্জালের সৃষ্টি হয়। দূর থেকে দেখে মনে হবে ছোট ছোট সবুজ ঘাসে ভরা এটি কোন খেলার মাঠ। কিন্তু না এটি কোন খেলার মাঠ নয়, এটি কচুরিপানার জঞ্জাল। ফলে রাঙ্গামাটি শহরের সাথে নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল হবার উপক্রম।

আর প্রতি বছরই বর্ষা মৌসুমে কাপ্তাই লেকের পানি বেড়ে গেলে এই কচুরিপানার ঝঞ্জাল এসে জড়ো হয় হ্রদ তীরবর্তী শহরের বাজারে। ফলে দূর দুরান্ত থেকে চাষিরা ইঞ্জিন চালিত বোট ও নৌকাযোগে তাদের উৎপাদিত পন্য নিয়ে বাজারে বিক্রি করতে আসলে পোহাতে হয় নির্মম দূর্ভোগ। ঘন্টার পর ঘন্টা আটকে পরে থাকে কচুরিপানার ঝঞ্জালে।

স্থানীয়রা জানান, কাপ্তাই হ্রদে রাঙ্গামাটি সদর থেকে কাপ্তাই উপজেলা জেটিঘাট, বিলাইছড়ি, জুরাছড়ি, লংগদু, বরকল, বাঘাইছড়ি, ফারুয়া, হরিনছড়াসহ বিভিন্ন জায়গায় প্রতিদিন যাত্রীবাহি অসংখ্য ছোট বড় ইঞ্জিন চালিত বোট এই নৌপথে চলাচল করে। এছাড়া সাপ্তাহিক হাট বাজারে পণ্যবাহী বোটও চলাচল করে এই নৌ পথে। রাঙ্গামাটির সুবলং ঝর্ণা ও বিলাইছড়ি উপজেলার বিভিন্ন ঝর্নাগুলো দেখার জন্য এই মৌসুমে অসংখ্য পর্যটক চলাচল করে এই পথে।

বোট চালক মনোরঞ্জন চাকমা জানান, প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে পানি বাড়ার সাথে সাথে পাহাড়ী ঢলের সাথে এই কচুরিপানা কাপ্তাই লেকে চলে আসে। শীতকাল পর্যন্ত এই কচুরিপানা থাকবে। যার ফলে স্বাভাবিক গতিতে আমরা বোট চালাতে পারি না। আর স্বাভাবিক ভাবে রাঙ্গামাটি সদর ও কাপ্তাই জেটিঘাট হতে বিলাইছড়ি পর্যন্ত নৌপথে ইঞ্জিন চালিত বোট দিয়ে যেতে যেখানে গড়ে ১ঘন্টা ২০ মিনিট হতে দেড় ঘন্টা লাগে। বর্তমানে এই কচুরিপানা জঞ্জালের কারণে ২ ঘন্টা থেকে আড়াই ঘন্টা সময় লাগছে। এতে করে সময় যেমন অপচয় হচ্ছে তেমনী মানুষের দূর্ভোগ পৌহাতে হচ্ছে।

ইঞ্জিন চালিত নৌযান করে বাজারে কাঁচা মালামাল বিক্রি করতে আসা শান্তি রঞ্জন চাকমা ও কিনা চাঁন তংচঙ্গ্যা জানান, কাপ্তাই হ্রদের কচুরিপানার যানজটের ফলে ২মিনিটের স্থান পৌছাতে এখন সময় লাগে ১/দেড় ঘন্টা। এতে বাজারে বিক্রি করতে নিয়ে আসা আমাদের কাঁচা শাকসবজি পথে মধ্যে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তা ছাড়া দু’মিনিটের পথ অতিক্রান্ত করতে বহু ইঞ্জিন চালিত নৌকার প্রায় ১০ থেকে ১৫ লিটার তেল খরচ হচ্ছে। বহু ইঞ্জিন চালিত নৌযানের পাখা কচুরিপানার কারনে ভেঙ্গে যাচ্ছে।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, দিনের পর দিন এই করুন অবস্থার সৃষ্টি হলেও সংশ্লিষ্ট প্রশাসন কোন উদ্যোগ গ্রহন না করায় দিন দিন কচুরীপানার জঞ্জাল পুরো কাপ্তাই হ্রদে ছড়িয়ে যাচ্ছে। এতে করে মৎস্যজীবি ও নৌ যানে চলাচলরত মানুষের দূর্ভোগও বেড়ে যাচ্ছে। আর পাহাড়ি এলাকার অধিবাসীদের পানীয় জল এবং যাবতীয় ব্যবহার্য পানির জন্য কাপ্তাই হ্রদের পানি ব্যবহৃত হয়। ফলে হ্রদের পানি বিশুদ্ধ না থাকায় এবং পানি বিশুদ্ধকরণের ব্যবস্থা না থাকায় এখানকার মানুষ বাধ্য হয়ে দূষিত পানি ব্যবহার করছে।
হ্রদের পানিতে কচুরিপানা জমাট বেধে থাকায় বড় নৌযান কোন মতে চলতে পারলেও ছোট নৌযান চলাচল তীব্র বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। তাই দ্রুত কচুরিপানা অপসারণের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগ নেয়ার দাবি জানিয়েছে ভুক্তভোগীরা।

রাঙ্গামাটির শহরের আনাচে কানাচে কাপ্তাই হ্রদে কচুরী পানার জঞ্জালের কথা স্বীকার করে বিএফডিসি রাঙ্গামাটি ব্যবস্থাপক লে. কমান্ডার এম তৌহিদুল ইসলাম জানান, কাপ্তাই হ্রদে কচুরিপানার কুপ বা জট যেখানে যেখানে আছে একটু বাধার সৃষ্টি করছে। বিশেষ করে কাপ্তাই হ্রদের কাইন্দার মুখে প্রায় ১০ দিন যাবত কচুরিপানা জঞ্জাল লেগেছিলো। রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের নিদের্শে রাঙ্গামাটি লঞ্চ মালিক-শ্রমিক সংস্থার উদ্যোগে ও বিএফডিসি’র ব্যবস্থাপনায় তিনটি লঞ্চ ব্যবহার করে কাপ্তাই হ্রদে কচুরীপানা জঞ্জাল অপসারণের কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। আশাকরি কয়েকদিনের মধ্যে হ্রদে যাতায়াতকারী নৌযানগুলো কচুরিপানার কারণে বিড়ম্বনায় পড়তে হবে না।

রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আশরাফুল ইসলাম জানান, কাপ্তাই হ্রদে কচুরিপানা নির্মূলে একটা স্থায়ী ব্যবস্থা নেয়ার প্রয়োজন। কাপ্তাই হ্রদে কচুরিপানার অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের সাথে এই বিষয়টি নিয়ে আলাপ করা হবে বলে জানান তিনি।
রাঙ্গামাটি লঞ্চ মালিক সমিতির সভাপতি মঈন উদ্দীন সেলিম জানান, কাপ্তাই হ্রদে কচুরিপানা জন্য সুবলং, বরকল, জুরাছড়ি, বিলাইছড়িসহ বিভিন্ন জায়গায় নৌ চলাচলে সমস্যায় পড়তে হয়। এছাড়াও যাত্রী পরিবহন ও প্রয়োজনীয় মালামাল পরিবহনেও কচুরিপানা জঞ্জালের প্রভাব ফেলে। কচুরিপানা অপসারণ করা খুবই জরুরী হয়ে পড়েছে। এজন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জরুরী হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।

রাঙ্গামাটি পর্যটন ঘাটের ট্যুরিষ্ট বোট চালকদের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা রমজান আলী বলেন, প্রতি বছরই বর্ষা মৌসুমে সীমান্ত থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলের কারণে এই কচুরিপানার দুর্ভোগ পোহাতে হয় আমাদের। এই বছর করোনার কারণে দীর্ঘ লকডাউন শেষে যখন পর্যটকরা আসতে শুরু করেছে, ঠিক তখনই কচুরিপানার কারণে পর্যটক পরিবহন সমস্যা শুরু হয়েছে। এই সমস্যার স্থায়ী সুরাহা করা না হলে আমাদের ব্যাপক ক্ষতি হবে বলে জানান তিনি।