রাঙামাটিতে পূর্ণিমা চাকমা হত্যার বিচারসহ জড়িতদের ফাঁসির দাবিতে মানববন্ধন

594

॥ স্টাফ রিপোর্টার ॥

রাঙামাটিতে কলেজছাত্রী পূর্ণিমা চাকমার রহস্যজনক মৃত্যু ঘিরে এলাকাজুড়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। এ ঘটনায় বেরিয়ে আসছে অনেক তথ্য। উন্মোচিত হচ্ছে আসল রহস্য। ঘটনার প্রতিবাদ আর বিক্ষোভে ফেটে পড়েছেন পূর্ণিমার স্বজন ও কলেজ শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন মহল। ঘটনাটিকে পরিকল্পিত হত্যাকান্ড উল্লেখ করে এর সুষ্ঠু বিচারসহ জড়িতদের ফাঁসির দাবি করেছেন তারা। দাবিটি নিয়ে নেমেছেন আন্দোলনে।

সোমবার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন এবং পরে রাঙামাটি রিপোর্টার্স ইউনিটি সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে অবিলম্বে পূর্ণিমা চাকমার হত্যার সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে দোষীদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির দাবি করেছেন নিহত কলেজছাত্রীর পরিবার, স্বজন, কলেজশিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন মহল। জানা যায়, রাঙামাটি সরকারি মহিলা কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী পূর্ণিমা চাকমা থাকত শহরের রাজবাড়ি এলাকায় একটি ভাড়া বাসায়। সে জেলার জুরাছড়ি উপজেলার ভারতের মিজোরাম সীমান্তবর্তী দুমদুম্যা ইউনিয়নের বগাখালী নামক পাহাড়ি গ্রামের সাধন চাকমার মেয়ে।

২৮ অক্টোবর দুপুরের দিকে অচেতন অবস্থায় পূর্ণিমাকে নিয়ে যাওয়া হয় রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালে। ওই সময় তাকে মৃত ঘোষণা করেন কর্তব্যরত চিকিৎসক। কিন্তু পূর্ণিমাকে মৃত ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই পালিয়ে যায় তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া বাসা মালিকের লোকজন। পরে তারা ঘটনাটিকে কেউ আত্মহত্যা আবার কেউ স্ট্রোক করে পূর্ণিমা মারা যায় বলে অসংলগ্ন কথাবার্তা চালিয়ে যাওয়া চেষ্টা করে এবং ঘটনার পর থেকে পূর্ণিমার বাসার মালিক মল্লিকা চাকমাসহ তার পরিবারের অন্য লোকজন পলাতক রয়েছে বলে অভিযোগ করছেন, পূর্ণিমার স্বজনরা।

ঘটনার বিষয়ে পূর্ণিমার বাবা সাধন চাকমা দাবি করে বলেছেন, আমার মেয়ে (পূর্ণিমা চাকমা) আত্মহত্যা করেনি। সে কোনো অবস্থাতেই আত্মহত্যা করার মেয়ে না। অন্য কোনোভাবেও সে মারা যায়নি। কারণ সে সম্পূর্ণ সুস্থ ছিল। ঘটনার আগের দিনও মেয়ের সঙ্গে আমার ফোনে কথাবার্তা হয়েছে। আমার মেয়েকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে। আমি মেয়ের হত্যার বিচার চাই। আমার একমাত্র দাবি খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি। আমার মেয়ের স্বপ্ন ছিল একজন চিকিৎসক হয়ে মানুষের সেবা করা। সেজন্য সেই দুর্গম এলাকা থেকে এসে রাঙামাটি সরকারি মহিলা কলেজে ভর্তি হয়ে পড়ালেখা করছিল সে। আমাদের গ্রাম থেকে রাঙামাটি শহরে যাওয়া-আসায় সময় লাগে চার দিন। এসব কষ্ট শিকার করে আমার মেয়ে শহরে এসে পড়ালেখা করছিল। অথচ খুনিরা আজ মেয়ের স্বপ্ন শেষ করে দিলো।

এদিকে ঘটনার প্রতিবাদ ও বিচার দাবিতে সোমবার সকালে রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে দুই ঘন্টাব্যাপী মানবন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়। পূর্ণিমার পরিবার, স্বজনসহ রাঙামাটি সরকারি মহিলা কলেজ, লেকার্স পাবলিক কলেজ, রাঙামাটি পাবলিক কলেজ, সরকারি কলেজসহ বিভিন্ন কলেজের অসংখ্য শিক্ষার্থী যোগ দেন। এ সময় বিক্ষোভে ফেটে পড়েন তারা। মানববন্ধন চলাকালে বাসা মালিক মল্লিকা চাকমাসহ তার পরিবারের লোকেরা পূর্ণিমাকে নিষ্ঠুরতায় গলাটিপে হত্যা করেছে বলে দাবি করেন বিক্ষুব্দ লোকজন। তারা বলেন, পূর্ণিমাকে হত্যার ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে আত্মহত্যা বলে চালোনোর অপচেষ্টা করা হচ্ছে। এছাড়াও নানাভাবে দফারফার চেষ্টা করছে খুনিরা। পূর্ণিমার বাবাকে ১ লাখ টাকার অধিক ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছে মল্লিকার পরিবার। পূর্ণিমা যদি আত্মহত্যা করে থাকে তাহলে টাকা দিয়ে কেন দফারফার চেষ্টা করছে খুনিরা ?

এ সময় পূর্ণিমার মামাতো ভাই কাপ্তাই সুইডিশ পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের ছাত্র পলাশ চাকমা বলেন, পূর্ণিমা কোনোভাবেই আত্মহত্যা করেনি। সে ওই রকম মেয়ে না। পূর্ণিমাকে হত্যা করা হয়েছে। এখন আসল ঘটনা দামাচাপা দিতে নানাভাবে অপতৎপরতা চালােেনা হচ্ছে। পূর্ণিমার বাবাকে ক্ষতিপূরণ দিতে চাইছে বাড়ির মালিক। টাকা দিয়ে কী পূর্ণিমাকে ফিরে পাওয়া যাবে? তাই আমাদের দাবি খুনিদের ফাঁসি। আমরা খুব শিগগির পূর্ণিমা হত্যাকান্ডে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছি। পূর্ণিমার আরেক স্বজন ক্ষুদিরাম চাকমা বলেন, যেদিন পূর্ণিমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, সেদিন ঘটনার খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক আমি হাসপাতালে ছুটে যাই। গিয়ে দেখি পূর্ণিমার নিথর দেহ একলা পড়ে আছে। পাশে তখন আমি ছাড়া কেউ ছিল না। তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেও পূর্ণিমার মৃতদেহ ফেলে পালিয়ে গেছে বাসার মালিক মল্লিকা চাকমার পরিবারের লোকজন। লাশের দেহে আত্মহত্যার কোনো আলামতও ছিল না। শুধু গলায় সামনে জঘন্য আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে। বাসার মালিকের পক্ষে সিলিং ফ্যানে ওড়না জড়িয়ে পূর্ণিমা আত্মহত্যা করেছে বলা হলেও তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। কারণ গলায় ফাঁসের কোনো গোলাকার চিহ্ন নেই। তাছাড়া বাসায় যে রুমে পূর্ণিমা আত্মহত্যা করেছে বলা হয়েছে, সেখানে গিয়ে দেখা যায়- সিলিং ফ্যান লাগানো আছে অনেক উঁচুতে। পূর্ণিমা নিজে কীভাবে সিলিং ফ্যানে গলায় ওড়না পেঁছিয়েছে, তার কোনো রকম আলামতও নেই। তাই আমরা নিশ্চিত যে, নিষ্পাপ পূর্ণিমাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। তাছাড়া তারা যদি নির্দোষ হলে তাহলে কেন পালিয়ে গেল? আমরা পূর্ণিমা হত্যার বিচার চাই।

মানববন্ধন চলাকালে আরও বক্তব্য দেন- দুমদুম্যা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান রাজিয়া চাকমা, স্থানীয় মুরুব্বি মহারঞ্জন চাকমা, রাঙামাটি সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্রী সাধনা চাকমা, লেকার্স পাবলিক কলেজের শিক্ষার্থী বিনু চাকমা, বিএম ইন্সিিটউটের ছাত্র অর্পণ চাকমা, তরুণ চাকমা, দীপু চাকমা, রিপেন চাকমাসহ অন্যরা। মানববন্ধন শেষে দাবিটি নিয়ে রাঙামাটি রিপোর্টার্স ইউনিটির সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলন করা হয়েছে। এ সময় একই ভাড়া বাসায় পূর্ণিমার সঙ্গে থাকা দশম শ্রেণির ছাত্রী মোহিনী চাকমা জানায়, ঘটনার দিন আমি বাসায় ছিলাম না। পরে পূর্ণিমার মৃত্যুর খবর পেয়ে একেবারে হতভম্ভ হয়ে পড়ি।

পূর্ণিমার কয়েজন সহপাঠি বলেন, দীর্ঘদিন মালিকের কিছু সমস্যার কারণে পূর্ণিমা বাসা পাল্টানোর কথা বলেছিল। কিন্তু এভাবে তার হঠাৎ মৃত্যু, কখনও মেনে নেওয়া যায় না। আমরা ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষ এর সুষ্ঠু বিচার দাবি করছি। অপরপক্ষে ঘটনার বিষয়ে বারবার চেষ্টা করেও অভিযুক্ত মল্লিকা বা তার পরিবারের লোকজনের কারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। রাঙামাটি কতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. কবির হোসেন জানান, লাশের ময়নাতদন্তের পর থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা হয়েছে। এ ঘটনায় থানায় এখনও কেউ বাদী হয়ে মামলা দেয়নি। কেউ বাদী হয়ে মামলা দিলে তদন্তের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।