॥ আনোয়ার আল হক ॥
মুসলিম সমাজের জাতীয় ঐতিহ্য চেতনায় এবং ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনে রমজান একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আপনি (পাঠক) যে এই লেখাটি পড়ছেন; এই পড়াই প্রমাণ করে আপনার মাঝে ইসলামী চেতনা এবং তাক্কওয়া বিদ্যমান। আল্লাহর ভয় মনে না থাকলে রমজানের শিরোনামে প্রকাশ করা এই লেখাটি আপনি পড়ার গরজ অনুভব করতেন না। সুতরাং আমরা নির্দ্বিধায় একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, প্রতিটি মানুষের মাঝেই বিশেষ করে মুসলীম সমাজের অন্তর্ভূক্ত প্রতিটি ব্যক্তির মাঝে জন্মগতভাবেই একধরণের তাক্কওয়া বিদ্যমান। আর সে কারণেই রমজান আগমনের সাথে সাথে প্রতিটি মানুষের মাঝে আচরণে কিছু ভিন্নতা চলে আসে। যিনি রোজা রাখেন না, সেই লোকটিও রমজান মাসে বিভিন্ন পর্যায়ে নিজেকে সংযত রাখেন। এই যে সুপ্ত চেতনা; এই চেতনাই মুসলীম চেতনা বা ইসলামী চেতনা। তবে তাক্কওয়া বা খোদাভীতির কিছু স্তর রয়েছে। ব্যক্তির কর্মপন্থার উপর নির্ভর করে- তিনি তাক্কওয়ার কোন স্তরে অবস্থান করছেন।
মানব জাতিকে সংযমী চরিত্রের অধিকারী ও পুত পবিত্র তথা সংশোধন করার জন্য আল্ল¬াহ তায়ালা যে কয়টি মৌলিক ইবাদতের ব্যবস্থা করেছেন, রমজান মাসের রোজা তার মধ্যে অন্যতম। বছরে একবার এভাবে একমাস ব্যপী রোজা পালন বা সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মানুষ যাতে আগামী দিনগুলোতে আল্ল-াহর ভয়ে ভীত; তথা তাক্কওয়া সম্পন্ন, সংযমী, দায়িত্ববোধ ও সময়ানুবর্তিতায় পরিপূর্ণ এবং আল্লাহর হুকুম-আহকাম, আদেশ-নিষেধ পালনের মধ্য দিয়ে তার জীবনকে পরিচালনা করতে পারে আল্ল¬াহ সে জন্যই বছরে একবার মানুষের জন্য সিয়াম সাধনার ব্যবস্থা করেছেন। তাই এ মাসকে কোরআন ও হাদীসের অসংখ্য বর্ণনায় তাকওয়া অর্জন ও আত্মশুদ্ধির মাস বলা হয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাতসহ ইসলামে আনুষ্ঠানিক যে কয়টি ইবাদতের ব্যবস্থা রয়েছে, প্রতিটি ইবাদতেরই এক একটি বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে। আশরাফুল মাখলুক্কাত মানুষকে আল্লহ যেহেতু তাঁর খলিফা (প্রতিনিধি) হিসেবে সৃষ্টি করেছেন; এই প্রতিনিধিত্বের একটি বিশেষ লক্ষ্য রয়েছে। সেই লক্ষ্য পুরণের পথে এ ধরণের প্রতিটি আনুষ্ঠানিক ইবাদতই মুলতঃ মানুষের জন্য এক একটি ট্রেনিংকোর্স। প্রতিটি ইবাদতের উদ্দেশ্য অনুধাবনের জন্য প্রথমেই আমদের হৃদয়ঙ্গম করতে হবে মানুষের মুল দায়িত্ব কি? আল¬াহ রাব্বুল আলামীন তার সৃষ্টির অসংখ্য উপাদান ও বিষয়ের মধ্যে মানুষকে সর্বশ্রেষ্ঠ তথা আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কারণ শুধু মানুষের মাঝেই আল্ল¬াহ একইসাথে আবেগ, অনুভূতি, বিবেক, প্রজ্ঞা, কামনা বাসনাসহ যাবতীয় গুণাবলীর সমাবেশ ঘটিয়েছেন এবং বিচার বিবেচনার ক্ষমতা দিয়ে তাঁর আদেশ পালন করা ও না করার স্বাধীনতা প্রদান করেছেন। পৃথিবীর আর কোন প্রাণী বা আল্ল¬াহর সৃষ্ট সৃষ্টিকে এ সকল গুণ একসাথে প্রদান করা হয়নি বা এভাবে মানুষের মতো স্বাধীন করে দেয়া হয়নি। যেমন চন্দ্র-সূর্য্য, গ্রহ-নক্ষত্র, গাছপালা-তরুলতাসহ পৃথিবীতে আবহমান প্রতিটি জাত বা সৃষ্টিকেই আল্ল¬াহ এক একটি নিয়মের অধীন করে রেখেছেন, এরা কেউই সে নিয়মের ব্যতিক্রম বা ব্যত্তয় করতে পারে না। সূর্য্য চাইলেও তার পশ্চিমদিকে উদিত হবার সুযোগ নেই, নেই চন্দ্রের ক্ষমতা সূর্য্যরে কক্ষপথে প্রবেশ করার, রাত ও দিনের এই যে আবর্তন, এক আলোক বর্ষের বাইরে তা পরিবর্তিত হবার কোনো উপায় নেই। এভাবে প্রতিটি সৃষ্টিই এক একটি নিয়মের গন্ডিতে আবদ্ধ থেকে শ্রষ্টার ইচ্ছা পুরণ করছে। এদের কারো পক্ষেই এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। সূর্য কখনও নির্ধারিত সময়ের এক মূহুর্ত আগে বা পরে অস্ত বা উদীত হতে পারবে না। এভাবে মেঘ চাইলেও ভূমি থেকে নির্ধারিত উচ্চতার নীচে নামতে পারবেনা; সে ক্ষেত্রে মেঘ গলে পানি হয়ে যাবে।
কিন্তু মানুষ তার ইচ্ছামতো চলার স্বাধীনতা ভোগ করে; কারণ আল্লাহ এ জন্য তাকে প্রদান করেছেন বিবেক। তাই বলা যায় মানুষ বিবেকের কারণে স্বাধীন। আবার আমরা যদি বিভিন্ন প্রাণীর খাদ্যাভ্যাস লক্ষ করি দেখতে পাবো: কিছু প্রাণী শুধুই মাংস ভক্ষণ করতে পারে, কেউ মাছ, কেউ তৃণলতা কেউবা শাকসবজি, আবার কেউ ময়লা আবর্জনা। গরু, ছাগল, উট, দুম্বার মতো প্রাণী কখনও মাছ বা মাংস খেতে পারবে না। কারণ এই খাদ্য আত্মস্থ করার জন্য শারিরিক সক্ষমতা এদের নেই। বাঘ কখনও ঘাস বা তৃণলতা খাবে না। পাখি কখনও ফলের অনুকূলে ছাড়া মিষ্টি খাবে না। এভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে সকল প্রাণীই বিভিন্ন ক্ষেত্রে নির্ধারিত গন্ডির অধীন। মানুষকে বলা হয় সর্বভুক। তার সব কিছুই হজম করার ক্ষমতা আছে, শুধু অভ্যাসের ব্যপার।
মানুষকে এতগুলো গুণাগুণ দিয়ে আল্ল¬াহ এ জন্যই সৃষ্টি করেছেন, যেহেতু মানুষকে করা হয়েছে আল্ল¬াহর প্রতিনিধি। আল্ল¬াহ পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেন “স্মরণ কর সেই সময়ের কথা যখন আল্ল¬াহ ফেরেস্তাদের বললেন, আমি পৃথিবীতে একদল প্রতিনিধি প্রেরণ করতে চাই, ফেরেস্তারা বললো মাবুদ এরাতো পৃথিবীতে মারামারি আর রক্তারক্তি করে পরিবেশ বিষময় করে তুলবে, যদি তোমার গুণগাণ প্রকাশ ও এবাদতের জন্যই তাদেরকে প্রেরণ করার ইচ্ছে করে থাকো তবে এ কাজের জন্যতো আমরাই যথেষ্ট, আল্লাহ বললো আমি যা জানি তোমরা তা জানোনা”। অর্থাৎ মানুষ শুধুমাত্র আল্লাহর এবাদত বা গুণগানই প্রকাশ করবেনা বরং তারা আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে আল্লাহর দ্বীন ও বিধান কে বাস্তবায়ন করবে।
এ কথাই অন্যত্র আল্ল¬াহ এভাবে বলেন, “তোমাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে সর্বোত্তম জাতি হিসেবে, তোমাদের কাজ হবে সৎকাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধ করা”।
এই পর্যালোচনা থেকে আমাদের কাছে যে বিষয়টি প্রতিভাত হয়, তা হলো মানুষকে আল্ল¬াহ আশরাফুল মাখলুকাতের মর্যাদা দিয়ে এ জন্যই সৃষ্টি করেছেন, “আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে মানবজাতি আল্ল¬াহর জমিনে আল¬াহর দ্বীনকে বাস্তবায়ন করবে”। আর আল্ল¬াহর প্রতিনিধিত্ব করার উপযোগীতা অর্জনের জন্যই মানবজাতির প্রতি এসব আনুষ্ঠানিক এবাদতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এসব এক একটি এবাদতের মাধ্যমে মানুষ এক একটি গুন অর্জন করবে বলে আল্লাহ ঘোষণা করেছেন। রোজার উদ্দেশ্য হলো, এর মাধ্যমে অর্জিত হবে তাকওয়া, আত্মশুদ্ধি ও আত্মসংযমের গুণ।
রোজার উদ্দেশ্য সম্পর্কে আল্লাহ কোরআনে পাকে স্পষ্ট করে বর্ণনা করেছেন হে বিশ্বাসীগণ! তোমাদের উপর রোজা পালন আবশ্যিক (ফরজ) করা হয়েছে যেমনি তা আবশ্যিক ছিল তোমাদের পূর্বসূড়ীদের উপর, আশা করা যায় এর মাধ্যমে তোমরা তাক্কওয়া বা খোদাভীতি অর্জন করতে পারবে। আল্লাহ নিজেই ঘোষণা করেছেন রোজা পালনের মাধ্যমে মানুষ খোদাভীতি অর্জন করতে পারবে। আল্লাহর ভয় যখন কারো মাঝে পুরোপুরিভাবে সৃষ্টি হয়, তখন সে আন্তরিকভাবেই বিশ্বাস করে; সে যা কিছু করছে, তার প্রতিমূহুর্তের সকল কর্মকান্ড আল্লাহ অবলোকন করছেন এবং তা রেকর্ড করা হচ্ছে। একদিন তাকে আল্লাহর কাছেই ফিরে যেতে হবে, আর তখন সে রেকর্ড মোতাবেক তার প্রতিনিধি জীবনের হিসাব হবে, হিসাবের পর নির্ধারিত হবে পুরস্কার বা শাস্তি। খোদার এই ভয় যখন কারো মাঝে সৃষ্টি হয় তখন সে জানতে চেষ্টা করে কোন কাজটি করা তার জন্য বৈধ- কোন কাজটি অবৈধ, কোনটা হারাম, আর কোনটা হালাল। আর সে আত্ম সমালোচনার মাধ্যমে ভাবে, আল্লাহ তাকে কি উদ্দেশ্যে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন, কি তার দায়িত্ব এবং এ দায়িত্বের পথে সে কতটুকু টিকে আছে, সর্বোপরী মানুষের জীবনের শেষ পরিণতি বাস্তবিক পক্ষে কি? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর যখন খুঁজে পায় তখন সে নিজেকে সংশোধন করতে থাকে, বস্তুতপক্ষে এ জন্যই বলা হয়ে থাকে রমজান আত্মশুদ্ধির মাস।
এলক্ষ্যেই রাসুলুল্লাহ (দঃ) হাদীসে এরশাদ করেছেন “যে লোক রমজান মাসে রোজা রাখবে ঈমানের চেতনা ও আত্ম সমালোচনার মাধ্যমে, তার আগের ও পরের সকল অপরাধ ক্ষমা করে দেয়া হবে। অন্য হাদীসে বলা হয়েছে এ ভাবে রোজা রাখলে রমজান পূর্ণ হওয়ার সাথে সাথে সে শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে উঠে। তবে শুধু সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকার নামই রোজা নয়, অসংখ্য হাদীসে বার বার একটি কথা উল্লেখ করা হয়েছে ইমান ও এহতেসাব বা আত্ম সমালোচনা ও আত্ম সংশোধন ছাড়া শুধুমাত্র উপবাস আর জৈবিক ক্রিয়া থেকে বিরত থাকা রোজার কোন মূল্যই আল্লাহর কাছে নেই। কেননা রোজার উদ্দেশ্যই হচ্ছে আত্মশুদ্ধি।
আমরা যে কাজই করি তার একটি উদ্দেশ্য থাকে। যেমনঃ আমরা খাদ্য গ্রহণ করি এই জন্য যে, এর মাধ্যমে জীবনীশক্তি অর্জিত হবে। খাদ্য গ্রহণের এই উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য, খাদ্য গলদকরণ করতে হবে এবং হজম করতে হবে, পাশাপাশি যা আমরা গলদকরণ করবো তার মধ্যে খাদ্যপ্রাণ বা পুষ্টিগুণ থাকতে হবে। এখন কেউ যদি খাদ্য গলদকরণ করে কিন্তু তার মধ্যে খাদ্যপ্রাণ না থাকে তাহলে তার খাদ্য গ্রহণের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হতে বাধ্য, আবার কেউ খাদ্য গ্রহণ করলো, তাতে খাদ্য প্রাণও রয়েছে, কিন্তু খাদ্য গ্রহণের পর পরই সে তা বমি করে ফেলেছে, তাতেও তার খাদ্য গ্রহণের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে। মুল বিষয় হচ্ছে উদ্দেশ্য পুরণের পূর্ব শর্ত হচ্ছে তার যথাযথ পদ্ধতির অনুসরণ। তেমনি রোজার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে হলে আমাদের অবশ্যই রোজার সাথে আত্মশুদ্ধির পন্থা অবলম্বন করতে হবে। এ জন্য কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে হালাল, হারাম, বৈধ ও অবৈধের গন্ডি। আল্লাহ আমাদের সে তওফিক দান করুন, আমীন।