॥ রাঙামাটি রিপোর্ট ॥
আজ মঙ্গলবার (২৪ মে) অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের বহুল প্রতীক্ষিত সম্মেলন ও ত্রি-বার্ষিক কাউন্সিল। স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দেশের প্রাচীনতম ও ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠনটির যে কোনো পর্যায়ের কাউন্সিল বরাবরই জনগণের আগ্রহের বিষয়। বিশেষ করে দল যখন ক্ষমতায় আছে তখন নেতৃত্ব নির্বাচন ঘিরে স্বাভাবিকভাবেই দলের ভেতরে বাইরে উত্তেজনা ও আগ্রহের সীমা থাকে না। তেমনি এই সম্মেলন ঘিরেও দলের ভিতরে-বাইরে, প্রশাসনে, অন্য সংগঠনগুলোতে এমনকি সাধারণ মানুষের মাঝেও ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা রয়েছে। এবারের কাউন্সিল ঘিরে উদ্বেগ উত্তেজনা যেন একটু বেশিই লক্ষ করা যাচ্ছে।
এর প্রথম কারণ, দীর্ঘ ১০ বছর পর রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। দ্বিতীয় কারণ হলো, এবার প্রধান দুইটি পদেই সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্ভাবনা দেখা দেওয়ায় নেতাকর্মীদের মাঝে চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। আশার কথা হলো এখনও উত্তেজনাকে ‘চাপা’ বলে আখ্যায়িত করা যাচ্ছে; এটাই পার্বত্য রাজনীতির মহিমান্বিতা। দেশের অন্যান্য জেলাগুলোতে বড়দলগুলোর কাউন্সিল নিয়ে যেভাবে তোলপাড় ও এবং মারামারি হাতাহাতি এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে গোলাগুলিরও ঘটনা ঘটে। সেখানে পাহাড়ের তিনটি জেলার ক্ষেত্রেই এমন নজির এখন পর্যন্ত কোনো কালেই দেখা যায়নি। পাহাড়ের রাজনৈতিক সংস্কৃতি তাই নিঃসন্দেহে অন্য জেলাগুলো থেকে উন্নততর এবং মার্জিত। তাই সম্মেলন ঘিরে উত্তেজন থাকলেও কোনো আতঙ্ক কারো মাঝেই নেই। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন শেষ সময়টির জন্য।
বিচিত্র নয় যে, কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ সম্মেলনে উপস্থিত হওয়ার পর দৃশ্যপটে আরো পরিবর্তন আসতে পারে। তবে পরের পরিস্থিতি যেমনই হোক শান্তি শৃঙ্খলা ক্ষুন্ন হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখা যায়নি।
রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি দীপংকর তালুকদার এমপি দীর্ঘ আড়াই দশকেরও বেশি সময় ধরে জেলা আওয়ামী লীগে নিজের পদ এবং আধিপত্য ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। ২৬ বছর পর তিনি এবারই প্রথম প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পড়েছেন। সব দলেই এমনটাই ঘটে থাকে যে, যখন কোনো প্রবীণ নেতা নিজ পদের বিপরীতে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হন; তখন দেখা যায় রশির অন্য মাথায় দাঁড়িয়ে থাকা লড়াকু তারই একসময়ের শীষ্য বা সহযোগী। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। দীপংকর তালুকদারের বিপরীতে যিনি সভাপতি পদের দাবি নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দাঁড়িয়েছেন তিনিও দীপংকর তালুকদারেরই হাতে গড়া সৈনিক পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা।
বরাবরের মতো রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে এবারও সাধারণ সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়টি স্পষ্টভাবেই দৃশ্যমান। অতীতে সকল কাউন্সিলেই এই পদটিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়ে আসছে। এবারও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন আগের কাউন্সিলের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী বর্তমান সাধারণ সম্পাদক হাজী মোঃ মুছা মাতব্বর এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাজী কামাল উদ্দিন। আশার কথা হলো এবার অন্য কোনো প্রার্থী না থাকায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে সরাসরি। কাউন্সিলরদের মনের মণিকোঠায় যার অবস্থান সুদৃঢ় তিনিই শেষ পর্যন্ত নির্বচিত হবেন। এবারের কাউন্সিলে কাউন্সিলর রয়েছেন ২৪৬ জন এবং তারাই মূলত নির্ধারণ করবেন পাশা কোনদিকে যাবে।
অন্য জেলার কাউন্সিলের নানা সমীকরণ থাকে। তৃতীয় চতুর্থ বা পঞ্চম পক্ষের চাপ থাকে, থাকে শক্তি এবং অর্থের আধিপত্য। কিন্তু এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, রাঙামাটির কাউন্সিলে শেষ সিদ্ধান্তটি আসবে হৃদয়ের টান থেকে। প্রকৃতপক্ষে কেন্দ্রীয় কোনো নেতার লেজুড়বৃত্তি থেকে নেতৃত্বে নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তা বা জাতীয় নির্বাচনের মনোনয়নের রেশ থেকে গুটিচালাচালির বিষয়টি এখানকার কাউন্সিলে তেমন একটা নেই। কারণ গোটা জেলা মিলে একটিই সংসদীয় আসন; প্রকৃতপক্ষে তারও দাবিদার নেতার সংখ্যা একেবারেই হাতে গোনা। তাই কাউন্সিলরদের কাছে গিয়ে ভোট চাওয়ার সময় যিনি তার অবস্থান ব্যাখ্যা করে তাদের সন্তুষ্ট করতে পেরেছেন, তিনিই শেষ পর্যন্ত জয়ের মালা পরবেন। প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ চার নেতাই দীর্ঘ সময় ধরে দলীয় নেতৃত্বের বিভিন্ন পর্যায়ে অবস্থান ধরে রাখার পাশাপাশি বরাবরাই সরকারি কোনো না কোনো দায়িত্ব পালন করে এসেছেন। এই দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে তারা এলাকার উন্নয়ন, জনগণের সাথে আচরণ, সুযোগ সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে সঠিক মানুষ নির্বাচন এবং সর্বপোরি নিজের লোভ এবং বিবেচনা প্রয়োগের ক্ষেত্রে যতটুকু বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন, আজ তারই ফলাফল দেখার দিন। কারণ কারোই যোগ্যতা বা দলের প্রতি আন্তরিকতা এবং গ্রহণযোগ্যতায় কোনো কমতি নেই।
বর্তমান সভাপতি খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি দীপংকর তালুকদার এমপি একজন সাবেক প্রতিমন্ত্রী। ছাত্র জীবন থেকেই তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক এবং ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করা রাজনিতিক। বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার পর তিনি ভারতে নির্বাসিত জীবন যাপন করেন। পরে আশির দশকের মাঝামাঝিতে দেশে ফিরে দল পুণর্গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এর মাঝেই ১৯৯১ সালে তিনি প্রথম সংসদ সদস্য হন এবং রেশ ধরে চারবার এমপি নির্বাচিত হন তিনি। এমপি থাকা অবস্থায়ই ১৯৯৬ সালের সম্মেলনে তিনি প্রথমবারের মতো জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। এরপর ২০০২ সাল এবং ২০১২ সালে দুবার সম্মেলন হলেও সভাপতি পদে তার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বি ছিল না।
২৬ বছর পর তার বিপরীতে প্রার্থী হয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নিখিল কুমার চাকমা। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এবং এর আগে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। পার্বত্য রাজনীতিতে প্রতিহিংসার শিকার পরিবারগুলোর মধ্যে একটি ঐতিহ্যবাহী হেডম্যান পরিবারের সন্তান নিখিল কুমার চাকমা নব্বইয়ের দশকে রাজনীতিতে সক্রিয় হন এবং তখন থেকেই তিনি দলে সক্রিয় রয়েছেন।
হঠাৎ করে দলীয় পদ নিয়ে আগ্রহের বিষয়ে নিখিল কুমার চাকমা বলেন, দলের কাউন্সিলর ও নেতাকর্মীদের অনুরোধেই আমি প্রার্থী হয়েছি। তিনি শ্রদ্ধার সাথে বলেন, দীপংকর দাদা দীর্ঘদিন সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন, তাই নেতাকর্মীরা চায় দায়িত্বে কিছুটা পরিবর্তন আসুক। তিনি বলেন আমার বিশ্বাস সভাপতির দায়িত্ব পেলে আমি দলকে আরো গতিশীল করতে পারবো। তিনি বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা আমার প্রতি আস্থা রেখে উন্নয়ন বোর্ডের যে দায়িত্ব আমাকে দিয়েছেন এবং এর আগে জেলা পরিষদে যে দায়িত্ব দিয়েছিলেন সব সময়ই আমি নিষ্ঠার সাথে নির্লোভভাবে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছি। সভাপতি হলে এ দায়িত্ব পালন আরো সহজ হবে।
পক্ষান্তরে দীপংকর তালুকদার বলেছেন, দলের মধ্যে গণতন্ত্র চর্চার অংশ হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতেই পারে। নিশ্চয়ই কাউন্সিলররাই নির্ধারণ করবেন কার কোন দায়িত্ব পালন করা উচিত। সভাপতি হিসেবে আমি বরং সুষ্ঠুভাবে কাউন্সিল সম্পন্ন করার বিষয়েই ব্যস্ত আছি।
এদিকে সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থী হওয়া হাজী মুছা মাতব্বর ও হাজী কামাল উদ্দিন; দুজনই জয়ের বিষয়ে আশাবাদী। রাঙামাটির হয়ে জাতীয় ক্রীড়াঙ্গনে সুনাম কুড়ানো হাজী কামাল উদ্দীন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ছিলেন। নিয়মিত খেলোয়াড় হিসেবে অবসরে যাওয়ার পর তিনিও নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং জেলা আওয়ামী লীগের ক্রীড়া সম্পাদকের দায়িত্ব পলন করেন। ওই পদে থাকা অবস্থায়ই তিনি ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। দল ক্ষমতায় থাকা অবস্থায়ই ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে তিনি মুছা মাতব্বরের কাছে হেরে যান। তিনি বলেন, শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে পাহাড়ে আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী সাংগঠনিক ভীতের ওপর দাঁড় করাতে আমি বরাবরই জীবন বাজি রেখে কাজ করেছি আমৃত্যু এ কাজেই থাকবো। আমার পুঁজি সততা, কাউন্সিলররা নিশ্চয়ই বিষয়টি বিবেচনা করে আমাকে নির্বাচিত করবেন।
বর্তমান সাধারণ সম্পাদক হাজী মুছা মাতব্বর বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধে আমার পরিবারের অবদান কারো অজানা নেই। পারিবারিক ঐতিহ্যের রেশ ধরেই আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতির সাথে ছাত্র জীবন থেকে যুক্ত। আমার এলাকার জনগণ এবং দলীয় নেতাকর্মীরা মানুষ হিসেবে আমার গ্রহণযোগ্যতাকে মূল্যায়ন করে বলেই প্রথমবার নির্বাচনে অবতীর্ণ হওয়ার সাথে সাথে আমাকে বিপুল ভোট উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত করে। পরে দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে প্রার্থী হলে সেখানেও তারা আমাকে জয় দিয়ে পুরস্কৃত করে। পাহাড়ের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে আন্দোলন করার ক্ষেত্রে আমি কখন কারো রক্তচক্ষু দেখে পিছপা হইনি। আমার বিশ্বাস, কাউন্সিলররা অবশ্যই এসব মূল্যায়ন করবেন। তারা দুজনই জয়ের বিষয়ে শতভাগ আশাবাদী।
সর্বশেষ ২০১৪ সালে জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল ২০১৯ সালের ২৫ নভেম্বর। কিন্তু নির্ধারিত দিনের মাত্র ৫দিন আগে অনিবার্য কারণে তা স্থগিত হয়ে যায়। করোনা মহামারির কারণে আর তা হতে পারেনি তাই এই সম্মেলনটি একটি বহুল প্রতীক্ষিত সম্মেলন।
জেলা আওয়ামী লীগের দেয়া তথ্যমতে ত্রি-বার্ষিক সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকবেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এমপি। উদ্বোধক হিসাবে উপস্থিত থাকবেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপি, বিশেষ অতিথি উপস্থিত থাকবেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মাহাবুব উল-আলম হানিফ ও তথ্য মন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদ এমপিসহ কেন্দ্রীয় জৈষ্ঠ্য নেতাকর্মী, চট্টগ্রাম বিভাগীয় নেতৃবৃন্দ ও রাঙামাটির জেলা-উপজেলার নেতাকর্মীরা।
সম্মেলন সামনে রেখে ইতোমধ্যে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক প্রার্থীরা বিভিন্ন উপজেলা সফর করে কাউন্সিলরদের মন জয় করতে মাঠ চষে বেড়িয়েছেন। নিজে যেতে না পারলেও প্রতিনিধি পাঠিয়ে কাউন্সিলরদের মন জয় করতে উপজেলায় সফর করেছেন। জেলা শহরেও ক্যাম্পেইন ছিল চোখে পড়ার মতো। তবে শেষ কথা কাউন্সিলরদের ভোটাভোটি এবং কেন্দ্রীয় নেতাদের বিচক্ষণতা। তাই ফলাফল জানতে অপেক্ষা করতে হতে পারে গভির রাত বা আরো কয়েকদিন। আবার প্রথম অধিবেশনের পরপরই ভিন্ন কিছুও হতে পারে, তাই আগে থেকে কোনো কিছুই অনুমান করা কঠিন। তবে ফলাফল যাই হোক পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ এবং আন্তরিক থাকবে এমনটাই সকল মহলের বিশ্বাস।