॥ আলমগীর মানিক ॥
রাঙামাটি থেকে কাপ্তাইমুখি মনোরম আসামবস্তি-কাপ্তাই সড়কটি থেকেই এক বছরে আড়াই কোটি টাকার চাঁদাবাজি হয়েছে বলে ভূক্তভুগীদের বক্তব্য থেকে জানা গেছে। দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি আঞ্চলিকদলগুলোর বেপরোয়া চাঁদাবাজি ও সশস্ত্র তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় আবারো অস্থির হয়ে উঠছে পাহাড়ের জনজীবন। চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসীদের দমনে সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়ার মাত্র সাড়ে তিন মাস সময়ের মধ্যেই বিগত বছরগুলোর চেয়ে কয়েকগুন বেশি চাঁদার হার নির্ধারণ করে বেপরোয়া চাঁদাবাজিতে নেমেছে আঞ্চলিকদলগুলো। চাঁদার দাবি আদায়ে ভীতি প্রদর্শনের জন্য তারা প্রকাশ্যে সশস্ত্র মহড়া দিয়ে বেড়াচ্ছে দাবি করেছে স্থানীয় সুত্রগুলো। এমনকি রাঙামাটি শহরের নিকটবর্তী আসামবস্তি সড়কে গোলাগোলির মাধ্যমে ভয়ভীতি সৃষ্টি করে চাঁদাবাজী করে যাচ্ছে সন্ত্রসীরা। অথচ এই সড়কটির মাঝামাঝি বড়আদমে রয়েছে নিরাপত্তাবাহিনীর একটি ক্যাম্প, সড়কের শেষ প্রান্তেও রয়েছে নিরাপত্তা বাহিনীর আরো একটি ক্যাম্প; সন্ত্রাসীরা যেন নিরাপত্তাবাহিনীকে থোড়াই কেয়ার করছে।
ভুক্তভগীদের বক্তব্য থেকে জানা গেছে, রাঙামাটি শহর থেকে বের হওয়া ৩০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই একটি সড়ক থেকেই গত এক বছরে চাঁদাবাজি হয়েছে অন্তত আড়াই কোটি টাকা। সূত্রমতে, জেএসএস এর কালেক্টর সুমন তনচংঙ্গ্যা ওরফে জেমস, সহকারী কমান্ডার বিপ্লব চাকমা, কালেক্টর রিটন চাকমা, মিল্টন চাকমা ও অপু চাকমার নেতৃত্বে আসামবস্তি-কাপ্তাই সড়কে চাঁদাবাজির মহোৎসব চলছে।
এলজিইডি, সড়ক বিভাগ, উন্নয়ন বোর্ড ও পিআইও অফিসের মাধ্যমে রাঙামাটিস্থ আসামবস্তি-কাপ্তাই সড়কে বাস্তবায়নাধীন প্রায় অর্ধশত কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ চলছে। এই কাজ থেকে এবং উক্ত সড়কে চলাচলকারি যাত্রীবাহি পরিবহণগুলো থেকে জেএসএস এর বিবদমান দুইটি গ্রুপ গত এক বছরে অন্তত আড়াই কোটি টাকা চাঁদাবাজির মাধ্যমে আদায় করে নিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।
চলতি মাসেই দুই দফায় নির্ধারিত চাঁদার দাবিতে খোদ রাঙামাটি শহরেই প্রকাশ্যে দিবালোকে সশস্ত্র হামলা চালিয়েছে তারা। মাসের শুরুতেই ২ সেপ্টেম্বর শুক্রবার আসামবস্তী কাপ্তাই সড়কের বড়আদমের তঞ্চঙ্গ্যাপাড়ায় জেএসএস এর ১০ সদস্যের একটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ চাঁদা পরিশোধ না করায় ০৬টি সিএনজি অটোরিকশা এবং ০১টি পাথর বোঝাই ট্রাক আটক করে। পরবর্তীতে সেনাবাহিনীর দুইটি টহল দল ঘটনাস্থলে গমন করে সিএনজি অটোরিকশাগুলো উদ্ধার করে।
এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই শুক্রবার দুপুরে প্রকাশ্য দিবালোকে সিএনজি অটোরিক্সা আটকিয়ে চালক কামাল উদ্দিনকে বেদড়ক মারধর করে তার অটোরিক্সাটিতে আগুন লাগিয়ে সম্পূর্ন পুড়িয়ে দেয়। এই ঘটনায় বিক্ষুব্ধ চালকরা শুক্রবার বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রাঙামাটি-চট্টগ্রাম মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল সমাবেশ করে প্রশাসনকে তিন দফা দাবি বাস্তবায়নে ৪৮ ঘন্টার আল্টিমেটাম বেঁেধ দেয়।
রাঙামাটি কোতয়ালী থানার অফিসার ইনচার্জ মো: কবির হোসেন জানিয়েছেন, আমরা এই ঘটনায় মামলা নিয়েছি এবং প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। তিনি জানান, সন্ত্রাসীদের ব্যাপারে আমরা নজরদারি বৃদ্ধি করেছি।
খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, সুইজারল্যান্ড খ্যাত রাঙামাটির আসামবস্তি কাপ্তাই সড়কটিকে অত্রাঞ্চলের পর্যটন সেক্টরের হাব হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে রাঙামাটিতে আগত পর্যটকদের কাছে এই সড়কটিকে আরো আকর্ষণীয় ও দৃষ্টিনন্দন করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে সরকারি উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়নকারি প্রতিষ্ঠানগুলো রাস্তা-ঘাট, ব্রীজ-কালভার্ট নির্মাণ করছে। এই সড়কের মধ্যেই স্থাপিত করা হয়েছে রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠানটি। ইতোমধ্যেই এই সড়ককে ঘিরে অত্রাঞ্চলে স্থাপিত হয়েছে বেশ কয়েকটি রিসোর্ট ও পর্যটন স্পট ও অর্ধশত রেষ্টুরেন্ট। এগুলো থেকেও জেএসএস এর সন্ত্রাসীরা নিয়মিতহারে চাঁদাবাজি করছে।
এলজিইডি ও ঠিকাদারদের একটি বিশ^স্ত সূত্র জানিয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে রাঙামাটির কাপ্তাই, রাজস্থলী, রাইখালী, বাঙ্গালহালিয়া, বিলাইছড়ি ঘাগড়া ও মানিকছড়ি এলাকায় জেএসএস এর সশস্ত্র আধিপত্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। এই এলাকাগুলোতে বাস্তবায়নাধীন বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প ইতিমধ্যেই বন্ধ করে দিয়েছে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানগুলো। তারমধ্যে অন্যতম একটি প্রকল্প হলো কারিগর পাড়া হয়ে বিলাইছড়ি পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ প্রকল্পটি। কয়েকটি গ্রুপে প্রায় একশো কোটি টাকা ব্যয়ে এই সড়কটি বাস্তবায়ন করছে এলজিইডি কর্তৃপক্ষ। জেএসএস এর জুম্ম চাঁদাবাজদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে ইতিমধ্যেই এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন কাজ বন্ধ রেখেছে সংশ্লিষ্ট্যরা। অপরদিকে, রাঙামাটিতে প্রায় পৃথক পৃথকভাবে দুইশো কোটি টাকার সড়ক উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়ন করছে রাঙামাটি সড়ক বিভাগ। বৃহৎ একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা হলেও বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি শহরের বাইরের কাজগুলো বন্ধ রেখেছে। কারণ অনুসন্ধানে জানাগেছে, জেএসএস এর পক্ষ থেকে এই (ন্যাশনাল……)প্রতিষ্ঠানটির কাছে ৫ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করেছে। এই টাকা নাপেয়ে উক্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির মানিকছড়ি ও দেপ্পোছড়ির সাইটে দুইবার আগুন লাগিয়ে দিয়ে ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। জেএসএস এর সন্ত্রাসী কালেক্টর সুমন তনচংঙ্গ্যা ওরফে জেমস ও তার সহযোগি মিল্টন ও অপু চাকমার প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে এই অপকর্মটি সম্পাদন করা হয় বলে সূত্র জানিয়েছে। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটির একজন ঘনিষ্টজন জানিয়েছেন, ইতিমধ্যেই রাঙামাটির কাজগুলো গুছিয়ে তারা চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
রাঙামাটির একাধিক ঠিকাদার জানিয়েছেন, মূলত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও জিওসি’র বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করেই নিজেদের সশস্ত্র তৎপরতা বৃদ্ধি করছে অত্রাঞ্চলের আঞ্চলিকদলগুলো। নিয়মিত চাঁদা দেওয়ার পরেও বর্তমানে রডের মূল্যবৃদ্ধিতে ঠিকাদারদের দিশেহারা অবস্থা, বেড়েছে অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রীর দামও। এরই মধ্যে অফিসের কর্তাবাবুদের জন্য নির্ধারিত এক পার্সেন্ট কমিশন। প্রকল্প পিডির জন্য এক পার্সেন্ট কমিশন। সর্বোপরি সশস্ত্র পাহাড়ি চাঁদাবাজদের পক্ষ থেকে এখন দ্বিগুন হারে চাঁদা দাবির ঘটনায় পুরোদমে হাঁপিয়ে উঠছে পাহাড়ের ঠিকাদার, ব্যবসায়ি থেকে শুরু করে পরিবহণ ব্যবসায়ি, অটোরিক্সা চালক, সাধারণ বাসিন্দারা।
বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক মন্তব্য করে রাঙামাটি চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আব্দুল ওয়াদুদ বলেছেন, পাহাড়ে মূলত চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করেই তথাকথিত আঞ্চলিকদলের নামে সন্ত্রাসী সংগঠন সৃষ্টি হয়েছে। এদের প্রধান কাজই হলো চাঁদাবাজি। পাহাড়ের চলমান এই সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের প্রধান লক্ষ্য হলো সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ড বন্ধ করে দেওয়া। এসকল সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের আরো কঠোর হতে হবে অন্যথায় সরকারের জন্য এসব সন্ত্রাসী নির্ভর উপজাতীয় আঞ্চলিকদলগুলো বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়াবে।