উপজাতীয় নৃত্যের পথিকৃত দেলওয়ার হোসেনের ২৫তম মৃত্যুবার্ষিকী

163

॥ স্টাফ রিপোর্টার ॥

সোমবার বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আব্দুস শুক্কুরের পিতা পার্বত্য অঞ্চলের কিংবদন্তী পুরুষ উপজাতীয় নৃত্যের পথিকৃত মরহুম দেলওয়ার হোসেনের ২৫তম মৃত্যুবার্ষিকী।

শিল্প সাহিত্য একান্তই সাধনার বস্তু। নিষ্ঠার সহিত সাধনায়, নাম-যশ খ্যাতির মোহে নয়- যারা সাধনা করেন তারাই জীবন ক্ষেত্রে ও শিল্প ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করতে পারেন। নিপুন মুদ্রা দিয়ে কীভাবে মনের কথা প্রকাশ করে মানুষের জীবনকে মুখর করা যায় দেলওয়ার হোসেনও তেমনি এক যশস্বী শিল্পী। তাঁর পিতা ভাল বেহালা বাজাতেন, পিতার গুণাধিকারী হলেও নিছক কৌতুহলের বশবর্ত্তী হয়েই তিনি নৃত্য শিক্ষার উদ্দেশ্য ঘর ছেড়েছিলেন। তখন তাঁর ১০/১২ বছর বয়স। প্রথমেই তিনি ভারতীয় উপমহাদেশের আসামে চলে যান। জীবনের শুরুতে কৈশোর, যৌবনে তিনি আসাম, ত্রিপুরা, মনিপুরী সম্প্রদায়ের সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক আচার ব্যবহার ও জীবনধারার সংস্পর্শের সাথে জড়িয়ে পড়েন।

কিন্তু যে আশায় তিনি ঘর ছেড়েছিলেন তাৎক্ষণিকভাবে তার কোন ব্যবস্থা হল না, ফলত: দু’টাকা বেতনে এক দোকানে বাবুর্চির চাকুরি নিলেন। আরো কিছুদিন গেলো, আশার শেষ নেই, প্রচেষ্টার অন্ত নেই, ধৈর্য্যরে কমতি নেই। অবশেষে তিনি পরিচিত হলেন মনিপুরী নৃত্য শিক্ষক রাম সিং এর সাথে। তাঁর হাতেই প্রথম নৃত্য শিক্ষার শুরু। কিন্তু নৃত্য শিক্ষায় ডুবে যাবার প্রাক মূহুর্তে আকুন্ঠ ডুবে গেলেন প্রেমের অমিয় সাগরে। অজান্তেই ভালবেসে ফেললেন আসাম অয়েল কোম্পানীর ম্যানেজারের দ্বাদশ বর্ষীয় সুন্দরী চটপটে কন্যা ভার্ণা কে। কিন্তু কিভাবে কথাটা বলা যায়? একদিন অপেক্ষার দুঃসহ মর্মজ্বালাকে তুলে ধরলেন ভার্ণার কাছে। জবাবে ভার্ণা বললেন (ইয়েস শী ডাজ) ভার্ণার অকৃত্তিম ভালবাসা তাঁর সাধনাকে গতি দিল। তাঁর শিল্প সত্তার মর্মসুপ্ত আগুনকে আরো শতগুন বাড়িয়ে দিল।
কিন্তু ভার্ণার বাবা তাদের ভালবাসার কথা জানতে পেরে রেগে টং, গুলি করে মেরে ফেলবেন দেলওয়ারকে। কিন্তু ভার্ণার ভালবাসা তাকে বাঁচিয়ে দিল। ভার্ণার সাথে তিনি আমেরিকা চলে যান ১৯৪৫ সালের শেষের দিকে। সেখানেই তাঁদের বিয়ে হয়। এদেশ থেকে সকল লেনদেন শেষ করে নিজেকে নিঃশেষে বিলিয়ে দেবার আশায় শেষবারের মত দেশে এলেন ১৯৪৮ সালের শেষ দিকে, তার আর আমেরিকা ফিরে যাওয়া হল না। তিনি আসার ক’দিন পর নরিনের জন্ম হয়। ১৯৫০ সালে ভার্ণার মৃত্যু হয়। দেশে আসার পর সুরত জামালের সাথে তাঁর বিয়ে হয় এবং নৃত্য শিক্ষায় মনোনিবেশ করেন গভীরভাবে, বুলবুল ললিতকলা একাডেমী, জাগো আর্ট সেন্টারের ছত্রছায়ায় শ্রদ্ধেয় গওহর জামিল, জি,এ, মান্নান ও দেবু ভট্টাচার্য্যরে কাছে লোকনৃত্য ও উচ্চাঙ্গ নৃত্যের শিক্ষা নেন, পাকিস্তানের খ্যাতনামা চিত্রাভিনেত্রী ও নৃত্য শিল্পী কাফেরার কাছেও তিনি নৃত্য শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে নৃত্য পরিবেশন করে সুনাম অর্জন করেন।

জীবন সংগ্রামের শুরুতে আসাম, মনিপুরী ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীর জীবনধারার সংমিশ্রনে যেতে পেরেছিলেন বলে, হয়ত বিধাতার নির্দেশেই তাঁকে আবার এই পার্বত্য উপত্যকায় জনগোষ্ঠীর কাছে ফিরে আসতে হয়েছে এবং ১৯৬৩ সালে তিনি পার্বত্য জেলা বোর্ডে নৃত্য শিক্ষক হিসেবে চাকুরীতে যোগদান করেন এবং তৎকালীন পাকিস্তান আর্ট কাউন্সিলে নৃত্য শিক্ষকের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এছাড়াও তিনি উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনষ্টিটিউট, শিল্পকলা একাডেমী, শিশু একাডেমি, মনোঘর উচ্চ বিদ্যালয়, সেন্ট ট্রিজার স্কুলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিষ্ঠার সহিত নৃত্য শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

পার্বত্য চট্টগ্রামেন তৎকালীন পশ্চাদপদ সমাজ ব্যবস্থার বেড়াজাল ঠেলে স্থানীয় নৃত্য শিল্পী সৃষ্টিতে তিনি অনন্য অবদান রাখেন। আজকের পার্বত্য এলাকার চাকমা সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী জুম নৃত্য, শিকারী নৃত্য, মুরং সম্প্রদায়ের গরু শিকারী নৃত্য, ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের বোতল নৃত্য, গড়াইয়া নৃত্য মারমা সম্প্রদায়ের বাঁশ নৃত্য তাঁরই হাতে কম্পোজ করা এবং সেই থেকে তিনি উপজাতী জনগোষ্ঠীর কাছে প্রিয় ও শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে উঠেন। এই সৃষ্টিশীল যশ্বস্বী শিল্পীর ভাব-ভঙ্গী, আচার-আচরণ চলাফেরা দেখে পার্বত্য অঞ্চলের সকল সম্প্রদায়ের কাছে ও তৎকালীন জেলা প্রশাসকসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল? দেলওয়ার আসলে কোন সম্প্রদায়ের লোক। তখন থেকেই তিনি পার্বত্য অঞ্চলের সংস্কৃতি জগতে নৃত্যের জন্য আমৃত্যু কার্যকর ভূমিকা পালন করেছেন। রাঙামাটি পার্বত্য জেলার সাংস্কৃতিক সংগঠক হিসেবে তাঁর ভূমিকা অনন্য।

নৃত্য শিক্ষক হিসেবে তো বটেই। এ গুনীজন শিল্পী নৃত্যের পাশাপাশি সংগীতেও পারদর্শী ছিলেন। করাচী লাহোর, পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশন করতে গিয়ে, পাকিস্তানে খ্যাতনামা কন্ঠশিল্পী ফরিদা খানম ও নূরজাহানের সাথে ভাল বন্ধুত্বের সম্পর্ক হয়। সে সুবাদে তিনি গানের তালিম নেন। নৃত্য পরিবেশন শেষে, বিখ্যাত হজল স¤্রাট মেহেদী হাসান, গোলাম আলী ও নূরজাহানের গান শুনিয়ে দর্শক শ্রোতাদের মন আকৃষ্ট করতেন।

এ গুনীজন শিল্পী শুধু উচ্চাঙ্গ ও লোকনৃত্যে দক্ষ ছিলেন না, তিনি নৃত্যের পাশাপাশি তবলা, এ¯্রাজ, বেহালা, সেতার ও হারমোনিয়াম বাজাতে পারতেন সমান দক্ষতার সাথে। ১৯৭৯ সালের ২৭শে এপ্রিল নৃত্য এবং যন্ত্র সংগীতে দক্ষতার জন্য রাঙামাটি প্রকল্পনা সাহিত্যঙ্গন থেকে তাঁকে গুনীজন হিসেবে সংবর্ধনা প্রদান করা গয়। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর উদ্যোগে ও কুমিল্লা জেলা শিল্পকলা একাডেমীর ব্যবস্থাপনায় ২৫শে আগষ্ট’৮১ থেকে ২৭শে আগষ্ট’৮১ পর্যন্ত কুমিল্লায় অনুষ্ঠিত তিনদিন ব্যাপি চট্টগ্রাম বিভাগীয় সংগীত সম্মেলনে সাফল্যজনক অংশগ্রহণ করার জন্য দেলওয়ার হোসেনকে পুরস্কার ও প্রশংসাপত্র প্রদান করা হয়। ২০০১ সালের ১৬ই জুন রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ থেকে শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি শ্রদ্ধা ও মরনোত্তর সম্মাননা পদকে ভূষিত করা হয়। কাল গড়িয়ে চলে, একটি জাতির সাংস্কৃতিক মূল্যকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে ইতিহাস, তেমনি ইতিহাস আর ঐতিহ্যর মাঝে বেঁচে থাকে একটি জাতিসত্ত্বা। এই সৃষ্টিশীল-যশস্বী শিল্পী, মরহুম দেলওয়ার হোসেনের রেখে যাওয়া শিল্পী-সত্ত্বা এই পার্বত্য উপত্যেকায় চিরদিন অমর হয়ে থাকবে। তাঁর পিতা মরহুম হাজী আমজু মিয়া ফকিরের সাত ছেলে ও সাত মেয়ের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। তাঁর ছয় ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে বড় ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস শুক্কুর ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে শহিদ হন। এ গুনীজন শিল্পীর সাদা হাফ শার্ট ও পায়জামা তাঁর আনুষ্ঠানিক প্রচ্ছদ। অন্য সময় লুঙ্গি, শার্ট, সদাহাস্যময়। ৫ম শ্রেণীতে মাত্র দু’দিন ক্লাস করেও নির্ভূল ইংরেজীতে কথা বলতে পারতেন। দেলওয়ার হোসেন ১৯৯৭ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর কুমিল্লায় নিজ পুত্রের কর্মস্থলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

পার্বত্য অঞ্চলের কিংবদন্তী পুরুষ উপজাতীয় নৃত্যের পথিকৃত মরহুম দেলওয়ার হোসেনের ২৫তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে তবলছড়ি মাস্টারকলোনীস্থ তার নিজ বাসভববনে দোয়া, মিলাদ মাহফিল ও এতিম শিশুদের মাঝে খাবার বিতরণের আয়োজন করা হয়েছে।