॥ রাঙামাটি রিপোর্ট ॥
‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য ওঠেছে, রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল।’ ৫১ বছর আগের ১৬ ডিসেম্বর দিনটিতেই রক্ত লাল সূর্য ওঠেছিল বাংলাদেশের আকাশে। বিজয়ের গর্বে গরবিনী সূর্যের রশ্মিতে হেসেছিল লাখো শহীদের রক্তে কেনা বাংলাদেশ। বিজয়ের এই ইতিহাসের এবার ৫২ বছর; আনন্দ, বেদনা আর বিন¤্র শ্রদ্ধায় গোটা জাতি স্মরণ করেছে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা ও লাখো শহীদকে এবং স্বাধীন রাষ্ট্রের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের স্মৃতিঘেরা এ দিন ঘিরে পার্বত্য রাঙামাটির মানুষ দিনভর শহর মুখরিত করে রাখে।
বিজয় দিবস উপলক্ষে এদিন ছিল সরকারী ছুটি, তবে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, শিক্ষক-ছাত্র বা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ কেউই ছুটি কাটাননি, দিনভর বিজয় দিবসের বিভিন্ন আয়োজনে অংশ গ্রহণের মধ্য দিয়ে তাদের দিনাতিপাত হয়। শিশু-কিশোরসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ বিজয় দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানমালা ঘুরে ঘুরে উপভোগ করে। দিনটি উপলক্ষে সব সরকারি-আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনায় ছিল বিশেষ আলোকসজ্জার ব্যবস্থা। শহরের বেশির ভাগ ভবন উৎসবের আমেজে সাজানো হয়।
বিজয়ের ¯্রােতে ¯œাত রাঙামাটি জেলায়ও নানা কর্মসূচি ও বর্ণালী আয়োজনের মধ্য দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের সূবর্ণজয়ন্তী পালিত হয়েছে। রোববার দিবসের প্রথম প্রহরে শহীদ মিনারে ৩১ বার তোপধ্বনীর দিনটির সূচনা হয়। এ সময় গভির ভক্তি শ্রদ্ধা ও ভাব গাম্ভির্যের মধ্য দিয়ে শহীদদের শ্রদ্ধা জানিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুলেল শ্রদ্ধর্ঘ্য নিবেদেন করে নানা বয়সের নারী-পুরুষ। প্রথমে মহামান্য রাষ্ট্রপতির পক্ষে শহীদ মিনারে ফুল দেন রাঙামাটির জেলাপ্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। এ সময় তাঁর সাথে পুলিশ সুপার মীর আবু তৌহিদ বিপিএমসহ প্রশাসনিক কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন।
এর পরপরই শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানান জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অংসুইপ্রু চৌধুরী, রাঙামাটি পৌর মেয়র আকবর হোসেন চৌধুরী। এ সময় রাঙামাটি প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে শহীদ বেদীতে পুস্পস্তবক অর্পণ করে। এছাড়াও প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তর, রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রাঙামাটি মেডিকেল কলেজসহ শিক্ষক নেতৃবৃন্দ ও সামাজিক ব্যক্তিবর্গ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
পরে রাঙামাটি চিংহ্লা মং মারী স্টেডিয়ামে শিশু কিশোরদের কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়। কুচকাওয়াজে সালাম গ্রহণ করেন রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান ও রাঙামাটি পুলিশ সুপার মীর আবু তৌহিদ। পরে শিশু কিশোরদের কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়।
এদিকে নানিয়ারচর উপজেলায় সকালে শহীদ মিনারে পুস্পস্তবক অর্পণ করেন রাঙামাটি জেলা পরিষদ সদস্য ইলিপন চাকমা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ ফজলুর রহমান। পরে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান প্রগতি চাকমা, নানিয়ারচর উপজেলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুজন হালদার সহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন।
পরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সর্বস্তরের মানুষ শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদ প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এছাড়াও শহীদ মিনারে জেলা আওয়ামী লীগ এর বিভিন্ন অংগ সংগঠন, বিএনপির বিভিন্ন অংগ সংগঠন, জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, রাঙামাটি প্রেসক্লাব, বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন পুস্পস্তবক অর্পণ করেন।
বিজয় দিবসের দিন সকালে জেলা প্রশাসনের আয়োজনে রাঙামাটি চিংহ্লা মং মারী স্টেডিয়ামে স্কুলের শিক্ষার্থীদের বর্ণাঢ্য কুচকাওয়াজ ও শরীর চর্চা প্রদর্শন করা হয়। কুচকাওয়াজে সালাম গ্রহণ করেন জেলা প্রশাসক একেএম মামুনুর রশিদ ও পুলিশ সুপার আলমগীর কবির। পরে কুচকাওয়াজ ও শরীর চর্চা প্রদর্শনকারী শিক্ষার্থীদের যোগ্যতার ভিত্তিতে বিভিন্ন পুরষ্কার প্রদান করেন অতিথিরা।
এদিকে সন্ধ্যায় জেলাপ্রশাসন চত্ত্বরে শহীদ আব্দুল আলী মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ডিসিএসপি ছাড়াও প্রশাসনের উর্ধতন ব্যক্তিবর্গ, তাদের পরিবারবর্গ ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ছাড়াও এতে সাধারণ মানুষ অংশ গ্রহণ করে।
দিনটিতে রাজধানীসহ সারাদেশের রাস্তাঘাট, অফিস-আদালত, দোকানপাট, যানবাহন এবং বাসাবাড়িতে পতপত করে উড়েছে লাখো শহীদের রক্তস্নাত লাল-সবুজ পতাকা। ছোট ছোট কাগজ বা কাপড়ের তৈরি পতাকা হাতে নিয়ে বা বুকে-পিঠে লাগিয়ে শিশু-কিশোররা বেরিয়েছিল ঘরের বাইরে। কেউ কেউ মুখে এঁকেছিল লাল-সবুজ পতাকা।
দিনটি ঘিরে বেতার-টেলিভিশনে বিজয় দিবস উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান এবং সংবাদপত্রে ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে দিবসটির মাহাত্ম্য তুলে ধরা হয়েছে। দিবসটি উপলক্ষে হাসপাতাল, শিশু সদন, কারাগার ও এতিমখানায় উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হয়। এছাড়া জাতির সুখ-সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি কামনা করে মসজিদে মসজিদে অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ মোনাজাত। মন্দির, গির্জা, প্যাগোডায় বিশেষ প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়। হাসপাতাল, জেলখানা, বৃদ্ধাশ্রম, এতিমখানা, শিশু পরিবার ও ভবঘুরে প্রতিষ্ঠানগুলোয় উন্নতমানের খাবার সরবরাহ করা হয়।