॥ আনোয়ার আল হক ॥
পার্বত্য চট্টগ্রামের দিকে দিকে এখন উৎসবের আমেজ; পাহাড়ি পল্লীগুলোতে বাহারি খাবারের সুঘ্রাণ আর নানা সাজে সজ্জিত তরুণ তরুণীদের আমোদি পদচারনা। শুরু হয়েছে বর্ষ বিদায়ের আনুষ্ঠানিকতা। আজ সব ঝেড়ে ফেলার দিন, কারণ আজ যে বিজু, আজ সাংগ্রাই, আজ বৈষুক, বিহু, বিষু আর উৎসব। পঞ্জিকার শাসনে মাসের নামটি অপরিবর্তনীয় থাকলেও ধেয়ে আসছে বাংলা নববর্ষ। বিদায় বসন্ত ও ১৪২৯ বঙ্গাব্দ; বসন্ত বিদায় নিচ্ছে তার সব রূপ-রঙ নিয়ে। প্রকৃতিতে ধীরে ধীরে বাড়ছে খরতপনের রুদ্রতাপ। এসে গেল আরেক বৈশাখ। মহাকালের রথ তার যাত্রাপথে পেরিয়ে যাচ্ছে বাংলা ১৪২৯ সনের সীমানা। নিয়ত উদয়াস্তের খেলায় সূর্য আজ পূর্ব দিগন্তে লালিমা ছড়িয়ে জানান দিবে দুয়ারে নয়া বছর।
গতকাল বুধবার ছিল ২৮শে চৈত্র; পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ এদিন থেকেই তাদের উৎসবের সূচনা করে। উৎসব পালনে ভোর থেকেই রাঙামাটি রাজবন বিহার ঘাট, গর্জনতলী, ডিসি বাংলো, কেরানি পাহাড় এলাকা, পলওয়েল, আসামবস্তিসহ শহরের বিভিন্ন জায়গায় নানা বয়সের নারী-পুরুষ ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে কলাপাতায় ফুল ভাসান।
বুধবার (১২ এপ্রিল) সকালে রাঙামাটি শহরের গর্জনতলীতে গঙ্গা দেবীর উদ্দেশ্য ফুল ভাসানোর মধ্যদিয়ে ত্রিপুরাদের বৈসুক উৎসবের উদ্বোধন করেন, খাদ্য মন্ত্রনালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি দীপংকর তালুকদার এমপি। ত্রিপুরা কল্যাণ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অংসুইপ্রু চৌধুরী, জেলা পরিষদ সদস্য বিপুল ত্রিপুরা, ত্রিপুরা কল্যাণ ফাউন্ডেশনের সভাপতি বিদ্যুৎ শংকর ত্রিপুরাসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে বুধবার সকালে কেরানি পাহাড় এলাকায় রাঙামাটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের আয়োজনে কাপ্তাই হ্রদে ফুল ভাসিয়ে ফুল বিজুর উদ্বোধন করেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। এ সময় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. সাইফুল ইসলাম, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের পরিচালক রনেল চাকমাসহ প্রশাসনের উদ্বর্তন কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন।
অন্যদিকে রাঙামাটি রাজবাড়ী ঘাটে বৈসাবী উদযাপন কমিটি উদ্যোগে ভোরে গ্রামের তরুন তরুনীরা ফুল ভাসানোর মধ্যদিয়ে তিন দিন উৎসবের সূচনা করা হয়। রাজবাড়ী ঘাটে বৈসাবি উৎদযাপন কমিটির উদ্যোগে ফুল বিজুর উদ্বোধন করেন বৈসাবী উদযাপন কমিটির আহবায়ক প্রকৃতি রঞ্জন চাকমা, সদস্য সচিব ইন্টু মনি চাকমাসহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
করোনা মহামারির করাল গ্রাসে গত দুইটি বছর পাহাড়ের ঐতিহ্যবাহী বৈসাবি উৎসবের সময় নিতান্তই নিরানন্দে সময় পার করেছে উৎসব প্রিয় নৃগোষ্ঠীর মানুষগুলো। এবার সৃষ্টিকর্তার কৃপায় কেটে গেছে সেই বন্ধাত্ব। এবার তাই উৎসবের আমেজ এক ভিন্ন ব্যঞ্জনা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে পাহাড়ি পল্লী আর শহুরে পাড়াগুলোতে। পুরনো জীর্ণ, হতাশা-ব্যর্থতা, তথা ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনের তাবৎ অমানিশা উতরে সহজাত সুন্দরের প্রয়াস সবার। নতুন দিন, নতুন বছরের সাথে নতুন স্বপ্ন-প্রত্যাশায় জাল বুনছে জাতি। রাজনৈতিক অস্থিরতা কেটে মঙ্গলের বার্তার প্রতীক্ষা সকলের। সকল আঁধার কেটে যাক, আসুক আলো, হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি টুটে যাক বিজু-বৈষুক আর বৈশাখের উৎসব মুখরতায়। গণপ্রার্থনা পেয়েছে কাব্যরূপও- “মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা/ অগ্নি ¯œানে শুচি হোক ধরা।” সত্য-সুন্দরের সম্ভাবনায় শুরু হোক নতুন বছর, নতুন দিন।
হাঁস-ফাঁস করা গরমের মধ্যেও পাহাড় জুড়ে চলছে উৎসবের আমেজ, আর বর্ষবরণে বর্ণাঢ্য আয়োজনের ঘনঘটা। গতকালের ফুলবিজু পেরিয়ে আজ মুল বিজু; যেদিন পাহাড়ের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ঘরে থাকবে সর্বস্তরের জনতার ভিড়। সব নেতাদের বাড়ির আঙ্গিনা থাকবে কানায় কানায় পরিপূর্ণ। আপ্যায়ন হবে সকল পাহাড়ির ঘরেই, পরম মমতায় সাধ্যিক আতিথিয়েতায়। পাহাড়ের দীর্ঘ ঐতিহ্য অনুযায়ী প্রশাসনের কর্মকর্তারাসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ঘুরে ঘুরে সকলের বাসায় গিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় করবেন, গ্রহণ করবেন আতিথিয়েতা।
পুরোনো বছরের সব দুঃখ, কষ্ট ও গ্লানি দূর করে নতুন বছর যাতে সুখ-শান্তিতে কাটানো যায়, সে উদ্দেশ্যে পানিতে ফুল ভাসানো হয়। এছাড়া ফুল সংগ্রহ করে সাজানো হয় বাড়ির আঙিনা। সন্ধ্যায় বৌদ্ধমন্দির, নদীর ঘাটে ও বাড়িতে জ্বালানো হয় প্রদীপ। যুগ যুগ ধরে এই উৎসব উদযাপন করে আসছে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী। চাকমারা বিজু, ত্রিপুরা বৈসুক, মারমারা সংগ্রাই, তঞ্চঙ্গ্যারা বিষু, অহমিয়ারা বিহু—, এভাবে তারা ভিন্ন ভিন্ন নামে আলাদাভাবে পালন করে এই উৎসব।
উৎসবের প্রথম দিনে চাকমা, ত্রিপুরা ও মারমারা বন থেকে ফুল আর নিমপাতা সংগ্রহ করেন এবং পবিত্র ফুল ভাসিয়ে দেন পানিতে। তাই একে বলা হয় ফুল বিজু। পানিতে ফুল ভাসিয়ে বিশ্ব শান্তির মঙ্গল কামনায় গঙ্গাদেবীর কাছে প্রার্থনা করা হয়।
এদিকে পহেলা বৈশাখ ঘিরে এবার জেলা প্রশাসনের আয়োজনে থাকছে বর্ণাঢ্য র্যালী, চিত্রাঙ্কন ও কুইজ প্রতিযোগীতা আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। জেলা প্রশাসন চত্তরে এ আয়োজনে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে সকল শ্রেণির মানুষকে।
বাংলা ভাষাভাষী মানুষের জীবনে এলো নতুন বছরের উৎসবের রঙিন দিন। দিনভর সারাটা দেশ মেতে রইবে নাচে-গানে, উৎসবে-আনন্দে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই উৎসবের রঙে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে। এদিন শুধু আনন্দ-উচ্ছ্বাসই নয়, সব মানুষের জন্য কল্যাণ কামনারও দিন। কালের পরিক্রমায় বাংলা ১৪২৪ সালকে বিদায় জানানোর পাশাপাশি নতুনের আবাহনে আনন্দ-উচ্ছাসে মেতে উঠবে জাতি। সুখ-শান্তি-সমৃদ্ধি ও কল্যাণের প্রত্যাশা নিয়েই মহাধুমধামের সঙ্গে বাঙালি উদযাপন করবে নববর্ষ। একে অন্যকে বলবে শুভ নববর্ষ। বাংলা নববর্ষ এখন আমাদের প্রধান জাতীয় উৎসবও। প্রতিবছর এ উৎসব বহু মানুষের অংশগ্রহণে বিপুল থেকে বিপুলতর হয়ে উঠছে। পহেলা বৈশাখ ছাড়া এত বড় সর্বজনীন উৎসবের উপলক্ষ বাঙালির আর নেই। এই উৎসবের মধ্য দিয়ে বাঙালি তার আপন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আলোকে জাতিসত্তার পরিচয়কে নতুন তাৎপর্যে উপলব্ধি করে গৌরববোধ করে। এই গৌরব ও চেতনাই বাঙালিকে প্রেরণা জোগায় আপন অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে।
বাংলা নববর্ষ বাঙালির মনে-প্রাণে নতুন উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। এক সময় খাজনা আদায়সহ রাজকার্যের সুবিধার জন্য মোঘল স¤্রাট আকবর হিজরীর পাশাপাশি বাংলা সাল প্রবর্তন করেন এবং অগ্রহায়ণের পরিবর্তে বৈশাখ থেকে বর্ষ গণনা শুরু করেন। বাংলা মাস পায় রাজকীয় মর্যাদা। এর আগে এই ভূখণ্ডে মহাধুমধামের সাথে ‘নওরোজ’ উৎসব পালিত হতো। বাংলা সালের গণনা শুরু হয় ১৫৫৬ খ্রীস্টীয় সালের ১১ এপ্রিল থেকে। তবে আমাদের দেশে সরকারিভাবে বাংলা সাল-তারিখ ব্যবহার হয় না বললেই চলে। যদিও পহেলা বৈশাখ উদযাপন জাতীয় উৎসবের মর্যাদা পেয়েছে।
পহেলা বৈশাখ; আলোকধারার আশায় বুক বাঁধি সবাই, যে আলোয় দূর হবে সকল কালো। বীকনবাতির মতো আশা দেখি জাতীয় কবিতে। কেননা নববর্ষে কাজী নজরুল ইসলাম সমাজের জঞ্জাল সরাতে ঘোষণা করেছেন নতুনের মহত্তম আহ্বান ‘ঐ নতুনের কেতন ওড়ে… তোরা সব জয়ধ্বনি কর’। রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ বাংলা নববর্ষকে আমন্ত্রণ জানান আরো প্রত্যয় মগ্ন হয়ে গভীর আকুলতায় ‘অগণ্য অসংখ্য বাধা ওড়ায়ে হয় প্রবল কণ্ঠে তুলি পুরুষ হুংকার, হে বৈশাখ এসো…।’ পহেলা বৈশাখ, কেবল জ্যোতির্বিদ্যা নিরূপিত পৃথিবী আহ্নিক গতির ওপর নির্ভরশীল একটি দিন তা নয়। আমাদের জীবনে চেতনা এবং স্বকীয় সংস্কৃতির পরিচয়ও বটে। যদিও অপসংস্কৃতির চর্চার বাড়াবাড়িতে এই দিনটি প্রায় ফসিল হয়ে এসেছে।
বাংলা নববর্ষ বাঙালির মনে-প্রাণে নতুন উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। এক সময় খাজনা আদায়সহ রাজকার্যের সুবিধার জন্য মোঘল স¤্রাট আকবর হিজরীর পাশাপাশি বাংলা সাল প্রবর্তন করেন এবং অগ্রহায়ণের পরিবর্তে বৈশাখ থেকে বর্ষ গণনা শুরু করেন। বাংলা মাস পায় রাজকীয় মর্যাদা। এর আগে এই ভূখণ্ডে মহাধুমধামের সাথে ‘নওরোজ’ উৎসব পালিত হতো। বাংলা সালের গণনা শুরু হয় ১৫৫৬ ঈসায়ী সালের ১১ এপ্রিল থেকে। তবে আমাদের দেশে সরকারিভাবে বাংলা সাল-তারিখ ব্যবহার হয় না বললেই চলে। যদিও পহেলা বৈশাখ উদযাপন জাতীয় উৎসবের মর্যাদা পেয়েছে।