॥ আলমগীর মানিক ॥
জঙ্গিদের পাশাপাশি বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর নানা সমীকরণে জটিল হয়ে উঠেছে পার্বত্য অঞ্চলের পরিস্থিতি। গোষ্ঠীভিত্তিক দ্বন্দ্বের জেরে পাহাড়ে একের পর সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন আঞ্চলিক সংগঠনের। তাদের আধিপত্য বিস্তারের জেরে খুন, গুম, চাঁদাবাজি যেমন বাড়ছে তেমনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গেও সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে তারা। স্থানীয়রা বলছেন, শান্তি চুক্তির পর দীর্ঘদিন পাহাড় শান্ত থাকলেও গোষ্ঠীভিত্তিক দ্বন্ধের জেরে পার্বত্যাঞ্চলে একের পর এক উত্থান হয়েছে নতুন নতুন আঞ্চলিক দলের। গেল এক দশকে পার্বত্য জেলা বান্দরবানে আত্মপ্রকাশ ঘটেছে জেএসএস সংস্কার, ইউপিডিএফ, ইউপিডিএফ সংস্কার, মগ লিবারেশন পার্টি ও কুকিচিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট নামে বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক সংগঠনের। এসব সংগঠনের জঙ্গি কানেকশন পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।
সাম্প্রতিক সময়ে পাহাড়ে এক নতুন আতঙ্ক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে কেএনএ। এটি কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) একটি সামরিক শাখা। গত বৃহস্পতিবার অবশ্য বান্দরবানে সেনা প্রধানের এমএনপি ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণের নেওয়ার ঘোষণায় কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরেছে জনমনে। তবে সাধারণ মানুষের আশা একইভাবে অন্যান্য সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর বিষয়েও সেনা বাহিনীর অনুরূপ পদক্ষেপ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।
বছরখানেক আগে পার্বত্য জেলা বান্দরবানে সংগঠনটির আত্মপ্রকাশ ঘটে। জানাগেছে, কেএনএফের সামরিক শাখা কেএনএ’র শতাধিক সদস্য তিন বছর আগে প্রশিক্ষণের জন্য মিয়ানমারের কাচিন প্রদেশে যায়। ২০২১ সালে একটি দল ফিরে আসে প্রশিক্ষণ নিয়ে। এ দলের সদস্যরাই এখন সেনাবাহিনীর ওপর একের পর এক হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। বোঝাই যায়, কেএনএ সদস্যরা মিয়ানমার থেকে শুধু প্রশিক্ষণই নয়, অস্ত্রও পাচ্ছে। এছাড়া সন্ত্রাসী সংগঠন কুকিচিন দুর্গম পাহাড়ে মিয়ানমার ও ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। আবার টাকার বিনিময়ে তারা বাংলাদেশি জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এসব ঘটনায় স্থানীয়দের মধ্যে দেখা দিয়েছে উৎকণ্ঠা। অবনতি হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং পিছিয়ে যাচ্ছে পর্যটন খাত। ফলে পাহাড়ের সাধারণ মানুষ ভুগছে নিরাপত্তাহীনতায়। ব্যাহত হচ্ছে উন্নয়ন কর্মকান্ড।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাহাড়ে অনেক সন্ত্রাসী গ্রুপ সক্রিয় থাকার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। এসব সংগঠন চাঁদাবাজি, খুন, অপহরণ, মাদক ব্যবসাসহ নানা অপকর্মে জড়িত। আবার বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপ পারস্পরিক দ্বন্ধ-সংঘাতে লিপ্ত রয়েছে। কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজির ভাগবাটোয়ারাই সশস্ত্র সংঘাতের মূল কারণ বলে জানাগেছে।
এ পর্যন্ত জঙ্গি সংগঠন হিন্দাল শারক্বীয়ার সামরিক প্রধানসহ ৬৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। একইসঙ্গে গ্রেফতার হয়েছে জঙ্গিদের প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করা কুকিচিনের ১৭ জন সক্রিয় সদস্য।
পাহাড়ে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযান যতো জোরালো হচ্ছে, ততোই আগ্রাসী হয়ে উঠছে কুকিচিনের সদস্যরা। এরইমধ্যে সেনাবাহিনীর টহল টিমের ওপর তারা হামলা চালিয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর কেএনএফ সন্ত্রাসীদের হামলায় চার সেনাসদস্য নিহত হয়েছেন।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন গণমাধ্যমকে বলেন, কুকিচিনের সদস্যরা বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন হামলা চালাচ্ছে। বিশেষ করে যারা উন্নয়ন কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং সেনা সদস্যসহ মেডিকেল টিমের সদস্যদের ওপর বিভিন্ন সময় হামলার ঘটনা ঘটেছে।
তবে কেএনএ’র তৎপরতা শুধু এসবের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বলেই প্রতীয়মান। এরা বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মকান্ডে লিপ্ত। তাদের তৎপরতা পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির আগের পরিস্থিতির কথা মনে করিয়ে দেয়, যখন পার্বত্য এলাকা ছিল এক ভয়ের জনপদ। এটিই বড় চিন্তার বিষয়। কাজেই এ ধরনের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো নির্মূলে পাহাড়ে সন্ত্রাসবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করা জরুরি হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সাবেক সংসদ সদস্য ফিরোজা বেগম চিনু বলেন, পাহাড়ে উপজাতীয় সম্প্রদায় থেকে শুরু করে বাঙ্গালীদের কেউই নিরাপদ নয়। অত্রাঞ্চলে কোটি কোটি টাকার চাঁদা আদায়ের লোভে উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা এতোটাই বেপরোয়া হয়ে উঠছে যে, তাদের হাতে খোদ সেনাবাহিনীর সদস্যরাও এখন মারা যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত অস্ত্রের ঝনঝনানিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে পার্বত্যবাসী। পাহাড়ে সন্ত্রাসীদের নির্মূলে প্রত্যাহারকৃত সেনা ক্যাম্পগুলো পুনঃস্থাপনের পাশাপাশি সেনা রিজিয়ন আরো বৃদ্ধি করা এখন সময়ের দাবি। আমরা পার্বত্য এলাকায় স্থায়ী শান্তি নিশ্চিত করতে সরকারসহ সমগ্র দেশবাসীকে এগিয়ে আসার আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি।
অন্যদিকে ব্যবসায়ি নেতা রাঙামাটি চেম্বার অব কমার্স এর সভাপতি আব্দুল ওদুদ বলেছেন, পাহাড়ে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের আগ্রাসন ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে এই সন্ত্রাসীদের হাতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মতো একটি শক্তিশালী বাহিনীর প্রশিক্ষিত সদস্যরা যেখানে নিরাপদ নয় সেখানে আমরা কতোটা নিরাপদ এটা সহজেই অনুমেয়। তাই ব্যবসায়িক বান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে হলে শান্তি শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে হবে। আর এই লক্ষ্যেই পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় অত্রাঞ্চলে সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য বাহিনীগুলোর উপস্থিতি আরো বৃদ্ধি করতে হবে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘জঙ্গিদের সাধারণ জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। জনগণের সহায়তা ও সমর্থন হারালে এবং সাধারণ মানুষ যদি বুঝতে পারে জঙ্গিদের দিয়ে তাদের কোনো উপকার হবে না,তবেই কেবল জঙ্গিদের ব্যর্থ করা সম্ভব।’ আর তাদের বিষয়ে যে জিরো টলারেন্সের কথা বলা হচ্ছে, তা বজায় রাখতে হবে বলেও মনে করেন তিনি।