পার্বত্য শান্তি চুক্তির আজ ২৬ বছর উন্নয়ন হয়েছে; বেড়েছে চাঁদাবাজীও

135

॥ আনোয়ার আল হক ॥

আজ শনিবার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৬ বছর পূর্তি। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদিত হয়। পার্বত্য তিন জেলায় দীর্ঘ দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা হিংসা হানাহানি, অস্ত্রবাজি ও রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অবসান ঘটিয়ে শান্তির আশায় করা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে সরকারের পক্ষে জাতীয় সংসদের তৎকালীন চিফ হুইপ আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসাধারণের পক্ষে জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা চুক্তিতে সই করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই সাহাসী পদক্ষেপ সে সময় দেশে বিদেশে ব্যাপকভাবে প্রসংশিত হয় এবং চুক্তিটি শান্তিচুক্তি নামে অভিহিত হয়। যদিও তখনকার বিরোধী দলগুলো একে কালো চুক্তি নামে আখ্যায়িত করেছিল।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর পাহাড়ে সাময়িকভাবে অস্ত্রবাজির অবসান হয়। সেই সুযোগেই সরকার উন্নয়নে মনযোগ দেয় এবং গত ২৬ বছরে পাহাড়ে অকল্পনীয় উন্নয়ন হয়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। পাহাড়ে অবকাঠামো উন্নয়ন থেকে শুরু করে শিক্ষা, চিকিৎসা, বিদ্যুৎ এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হওয়ায় পাহাড়ের মানুষের আর্থসামাজিক উন্নতি এবং ক্রয়-ক্ষমতা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

কিন্তু শান্তির আশায় করা চুক্তির ২৬ বছর পূর্ণ হলেও সবুজ-শ্যামল ছায়া সুনিবিড় পার্বত্য চট্টগ্রামে আজও শান্তি অধরা। চারিদিক বারুদের গন্ধ, রক্তের হোলিখেলা, হিংসা-হানাহানি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজী এবং গুম-খুন অপহরণের প্রতিযোগীতায় অশান্তির আগুন প্রতিনিয়ত আরো যেন উস্কে উঠছে।

একদিকে সরকার বলছে চুক্তির বেশীরভাগ ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে, অন্যদিকে জনসংহতি সমিতি বলছে, চুক্তির মুল বিষয়গুলি এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। সরকারি তথ্যমতে, শান্তিচুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়েছে, বাকিগুলোও বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া চলমান। সরকারের পক্ষ থেকে মাত্র একটিই শর্ত ছিল সশস্ত্র পাহাড়ি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো অস্ত্র সমর্পন করবে। কিন্তু সরকার সমর্থক নয় এমন পাহাড়ি নেতাদের ছত্রছায়ায় পাহাড় অস্ত্রমুক্ত করা যায়নি ২৬ বছরেও। তাই পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সেনাক্যাম্প বৃদ্ধির মাধ্যমে আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি রাজনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ খুঁজে বের করার উপর গুরুত্বারোপ করেছেন পাহাড়ের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ।

চুক্তি মোতাবেক ৪৫ দিনের মধ্যে শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র সদস্যদের তালিকা প্রদানের পর ১০ ফেব্রুয়ারী ১৯৯৮ থেকে ৫ মার্চ ১৯৯৮ পর্যন্ত ৪ দফায় ১৯৪৭জন সশস্ত্র শান্তি বাহিনীর সদস্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের নিকট আত্মসমর্পণ ও অস্ত্র জমা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছিল। ৮৭৫টি অস্ত্রসহ ২ লাখের অধিক গলা বারুদ তারা জমা দিয়েছিল। ১৯৯৮ সালের ৫ মার্চ সর্বশেষ দলের আত্মসমর্পণের মধ্যদিয়ে জনসংহতি সমিতির সামরিক শাখা শান্তি বাহিনীর পুরোপুরি বিলুপ্তি ঘটলেও স্বসশ্র ক্যাডারের সংখ্যা ও অস্ত্রের মওজুদ আরো তিনগুন বেড়েছে; এমন তথ্য বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার।

উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী চুক্তির পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সামাজিক অপরাধের বাইরে তিন পার্বত্য জেলায় খুন হয়েছে ২ হাজার ৫৭৩ জন মানুষ। অপহৃত হয়েছে অন্তত ২ হাজার ৬২৬ জন। নিহতদের মধ্যে পাহাড়ি-বাঙ্গালী উভয় সম্প্রদায়ে থাকলেও বাঙ্গালীদের সংখ্যা বেশি। বাঙালিরা খুন হয়েছেন সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও চাঁদাবাজির জের ধরে এবং অধিকাংশই পাহাড়িদের হাতে। নিহত পাহাড়িরা মারা গেছে তাদেরই সশস্ত্র তৎপরতা ও আধিপত্য বিস্তারের অন্তঃকোন্দলে।

আওয়ামী লীগের হয়ে চারবার রাঙামাটি থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও সাবেক পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার চুক্তির ২৬ বছরপূর্তি ঘিরে বিশেষ প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছেন, চুক্তি সম্পাদনকারী পক্ষগণের মধ্যে দুরত্বই চুক্তি বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। পাহাড়ে শান্তিচুক্তির পক্ষের নিরীহ মানুষদের খুন, অপহরণ করে যে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে তাতে মানুষের মাঝে ক্ষোভ বাড়ছে। শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া মন্তব্য করে সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার বলেন, আজকে অসংযত বক্তব্য, নৈরাজ্যমূলক আচরণ, অস্ত্রের ভাষায় কথা বলা, শান্তিচুক্তির পক্ষের শক্তিকে দূর্বল করা, গুলি করে হত্যা করাসহ নতুন নতুন অস্ত্রধারী গ্রুপের সৃষ্টি চুক্তি বাস্তবায়নকে ধীর করে দিচ্ছে।

অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সিনিয়র সহ-সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার জানান, চুক্তির মূল সমস্যাগুলোই এখনও বাস্তবায়ন হয়নি দাবি করে বলেন, পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মাঝে হতাশা ঘনিভূত হচ্ছে। তিনিও বলেন, চুক্তি বাস্তবায়নে মুল সমস্যা হলো সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে বোঝাপড়ার অভাব। চুক্তি নিয়ে সরকারের কি ভাবনা তা পরিস্কার করতে বলেন জনসংহতি সমিতির এই প্রভাবশালী নেতা।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সফল, পারস্পরিক দোষারোপ এবং অনিশ্চয়তার দোলচলের মাঝে আজ চুক্তির ২৬ বছর পূর্তি দিবসটি পালন করা হচ্ছে নানা আঙ্গিকে। রাঙামাটিতে সকালে শান্তির জন্য খেলাধুলা শিরোনামে কাপ্তাই হ্রদে নৌকা বাইচের আয়োজন করেছে সেনাবাহিনী। জেলা পরিষদের উদ্যোগে বর্ণাঢ্য র‌্যালী, আলোচনা সভা ও সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। রাঙামাটি পৌরসভা চত্ত্বরে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া চুক্তি সইকারী সংগঠন জনসংহতি সমিতি জিমনেশিয়াম মাঠে আলোচাসভার আয়োজন করেছে, সেখানে সংগঠনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখবেন।