চকরিয়ার ইতিহাস গবেষক সাংবাদিক মুজিবুল হক চৌধুরী

146

॥ মমতাজ উদ্দিন আহমদ ॥

বিংশ শতাব্দির শেষের দিকে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলায় সাংবাদিকতা জগতের অন্যতম পুরুধা ছিলেন বিশিষ্ট ইতিহাস গবেষক, কলামিস্ট সাংবাদিক মুজিবুল হক চৌধুরী। ২০০০ খ্রিস্টাব্দের ২২ আগস্ট রাতে মর্মান্তিক এক সড়ক দুর্ঘটনায় তার প্রাণপ্রদীপ নিভে যায়। এরফলে চকরিয়ার সাংবাদিকতা জগতের একটি সুশোভিত ফুল অকালেই ঝরে যায়। কবি ওমর খৈয়ামের ভাষায়-
‘সব বুলি মিছে সবার মাঝে
একটি বচন সত্য যার,
যে ফুল গিয়াছে নিশায় ঝরিয়া
সে ফুল নাহি ফুটিবে আর।’

চকরিয়ার সাংবাদিকতা ও ইতিহাস গবেষণা কাজের প্রয়োজন ফুরাবার আগেই যেন তিনি চলে গেলেন পরপারে! অন্তিম শয়নে শায়িত হলেন তার প্রিয়জনদের কাঁদিয়ে; শোক সাগরে ভাসিয়ে। তিনি চলে গেলেন, রেখে গেলেন কিছু স্মৃতি কিছু কথা। আমার স্মৃতি থেকে তাকে মূল্যায়নের এটি একটি ক্ষুদ্র প্রয়াস।

আমার সাংবাদিকতা জীবন শুরুর কয়েক বছর পর কক্সবাজারের চকরিয়া থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক চকোরী’ ও ‘পাক্ষিক মেহেদী’র সুবাদে এ মহান সাংবাদিকের স্নেহপরবশ সান্নিধ্য পেয়েছিলাম। ২০০০ সাল পরবর্তী সময়ে চকরিয়ায় এমন গুণী সাংবাদিকের জন্ম হয়েছে হাতেগোনা। প্রতিবছর আগস্ট মাসে নিরবে-নিভৃতে চলে যায় সাংবাদিক মুজিবুল হক চৌধুরীর মৃত্যুবার্ষিকী। বর্তমান প্রজন্মের সাংবাদিকরাও জানেন না মুজিবুল হক চৌধুরীর কথা!
সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি: সাংবাদিক মুজিবের জ্ঞানস্পৃহার বিকাশ ঘটেছিল ছাত্রাবস্থায়। ১৯৬৮-৭৯ সালে চকরিয়াস্থ কাকারা জুনিয়র হাইস্কুলের তদানিন্তন প্রধান শিক্ষক রশিদ আহমদ সম্পাদিত দৈনিক খবরা-খবর নামে একটি দেয়ালিকায় ‘নিজস্ব প্রতিবেদক’ হিসাবে তার সাংবাদিকতায় হাতে ঘড়ি।

দৈনিক, সাপ্তাহিক ও পাক্ষিক পত্রিকায় বার্তা সম্পাদক: ১৯৮৪- ৮৫ সালে চট্টগ্রামের স্বনামধন্য ‘দৈনিক আজাদী’ পত্রিকায় সহ-সম্পাদক হিসাবে সাংবাদিক মুজিবুল হক চৌধুরী পেশাগত দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৮ সালে ‘দৈনিক দেশের কথা’য় কাজ করেন। ১৯৯২ সালে চকরিয়ার প্রথম স্বয়ং সম্পূর্ণ ‘সাপ্তাহিক চকোরী’ প্রকাশের পর থেকে তিনি টানা আট বছর ‘বার্তা সম্পাদক’র দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। জীবন সায়াহ্নে তিনি চকরিয়া থেকে প্রকাশিত ‘পাক্ষিক মেহেদী’তে ‘বার্তা সম্পাদক’ হিসাবে কাজ করেন।
বইয়ের পান্ডুলিপিঃ তিনি জীবনকালে বেশ কটি বইয়ের পান্ডুলিপিও রচনা করেন। তার এই রচনার মধ্যে সমাজ-সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, গল্প, উপন্যাসও জীবনী প্রভৃতি স্থান পেয়েছে। পরপারের ডাকে চলে যাওয়ায় তিনি তার বইসমুহ প্রকাশ করে যেতে পারেননি। সে সময় যতটুকু জেনেছিলাম তার প্রকাশিতব্য বইয়ের মধ্যে ছিল- ‘চকরিয়ার ইতিহাস প্রসঙ্গ’, ইউরোপে বুলবুলের ব্যালে ঐতিহ্য’, ‘পাছে ভুলে যাই’, ‘নৃত্য শিল্পী আফরোজা বুলবুল’, শহীদ আব্দুল হামিদ স্মারকগ্রন্থ’, ‘অন্বিষ্ট প্রতিভা’, চকরিয়া হাইস্কুলের ইতিহাস ও হাজার বছরের চকরিয়া’।

তার রচিত এসব গ্রন্থ/বই গুলি সবই প্রকাশের অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু অকাল মৃত্যু তার সকল আশা আকাঙ্খা সবই ধুলিস্মাৎ করে দেয়। তার এই বইগুলির সবগুলি প্রকাশ হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। যদি প্রকাশের সুযোগ পেয়ে তাকে তবে স্বার্থক হবে তার স্বপ্ন। অপ্রকাশিত থাকলে আমরা তার এই বই গুলি প্রকাশের দাবী জানাই ।

চকরিয়ার ইতিহাস রচনায় অবদানঃ কলম সৈনিক মুজিবুল হক চৌধুরী ছিলেন আজীবন অনন্য মুক্তি সংগ্রামী। জীবনের স্বার্থক মুক্তি সংগ্রামের জন্য যে গুণটি অপরিহার্য তা হলো ইতিহাস চেতনা। আমরা দেখতে পেয়েছিলাম মুজিবুল হক চৌধুরী ছিলেন অসাধারণ ইতিহাস সচেতন ও গবেষক। ইতিহাসের নিপুণ ধারায় সঠিক তথ্য প্রয়োগে সত্য উদঘাটন ছিল তার জীবন সাধনা। গভীর অনুসন্ধিৎসু মন ও অন্তর দৃষ্টি দিয়ে বিচরণ করেছেন ইতিহাসের কণ্ঠকাকীর্ণ পথ-পরিক্রমায়।

স্বীয় জন্মস্থান ও দেশ মাতৃকার ইতিহাস রচনায় মুজিবুল হক চৌধুরী কলমের যে আচড় টেনে ছিলেন তা হয়তো ভেসে বেড়াচ্ছে ইথারে-ইথারে। যতটুকু জেনেছি তিনি তার সামগ্রীক জীবন পরিচালনায় নানা শক্তি ও বাধার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেছিলেন। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে নানান অপশক্তি ও বাধা ডিঙ্গিয়েছিলেন অবলীলায়, চরম সাহসিকতায়।

চকরিয়ার ইতিহাস রচনায় এবং মা, মাটির সাথে নাড়ির সম্পর্কিত দেশ-মাতৃকার ইতিহাস-ঐতিহ্য উদ্ধারে তিনি ছিলেন অগ্রণী লেখকস্বত্ত্বা। ২০০০ সালে সড়ক দুর্ঘনায় তাঁর অকাল মৃত্যুর ফলে চকরিয়াবাসী হারান স্থানীয় ইতিহাস গবেষণায় ব্যাপৃত একজন অনন্য প্রতিভাধর অনুসন্ধিৎসু তীক্ষ্ম ধীশক্তির সাংবাদিককে।
মুজিবুল হক চৌধুরীর রেখে যাওয়া চকরিয়ার ইতিহাস রচনা কাজ শীঘ্রই পূর্ণতা পাবে বলে আশা করছি চকরিয়ার তরুণ প্রজন্মের আরেকজন লেখক হাসান মুরাদ সিদ্দিকীর হাত ধরে। এটা চকরিয়াবাসীর জন্য একটি আশাব্যাঞ্জক খবর।

চকরিয়ার ইতিহাসে সাংবাদিক মুজিবঃ ইতিহাস খুব কম মানুষেয় কথা বলে। যাদের নাম ইতিহাসে স্থান পায় তারা অমর। সাংবাদিক মুজিবুল হক চৌধুরী তেমনি মরেও অমর হয়ে থাকবেন। লোকান্তরিত সাংবাদিক মুজিব বেঁচে থাকবেন চকরিয়ার ইতিহাসের অন্তরালে। চকরিয়ার ইতিহাস রচনায় তার অবদানের ছোঁয়া অক্ষয় হয়ে থাকবে। সংগ্রামী এই কলমযোদ্ধার জীবনাবসানের মধ্যে আজ অনুভূত হচ্ছে অতীত অনুসন্ধানের প্রয়োজনীয়তা।
জীবদ্দশায় সাংবাদিক মুজিবুল হক চৌধুরীর মাঝে লুকিয়ে ছিল এক বিরাট প্রতিভা। তার জ্ঞানের গভীরতা, দৃষ্টির স্বচ্ছতা, চিন্তার উৎকর্ষতা ও বিষয় বস্তু উপস্থাপনের কৌশলতা ছিল পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান। তার এ শুণ্যতা পূরণ হবার নয়।

আজ থেকে আরো অন্তত দুই যুগ আগে নিস্তরঙ্গ জীবন প্রবাহের একজন মানুষ কিভাবে এমন আশার আলোক দেখিয়েছেন তার মূল্যায়ন এখন সময়ের দাবী। সাংবাদিক মুজিব প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর জীবনালোকে বেঁচেছিলেন। আমার দেখা তার কর্মজীবন নিতান্ত অল্পসময়।
সে সময়ে আমি একজন তরুণ সংবাদকর্মী। পাশাপাশি পড়ালেখায় ব্যাপৃত ছিলাম। এক-আধটু আলীকদমের ইতিহাস রচনায় হাত দিয়েছি মাত্র। আমার লেখালেখির ঊষালগ্নে তার কথা চিন্তা, অভিজ্ঞতা ও পরিকল্পনার কথা যা শুনেছি তা পূর্ণ ভাবে বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। স্মৃতিও অনেকটা বিভ্রম হয়েছে। যেহেতু তিনি আমার সমসাময়িক ছিলেন না, লেখনীতে অনেক অগ্রজ ছিলেন তাই তার জীবন চরিত্রের অনুপুঙ্খ বিবরণ গুছিয়ে বলাটাও দুষ্কর।
তাকে আমি স্মরণে রেখেছি সরব কলমযোদ্ধাদের চূড়ান্ত অভিযাত্রার উদ্বেল মিছিলের অগ্রসেনানী হিসেবে। চকরিয়ার ইতিহাস অনুসন্ধান ও সাংবাদিকতার শেকড় সন্ধানের বলিষ্ট প্রত্যয়ে। আমি তাকে স্মরণ করবো পরম শ্রদ্ধা আর জীবন চেতনার আলোক উম্মোচনে!
নির্বিক কলম সৈনিক মুজিবঃ সাংবাদিক মুজিবুল হক চৌধুরী ছিলেন চকরিয়ার অবহেলিত জনগণের পক্ষের একজন নির্ভিক কলম সৈনিক। প্রবল পরাক্রান্ত নিপিড়কের রক্তচক্ষুর ভ্রুকুটি কোনদিনই এই কলমযোদ্ধাকে করতে পারেনি ক্লান্ত-দুর্বল চিত্ত।
তিনি ছিলেন যাবতীয় শোষণ-বঞ্চনা ও বৈষম্যের প্রতি প্রচন্ড প্রতিবাদী। অনিয়ম প্রতিকারে সত্যের জয়ধ্বনী। কাল ও যুগের ইতিহাস তার জন্য ছিল খোলা। এক শ্রেণীর ভুঁইফোড় সাংবাদিকের মতো বাস্তবতা থেকে মুখ ফিরিয়ে উটপাখী সাজবার চেষ্টাকে তিনি মনেপ্রাণে ঘৃণা করতেন। সাংবাদিকতার আদর্শে ও সাহসিকতায় তিনি ছিলেন উপমাতুল্য।
তার দৃষ্টিভঙ্গির সাথে অনেকের মতের অমিল ছিল বলে শুনেছি। অনেকের সাথে মতের অমিল হতে পারে ব্যক্তিস্বার্থ বা দলীয় সংকীর্ণতা। কিন্তু আমার কাছে সাংবাদিক মুজিব ছিলেন উপমাতুল্য পুরুষ। তিনি ছিলেন গভীর অনুসন্ধিৎসু ও ধর্মানুরাগী। ঐতিহ্যের প্রতি তার ছিল অগাধ শ্রদ্ধা। প্রকৃত প্রস্তাবেই প্রগতিশীল।
সাংবাদিকতায় সাহসিকতাঃ তার মাঝে ছিল সত্য প্রকাশের দুর্বার সহসিকতা। সততা ন্যায়পরায়নতা বিশ্বস্ততা আপন নির্ভরশীলতা চারিত্রিক দৃঢ়তা ও স্পষ্টবাদিতা তাকে যেকোন প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে মোকাবেলার শক্তি যোগাতো। সংগ্রামী চেতনা ক্রিয়াশীল ছিল তার জীবনে। ক্ষুদ্রতা, সংকীর্ণতা অহমিকা তকে কখনো স্পর্শ করতো না। নীতির প্রশ্নের তিনি ছিলেন অটল, অনড়। তিনি আমৃত্যু দেশস্বার্থ বিরুধি কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে ক্ষুরধার লেখনি চালিয়েছিলেন।
চকরিয়া থেকে প্রকাশিত সে সময়েকার একটি পাক্ষিক পত্রিকায় মৃত্যুর অল্প দিন আগে দেশস্বার্থ বিরোধী বিচ্ছিন্নতাবাদী ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লিখনি শক্তি প্রয়োগ করে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় দৃষ্টান্ত দেখিয়েছিলেন। সঠিক ইতিহাসের তাৎপর্যময় তথ্য প্রয়োগ করেছিলেন এসব লিখনীতে।
মাঠ সাংবাদিকতা মানুষের কাছাকাছি-পাশাপাশি অবস্থান করার একটি পেশা। তিনি আমৃত্যু সে পেশায় ব্যাপৃত ছিলেন। সাংবাদিকতায় নিয়োজিত থেকে মানুষের সুখ, দুঃখ-দুর্দশার কথা পত্র-পত্রিকার পাতায় তুলে ধরেছেছিলেন। প্রশাসনের নজরে টেনে এনেছিলেন ঘটমান দুর্নীতি-অনিয়মের বাস্তব চিত্রগুলো। এতে করে স্বার্থন্বেষী মহলের রক্তচক্ষুর রোষানলেও পড়েছিলেন। কিন্তু তিনি যে কালসংলগ্ন নেতৃপুরুষ ছিলেন তা আমরা অনেকে ভেবে দেখিনি।
স্বদেশ প্রেমঃ তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে তৎসময়কার অস্থিরতা নিরসনে ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে বিভিন্ন দিক-নির্দেশনামূলক নিবন্ধও প্রকাশ করেছিলেন। সে সময়কার সাম্প্রদায়িক শক্তির কুমতলব যাতে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাস্তবায়ন না হয় সে জন্য কলমযুদ্ধে নেমেছিলেন। মৃত্যুর পূর্বকালে প্রকাশিত তার প্রবন্ধ/নিবন্ধসমূহ তার ইঙ্গিত বহন করে।
জীবদ্দশায় তিনি অনেকের কাছে হয়েছেন বিকৃত বা অপ্রয়োজনীয় হিসেবে বিবেচিত। কখনোবা বড়জোর ভক্তকুলের প্রিয় স্মৃতিতে স্থান করে নিয়েছিলেন। মুজিবুল হক চৌধুরীকে অনেকে সাম্প্রদায়িক ও অসাম্প্রদায়িক হীনমন্যগ্রস্থ ভেবেছেন। তিনি ছিলেন একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক। প্রকৃত ইসলামের বিশ্বজনিনতা তার মানস নেত্রে আঁকা ছিল। ইসলামের চিন্তা চেতনায় তিনি পৈত্রিক সূত্রের বিকাশ ঘটান।
আত্মার আত্মীয়ঃ চকরিয়ায় সাংবাদিক সমাজের মাঝে সাংবাদিক মুজিবুল হক ছিলেন অনন্য বৈশিষ্ট্য ও প্রতিভাধর। তাকে মাপতে হবে তার মানদন্ডে। তার সাথে অনেকেই আত্মার সংযোগেই আত্মীয়ে পরিণত হয়েছিলেন। ২০০০ সালে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তার আকস্মিক মৃত্যুর খবর শুনে প্রিয়জানরা প্রচন্ড বেদনা অনুভব করেছেন। সবার অলক্ষে নয়নের জল গড়িয়ে পড়েছিল আমারও।
সাংবাদিক মুজিবুল হক চৌধুরীর সাথে আমার ব্যক্তিজীবনের ঘনিষ্ট কোন সম্পর্ক ছিলনা। তার সাথে আমার পরিচয় খুব অল্প সময়ের আলাপচারিতায়। এই আলাপ চারিতায় তার সাবলিল আলাপের দৃষ্টি ভঙ্গিতেই আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। বিমোহিত হয়েছিলাম তার জ্ঞানস্পৃহা দেখে। সাংবাদিক হিসাবে তার লিখা ছিল অনুসন্ধিৎসু ও প্রবল প্রতিবাদী।
অনুকরণীয় সাংবাদিকঃ নিস্তরঙ্গ জীবন প্রবাহের মুজিবুল হক চৌধুরী ছিলেন সত্যিই এক শিক্ষানুরাগী উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। তিনি গোটা চকরিয়ার জন্য স্মরণযোগ্য প্রতিভা ও অত্যুজ্জ্বল ব্যক্তি। তবে এক্ষেত্রে তার ভক্তের পাশাপাশি রয়েছে অন্ধ বিরুদ্ধবাদী ও নির্দয় সমালোচকও।
এ ক্ষণিকের দুনিয়ার জীবনে ভালো কিছু করতে গেলে যে রকম চাড়ালদের চন্ডালীপনার শিকার হতে হয় সাংবাদিক মুজিবের জীবনেও নেমে এসেছিল বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্বের সংঘাত। অনেকে করেছে তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন।
সম্পর্ক ছেদের পর অনেকে তার বিরুদ্ধে বিদ্বেষপূর্ণ কথার ঢিল ছুঁড়েছে। কিন্তু এসব কখনো তার মনকে তাদের সম্পর্কে নেতিবাচকতায় আচ্ছন্ন করতো না। বরং কোনক্রমে এদের সাথে দেখা হলে আন্তরিকথায়-পারস্পরিকতায় সময় দিতেন। তার জীবন পরিচালনায় আত্মকেন্দ্রীকতা ছিল না। অবৈধ অর্থের পেছনে তিনি ছুটেন নি। তাই নিরহংকার সাংবাদিক মুজিব মৃত্যুকালে একপ্রকার কপর্দহীন অবস্থায় এ নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন।
মৃত্যু: হৃদয় গোলাপ ঝরে গেলোঃ সাংবাদিক মুজিবুল হক চৌধুরী আজ আমাদের মাঝে নেই। মরণসুধা পান করে তিনি পরপরে। ২০০০ সালের ২২ আগস্ট রাতে চকরিয়ার পাক্ষিক মেহেদী পত্রিকার কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফেরার পথে ঘাতক বল্লী চেয়ারকোচ তাকে চাপা দিয়ে প্রাণ সংহার করেন। মুহুর্তেই এ খবর ছড়িয়ে পড়েছিল বায়ু-গতিতে। সুচিত হয়েছিল এক করুরু শোক গাঁথা। পরদিন সকালে আমি আলীকদম বসে শুনতে পাই মৃত্যু সংবাদটি। অমনিই পা বাড়াই চকরিয়ার দিকে। দুপুর নাগাদ পৌঁছি তার সাবেক’ কর্মস্থলে “সাপ্তাহিক চকোরী” অফিসে। তখন চকোরী অফিসে বিরাজ করছিল এক নিদারুন শোকের কালো ছায়া।
এ সময় তার ঘনিষ্ট সহযোগি শ্রদ্ধাভাজন চকোরীর সম্পাদক একেএম গিয়াস উদ্দিন কান্না বিজড়িত কন্ঠে জানিয়েছিলেন এ মৃত্যুর করুণ বার্তা। সে সময় প্রিয় স্যারের সারা দেহমনজুড়ে প্রিয়জন হারানোর বেদনা মূর্তমান হয়ে উঠেছিল। গোটা চকোরী পরিবার ছিল সে সময় শোকাহত ও মর্মাহত! তখন চকোরীর কম্পিউটার মনিটরে ভেসেছিল প্রকাশের নিমিত্তে লেখা হেডলাইন “মুজিবুল হক চৌধুরী আর নেই”। এরই মধ্যে রচিত হলো বিদায়ের বাণী। সবার মুখে সেদিন থমকে গেল ভাষা। কথা প্রকাশের একমাত্র উপরকরণ অশ্রুস্বজল চাহনি। তার এই মৃত্যু ছিল প্রিয়জন ও শুভাকাঙ্খীদের জন্য হৃদয় ভাঙ্গা কষ্টের এক নির্মম বাস্তবতা।
শেষ কথাঃ ‘মৃত্যু’ জীবনের পাশাপাশি এক দ্বান্ধিক সত্য। ‘জন্মিলে মরিতে হবে অমর কে কোথা রবে’; তাই তিনিও মৃত্যুর সুধা পান করেছেন। এতদসত্ত্বেও তার মৃত্যুর সংবাদ শোনে সেদিন হৃদয় ভাঙ্গা কষ্টের এক নিদারুন প্রতিধ্বনী উঠেছিল সমস্ত সত্ত্বাজুড়ে।
সাংবাদিক মুজিবুল হক চৌধুরী স্মরণীয় হয়ে আছেন আত্মীয়-পরিজন ছাড়াও তার অনুগামী ভক্তজনের স্মৃতির আঙিনায়। মূলধারার সাংবাদিকদের মাঝে তিনি চির অম্লান। চকরিয়ার প্রয়াত এই নির্ভিক সাংবাদিক, তার সমকালীন যুগের দর্পন ছিলেন। তাই লোকান্তরিত সাংবাদিক মুজিব; শ্বাশত ভবিষ্যতের জন্য লোক অন্তরে ঠাঁই নিয়েছেন।
পরিশেষে তার ঘনিষ্ট সহযোগি চকোরী সম্পাদক অধ্যক্ষ একেএম গিয়াস উদ্দিনের আক্ষেপী কণ্ঠে সুরমিলিয়ে শেষ করছি।
‘…এই পৃথিবীতে যথারীতি সুর্য্য উঠবে। পাখির কলকাকলিতে, মোয়াজ্জিনের আজানে-কর্মব্যস্ত মানুষ জাগবে। পড়ন্ত বিকেলে সব পাখি নীড়ে ফিরবে কিন্তু আমাদের মুজিব ভাই যে আর ফিরবে না এ কঠিন বাস্তবতা মেনে নিতে কষ্ট হবে, ভীষণ কষ্ট হবে, অনাগত অনেক দিন…।’