॥ নুরুল কবির, বান্দরবান ॥
শুস্ক মওসুম শুরু হওয়ার সাথে সাথেই বান্দরবান জেলার ঝিরি-ঝর্নাগুলো শুকিয়ে যেতে শুরু করেছে, এতে দেখা দিচ্ছে তীব্র পানীয় জলের সঙ্কট। বিশেষ করে পাহাড়ের বসবাসরত নারীরা নিদারুন কষ্টে দিনাতিপাত করছে। বান্দরবান চিম্বুক-নীলগিরি-থানচি সড়কের দুপাশে ১১০টি ম্রো পাড়ায় ,এছাড়া লামা, আলিকদম, রুমা, রোয়াংছড়ি, থানচি উপজেলার দুর্গম এলাকার পাহাড়ী পল্লীগুলোতে বিশুদ্ধ পানি সংকটটা আরো বেশী বলে জানা জানা গেছে।
বান্দরবান জেলার বিভিন্ন উপজেলার পাড়াবসতি নিকটবর্তী পানির উৎস সমূহে অতি-সম্প্রতি জেলার বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনে পানির উৎস শুকিয়ে গেছে। কোথাও চলতে চলতে ঝিড়ির শেষ মাথায় গর্তে অল্প পানি জমা আছে সেখান থেকেই বিভিন্ন পাড়ার ম্রো নারীরা পানি সংগ্রহ করছেন। আর কোথাও পাথর উত্তোলন করে পানির উৎস ধংস করা হয়েছে, আর যে সমস্ত ছোট ছোট খালে অল্প অল্প পানি সেখানে হাতি দিয়ে গাছ টানার কারনে হাতির মলমূত্রে খালের পানি দুষিত হয়ে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ক্রামাদি পাড়া, দেওয়াই হেডম্যান পাড়া, যামিনী পাড়া, ম্রোলং পাড়া,বসন্ত পাড়া, নোয়া পাড়াসহ কমপক্ষে ১১০টি পাড়ায় পানি সংকটটা আরো বেশী।
ম্রো লং পাড়ার বাসিন্দা হাই প্লেম ম্রো বলেন -শুষ্ক মৌসুমের সময় পাড়ার নারীদের অন্যান্য কাজ বাদ দিয়ে শুধু নিরাপদ পানি সংগ্রহ করতেই অধিকাংশ সময় ব্যয় করতে হয়। বর্তমানে ২৬পরিবারের ম্রোলং পাড়ায় প্রতি বছর জানুয়ারী থেকে মে মাস পর্যন্ত পাড়ায় পানি তীব্র সংকট থাকে। পাড়ার নারীদের পরিবারের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় পানির জন্য খুব কষ্ট করতে হয়। ভোরে একবার তুলেছিলেন আবার সকাল ১০টায় আরো একবার পানি আনতে ঝিড়িতে যাচ্ছেন, হাই প্লেম ম্রো জানান তিন ঘন্টা অপেক্ষা করার পর অল্প পানি পেয়েছেন।
চিম্বুক ঃ ক্রামাদি পাড়ার প্রবীন ব্যক্তি রাংকোইসা ম্রো (৭১) বলেন পানির অভাবে দুই থেকে তিন মাস পর্যন্ত নিয়মিত গোসল করা যায়না। আরো অনেক দুরে যেতে হয়। যারা কাজে যায় যে যেখানে পানি পায় সেখানে গোসল করে বাড়ীতে ফিরে বলে জানান তিনি। আর নারীরা জুমের কাজে যাওয়ার সময় ময়লা কাপড় থাকলে সাথে করে নিয়ে যায়, যেখানে সামান্য পানি পায় সেখানেই কাপড় ধূয়ে থাকে এইভাবে চলে শুস্কমৌসুমে ম্রো পাড়াবাসীর জীবন। তিনি আরো বলেন এই অবস্থা চলতে থাকলে পানির সংকটের কারনে এখান থেকে অন্যত্র চলে যেতে হবে।
সুয়ালক ইউনিয়নের আমতলী মারমা পাড়ার কারবারী মংপ্রু সাইন মারমা বলেন পাড়ায় তাদের ১৫০ পরিবার, তঞ্চঙ্গ্যা আমতলী পাড়া মাঝের পাড়া, হেডম্যান পাড়াসহ ৫শত পরিবার শুষ্ক মৌসুমে সুয়ালক খালের উপর নির্ভরশীল। কোন রকম গোসল করা যায়, সমস্যা বাঁধে খাওয়ার পানি নিয়ে, সুয়ালক খালের পাড়ে পাত কুয়া তৈরী করে সেখান থেকে পানি সংগ্রহ করে পানি পান করতে হয়। দ্বিতীয় আর কোন উপায় নেই তাই শিশু,যুব, বয়স্ক দৈনিক ৪-৫বার পাত কুয়া থেকে পানি সংগ্রহ করে থাকে বলে জানান তিনি ।
বান্দরবান ম্রো জনগোষ্ঠীর বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক ইয়াং ঙান ম্রো বলেন- বনাঞ্চল ধংস, ঝিড়ির পাথর উত্তোলন করে পানির উৎস ধংস করার কারনে প্রতিবছর চিম্বুক এলাকার প্রায় ১১০টি পাড়ার ম্রো সম্প্রদায় বিশুদ্ধ পানির সংকটে থাকেন। দুর্গম এলাকার অন্যান্য সকল সম্প্রদায়ের বসবাসকারীরাও পানির সংকটে থাকে। সরকারের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা না থাকার কারনে প্রতিবছর “জানুয়ারী থেকে মে”মাস পর্যন্ত চিম্বুক এলাকা সহ দুর্গম আদিবাসী পাড়াগুলো বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকটে থাকে বলে জানান তিনি। তিনি শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন এভাবে চলতে থাকলে আগামী পাঁচ থেকে দশ বছরের মধ্য শুধু পানির অভাবে ম্রো জনগোষ্ঠী চিম্বুক -নীলগিরি এলাকা থেকে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হবে বলে জানান তিনি।
বান্দরবান জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী অনুপ কুমার দে বলেন- পাহাড়ে অপরিকল্পিত ভাবে ঝিড়ির পাশে তথা পানির উৎসের পাশে গাছ কেটে ফেলার কারণে ঝিরি ও ঝর্ণার পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে পানির লেয়ার ও মাটির অনেক নিচে নেমে যাওয়া পাহাড়ে তারাতাড়ি পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া পাহাড়ের মাটির গর্ভে পাথর থাকায় গভীর নলকুপ বসানোর মত সুযোগ নেই।সেখানে রিংওয়েল এবং যেসকল ঝিরিতে শুষ্ক মৌসুমেও পানি থাকে বরাদ্ধ সাপেক্ষে জিএফএস পদ্ধতিতে পানি সরবরাহ করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। চিম্বুক এলাকায়ও ম্রোসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জন্য নিরাপদ পানির ব্যবস্থা কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলে জানান তিনি।