রাজস্ব প্রদানে সেরাদের সম্মানসূচক ‘সি এইচ টি ট্যুরিজম অ্যাওয়ার্ড’ প্রদানের উদ্যোগ বাস্তবায়নে খোঁজ : ব্যবসা আছে লাভ নেই রাঙামাটির পর্যটনশিল্পে : ইস্যু সাম্প্রদায়ীক ও আঞ্চলিক রাজনীতি

14

ঢাকা ব্যুরো অফিস : ১৪ অক্টোবর, ২০২৪

শামিমুল আহসান :
স্থানীয় এবং জাতীয় পর্যায় থেকে পার্বত্য চট্টগামের পর্যটনশিল্পর উন্নয়নে ব্যবসার ক্ষেত্রে ট্যুরিজমশিল্পের আওতায় বিবেচিত যেমন : সড়ক পরিবহন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, লঞ্চ/জলযান পরিবহন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, হোটেল-মোটেল, রেস্টুরেন্ট-রেস্তরাঁ, বার, পিকনিক স্পট, সুইমিং পুল, পর্যটন তথ্যকেন্দ্র ইত্যাদির মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায় রাজস্ব প্রদান করে যারা দেশের রাজস্ব খাতকে সমৃদ্ধ করছেন, এমন প্রতিষ্ঠানের মধ্য থেকে মনোনিত প্রতিষ্ঠান/ব্যাক্তিকে সম্মান জানাতে দৈনিক রাঙামাটি পত্রিকা ও সুন্দরবন পর্যটন ক্লাব’র পক্ষ থেকে যৌথভাবে জাতীয় পর্যায়ে ‘সি এইচ টি ট্যুরিজম অ্যাওয়ার্ড’ প্রদানের উদ্যোগ নেয়া হয়।
এ ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই করা প্রয়োজন, পর্যটনশিল্পে রাজস্ব (ভ্যাট/ট্যাক্স) প্রদানে এগিয়ে কে বা কারা ? যদি সম্মান জানাতে হয় কাকে দেয়া হবে সে সম্মান ? এরি পরিপেক্ষিতে অনুসন্ধানে নেমে অবাক হতে হয় যে, পার্বত্য চট্টগামের পর্যটনশিল্প কোনটি ? কারাইবা এই শিল্পের সেবক ?

এই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে প্রতিয়োমান হয় যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের পর্যটনশিল্প ঘিরে রাজস্ব প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে একদিকে সরকার বিপুল পরিমান রাজস্ব হারাচ্ছে। অপর দিকে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর পাহাড়িরা উপজাতি নাকি বাঙালি ? এবং পার্বত্য চুক্তি বা শান্তিচুক্তির পরে ২০০৬ সালে ১/১১ পর জাতিসংঘ আরোপিত আদিবাসি দাবির ইস্যুতে উত্তাল হওয়া আঞ্চলিক রাজনীতিকে পুঁজি করে ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে প্রতি বছর গ্রাহকদের কাছ থেকে নেয়া শত শত কোটি টাকার ভ্যাট রিটার্ন ও আয়কর ফাঁকি দেয়ার ঘটনা ঘটাচ্ছেন। তবে শুভংকরের ফাঁকির এই পর্যটন খাত থেকে প্রতি বছর কি পরিমান রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হচ্ছে তা আমাদের পক্ষে সঠিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব নয়। রাজস্ব আদায়কারী প্রতিষ্টানের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কাছ থেকেও এ বিষয় সদুত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। তাই, দৈনিক রাঙামাটি পত্রিকার পক্ষ থেকে এ বিষয় ধারাবাহিক অনুসন্ধানি প্রতিবেদন প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ কার্যক্রমের প্রথম পর্বে রাঙামাটি পার্বত্য জেলার উপর অনুসন্ধানি প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হলো।

প্রিয় পাঠক প্রকাশিত প্রতিবেদনে কোন তথ্যের ভুল থাকলে বা ব্যক্তিগত আক্রশমূলক তথ্য প্রকাশিত হয়েছে মনে হলে- এ বিষয় দৈনিক রাঙামাটি পত্রিকার সম্পাদক বরাবরে লিখিত আবেদনের মাধ্যমে জানালে যথাযথ নিয়মে গুরুত্বসহ তা দৈনিক রাঙামাটি পত্রিকাসহ অনলাইন ভার্ষণে প্রকাশ করা হবে।

 

আমাদের উদ্যোগ এবং বর্তমান প্রেক্ষাপট :
দেশে টেকসই পর্যটনশিল্প উন্নয়ন এবং সরকারের বিউটিফুল বাংলাদেশ বিনির্মণে সহায়ক হয়ে পার্বত্য চট্টগামের পর্যটনশিল্প উন্নয়নে রাজনৈতিক কারণে পিছিয়ে পড়া রাঙামাটিকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে নিজস্ব উদ্যোগে দৈনিক রাঙামাটি পত্রিকা ২০১৪ সাল থেকে জতীয় পর্যায় প্রচার-প্রচারনার কাজ চালিয়ে আসছে। প্রতিষ্ঠানটি এই কার্যক্রমকে আরো ব্যপকভাবে ছড়িয়ে দিতে ২০২৩ সালের শেষের দিকে ‘সুন্দরবন পর্যটন ক্লাব’র সাথে যৌথ উদ্যোগে জাতীয় পর্যায়ে ‘সি এইচ টি ট্যুরিজম অ্যাওয়ার্ড’ প্রচলন করার পরিকল্পণা গ্রহণ করা হয়। পরিকল্পণা মতে এ বছর ৩রা জুন ২০২৪ তারিখ সোমবার, জাতীয় জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে এ সংক্রান্ত প্রথম অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ‘পার্বত্য নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটনশিল্প উন্নয়নের নিয়ামক’- শীর্ষক আলোচনা ও ‘পার্বত্যভূমির পথেপ্রান্তরে ও একটি উপন্যাসের সন্ধানে’ গ্রন্থের লেখক একুশে পদকপ্রাপ্ত বিশ^বরেণ্য কথাসাহিত্যিক ড. সেলিনা হোসেনকে সংবর্ধনা প্রদান করে ‘সি এইচ টি ট্যুরিজম অ্যাওয়ার্ড’ প্রচলনের কর্যক্রম শুরু করা হয়। আয়োজকদের দাবি হচ্ছে, গ্রন্থ দুটির লেখক তার পর্যটনপ্রিয় পাঠকদের পার্বত্য চট্টগ্রামে ভ্রমণে আকৃষ্ট করে তিন পার্বত্য জেলার পর্যটনশিল্প উন্নয়নে যথেষ্ট অবদান রেখেছেন।


এছাড়াও বিভিন্ন ক্ষেত্রে পর্যটনশিল্প উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য এ অনুষ্ঠানে অন্য যারা ‘সি এইচ টি ট্যুরিজম অ্যাওয়ার্ড’ পান তাঁদের মধ্যে প্রতিষ্ঠান ক্যাটাগরিতে- পার্বত্য চট্টগ্রম উন্নয়ন বোর্ড ও বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে সংবর্ধিত ব্যক্তি ড. সেলিনা হোসেনসহ অন্যরা হলেন, পর্যটনশিল্প উন্নয়নে নির্র্মিত ও প্রচারিত দেশের প্রথম প্রামান্যচিত্র ‘ভিজিট বাংলাদেশ’ পরিচালনার জন্য জামিউর রহমান লেমন, ‘ভিজিট বাংলাদেশ’র ধারা বর্নণা রচনা ও সার্বিক তত্ত¡াবধানের জন্য বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন সাবেক মহাব্যবস্থাপক, অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আহসান উল্লাহ, পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটনশিল্প উন্নয়নে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে দৈনিক গিরিদর্পণ সম্পাদক- আলহাজ্জ্ব এ কে এম মকসুদ আহমেদ, ফটো সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে জাতীয় প্রেসক্লাব সদস্য ও দৈনিক আমাদের বার্তার ফটো এডিটর- বুলবুল আহমেদ, পার্বত্য চট্টগ্রামে শিল্প-সংস্কৃতি বিকাশের ক্ষেত্রে রাঙামাটি জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাবেক পরিচালক- মুজিবুল হক বুলবুল, পর্যটনশিল্প উন্নয়নে জাতীয় পর্যায়ে সাংগঠনিক দক্ষতা ও ব্যবসায়ীক ক্ষেত্রে ‘ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব)’ এর সভাপতি- শিবলুল আজম কোরেশী।
দৈনিক রাঙামাটি পত্রিকার প্রকাশক মো. জাহাঙ্গীর কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ অনুষ্টানের প্রধান অতিথি ছিলেন- পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সাবেক সভাপতি, সাবেক এমপি দীপংকর তালুকদার। বিশেষ অতিথি ছিলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব মো: মশিউর রহমান এনডিসি, সেতু বিভাগের সাবেক অতিরিক্ত সচিব, বিশিষ্ট সংবাদ উপস্থাপক ও আবৃত্তিশিল্পী দেওয়ান সাঈদুল হাসান। প্রধান আলোচক ছিলেন, একুশে পদকপ্রাপ্ত বরেণ্য আবৃত্তিশিল্পী ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনিষ্টিটিউটের অধ্যাপক রূপা চক্রবর্তী। আলোচক ছিলেন, স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সাবেক তত্ত¡াবধায়ক প্রকৌশলী বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. বেলায়েত হোসেন, বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পণা সমিতির (এফপিএবি) ট্রেজারার- রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগ সদস্য মো. মুজিবুর রহমান, দৈনিক রাঙামাটি পত্রিকার ইভেন্ট উপদেষ্টা- মো. কামরুজ্জামান। অনুষ্ঠানটি সঞ্চলনায় ছিলেন, দৈনিক রাঙামাটি পত্রিকার সম্পাদক- আনোয়ার আল হক ও সংস্কৃতিজন ত্রিমুনি খান। সাংস্কৃতিক পর্ব পরিচালোনা করেন, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সংগীতশিল্পি ও সংগীত শিক্ষক বীর মুক্তিযোদ্ধা শ্রী সমর বড়–য়া।

লক্ষ্য বাস্তবায়নে যাত্রা :
সি এইচ টি ট্যুরিজম অ্যাওয়ার্ড প্রচলন অনুষ্ঠানটি শেষ করে মূল অ্যাওয়ার্ড প্রদানের জন্য পরবর্তি অনুষ্ঠান আয়োজনের লক্ষে ক্যাটাগরি অনুযায়ী রাজস্ব প্রদানকারী অ্যাওয়ার্ড পার্সনের খোঁজে আমাদের অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু হয় পার্বত্য জেলা রাঙামাটির রাজস্ব অফিস থেকে। কিন্তু সেখান থেকে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। ওই অফিসের কর্মকর্তা জানালেন, হেড অফিস থেকে এ তথ্য নিতে হবে, অথবা হেড অফিস অনুমতি দিলে পরে তারা এ তথ্য দিতে পারেন। এর পর আমাদের অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু হয় জাতীয় রাজস্ব ভবন থেকে। ভবনের গেইট থেকে পরামর্শ নিয়ে কিছুটা ঘোরা-ঘুরি করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে আলাপ চারিতায় জানা গেলো, পর্যটন খাত থেকে কি পরিমাণ রাজস্ব আদায় হয়- আলাদা করে তার কোনো হিসাব কেন্দ্রে থাকে না। এখন পর্যন্ত এমন কোনো রেওয়াজও তৈরি হয়নি। তবে আমাদের কার্যক্রমের জন্য অন্তত রাঙামাটি জেলার পর্যটন খাত থেকে সরকারের তহবিলে কি পারমাণ রাজস্ব আসে তার একটা ফিরিস্তি চাইলে তাদের পরামর্শে ঢাকা থেকে গত ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখ, চট্টগামের আগ্রবাদে অবস্থিত রাজস্ব অফিসের কর অঞ্চল রাঙামাটি জোন অফিসে যাওয়া হয়। এ অফিসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ফরহাদ রহমানের সাথে দেখা করলে তিনি এ বিষয় কোনো প্রকার সহযোগিতা করায় অপারগতা জানিয়ে তার উর্ধোতন কর্মকর্তার কাছে যাবার পরামর্শ দেন। পরে এ অফিসের উর্ধোতন কর্মকর্তা- ডেপুটি কমিশনার (তৎকালীন) রোখসানা খান (রাজস্ব বিভাগ রাঙামাট) এর কাছে গেলে তিনি আমাকে সাক্ষাত না দিয়ে তার অধিনস্ত এ অফিসের অন্য কর্মকর্তা (তৎকালীন) মো. হাফিজুর রহমান খানের কাছে পাঠান। চা চক্রের আলাপ চারিতায় তিনি জানালেন, মূলত: তাদের কাছেও পর্যটন বিষয়ে আলাদা করে ভ্যাট-ট্যাক্সের কোনো তথ্য থাকে না। রাঙামাটি থেকে বা জেলাওয়ারি আলাদা অফিস থেকে এ তথ্য নিতে হবে। পরের দিন ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে, সরকারী বিশেষ ছুটি (জন্মাষ্টামী) থাকায় অপেক্ষা করে তার পরের দিন ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে, রাঙামাটির ভেদভেদি রাজস্ব অফিসে গিয়ে যথা সময়ে এ অফিসের কর্মকর্তাকে না পেয়ে সময়গুণে ঢাকা ফেরার তাগিদ আসে। ফলে এ যাত্রায় আর জানা হলোনা রাঙামাটিতে পর্যটন খাতে ভ্যাট-ট্যাক্স প্রদানে কে সেরা, আর কে ফাঁকিবাজ। পাঠক, এ যাত্রায় ব্যর্থ হলেও পরবর্তি পদক্ষেপে জানাতে পারবো রাঙামাটি তথা পার্বত্য চট্টগ্রামের পর্যটন খাত থেকে সরকার কি পরিমাণ রাজস্ব আদায় করে। তবে যতটা জানা গেছে-


সার্বিক বিবেচনায় রাঙামাটির পর্যটনশিল্প প্রতিষ্ঠান বলতে রাঙামাটি জেলা সদরের তবলছড়িতে অবস্থিত সরকারী সংস্থা বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের- পর্যটন হলিডে কমপ্লেক্স, জেলা সদরে অবস্থিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পরিচালিত- অরন্যক রিসোর্ট, বাঘাইছড়ি থানার সাজেকে অবস্থিত সাজেক ভ্যালী রিসোর্ট ও রুই লুই রিসোর্ট, কাপ্তাইয়ে বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীর পিকনিক স্পট, জেলা সদরের ডিসি বাংলো সড়কে অবস্থিত বাংলাদেশ পুলিশের ‘পলওয়েল কটেজ ও পলওয়েল পাকর্’ ছাড়া রাঙামাটির অন্য কোন প্রতিষ্ঠান পর্যটনশিল্প হিসেবে সরকারকে রাজস্ব দেয় তা জানা সম্ভব হয়নি। শতভাগ পর্যটন অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃত থাকলেও রাঙামাটির বেসরকারী পর্যায়ে যেসব প্রতিষ্ঠান পর্যটন সেবায় নিয়োজিত থেকে ব্যবসা করছে তাদের কাছ থেকে রাঙামাটির রাজস্ব অফিস যে পদ্ধতিতে ভ্যাট-ট্যাক্স সংগ্রহ করছে তা মুলত: সাধারণ ব্যবসা হিসেবে থোক পদ্ধতির কার্যক্রম। এতে করে পর্যটন প্রতিষ্ঠান আর কলা-কচুর ব্যবসা প্রতিষ্টানের মধ্যে কোনো তফাত থাকছে না। অথচ- পর্যটন করপোরেশন তাদের পর্যটন সেবায় পর্যটক শ্রেণীর গ্রাহকদের কাছ থেকে যে পরিমাণ মূল্য নির্ধরণ করে থাকে তার প্রায় সমপরিমাণ মূল্যে রাঙামাটির বাজার ফান্ড কর্তৃপক্ষ বেসরকারী পর্যায়ে সেবামূল্য নির্ধারণ করলেও ভ্যাট-ট্যাক্স নির্ধারণের ক্ষেত্রে তা সাধারণ। কারণ, পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনীতি এবং সাম্প্রদায়ীক নানান ইস্যূতে এখানকার বেসরকারী পর্যায়ের পর্যটক ব্যবসায়ীরা বিশাল পরিমানের লস গুণে থাকেন। তাই সারা বছরের ভ্যাট-ট্যক্স ফাঁকির ইস্যূভিত্তিক শুভংকরের ফাঁকি চলে। জাতীয় এবং স্থানীয় সংবাদ মাধ্যম থেকে যে সংবাদ জানাযায়- তাতে দেখাগেছে, পর্যটন মৌসুমে রাঙামাটির পর্যটন হলিডে কমপ্লেক্স প্রতিদিন ৪/৫ লক্ষ টাকা আয় করে থাকে। অবশ্য এটি গড় আয় নয়। আর সাজেকের বেসরকারী পর্যায়ের ব্যবসা থেকে পর্যটন মৌসুম বাদে বছরের অন্য সময় দুই/তিন দিনের ছুটিতে শুধু হোটেল রেস্টুরেন্ট-রেস্তরাঁ ব্যবসায় প্রায় ২.৫ থেকে ৩ কোটি টাকা নীট মুনাফা হয়।
সরকারী পর্যায়ে ভ্যাট-ট্যাক্স প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পর্যটন করপোরেশনের হেড অফিসের হিসাব শাখার দেয়া তথ্য মতে, রাঙামাটির পর্যটন হলিডে কমপ্লেক্স- হোটেল, মোটেল, কটেজ ও ঝুলন্ত ব্রিজ সবমিলে গত ২৩-২৪ অর্থ বছরে ৫ কোটি ৩১ লক্ষ ৪২ হাজার মোট মুনাফার বিপরিতে ৭০ হাজার পাঁশত টাকার বেশি ভ্যাট প্রদান করেছে। ট্যাক্স দিয়েছে ২৩ হাজার ৯ শত ৪৮ টাকা। এ সময় খাগড়াছড়ি পর্যটন হোটেল মোট মুনাফা করেছে ৭২ লক্ষ ৪৭ হাজার টাকা। ভ্যাট দিয়েছে ৭ লক্ষ ৪৩ হাজার পাঁশত টাকা। কোনো ট্যাক্স প্রদান করেনি। আর বান্দরবান পর্যটন হোটেল মোট মুনাফা করেছে ১ কোটি ৫ লক্ষ ৩৪ হাজার টাকা। ভ্যাট দিয়েছে ৮ লক্ষ ৯৪ হাজার টাকা। ট্যাক্স প্রদান করেছে ৪৭ হাজার টাকা।
এদিকে অবাক করা কান্ড রাঙামাটি জেলা সদরে নামী-দামী অর্ধশতেরও বেশি বেসরকারী আবাসিক হোটেল রয়েছে, যেখানে পর্যটকরা সেবা নিয়ে থাকেন। অথচ মাত্র দুটি হেটেলের নামে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছড়পত্র রয়েছে বলে জানাগেছে। প্রশ্ন ওঠে- তাহলে রাঙামাটিতে আগত হাজার হাজার পর্যটকরা কোন পরিবেশে থাকছেন ?
পরিবহন সেবার মাধ্যমে পর্যটন মৌসুমে প্রতিদিন গড়ে দুই হাজারেরও বেশী পর্যটক রাঙামাটি সদরে যাতায়াত করে থাকেন। কিন্তু রাঙামাটি জেলা সদরের ভ্যাট অফিস পরিবহন খাত থেকে কোনো ভ্যাট-ট্যাক্স আদায় করেনা। এ ক্ষেত্রে ভ্যাট-ট্যাক্স আদায় করা হয় রাজধানী ঢাকা অথবা চট্টগ্রাম থেকে। ফলে পর্যটকদের কাছ থেকে নেয়া ভ্যাট ফাঁকির বড় ঘটনা ঘটছে।


নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনৈক ট্যুর অপারেটর (টোয়াব সদস্য) এ প্রতিবেদককে জানান, তারা পর্যটকদের গ্রুপ  টিম নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে যাতায়াতে পরিবহনসহ সবক্ষেত্রে পাওনার পুরো টাকা অগ্রিম পরিশোধ করে থাকেন। রাজস্ব খাতে তার হিসাব কি ভাবে হয় তা নিয়ে কোনো দিন তারা ভাবেননি। সাধারণ ভাবে যারা গ্রæপট্যুর করেন, তারা এসবের কোনো গুরুত্ব দেননা। ফলে এক্ষেত্রে সরকার কোনো রাজস্ব পায় কিনা তা সন্দেহ জনক। তবে ২৩-২৪ অর্থ বছরে বাজেটে অর্থ মন্ত্রণালয় ট্যুর অপারেটদের আয়ের উপর ১৫% বাধ্যতামূলক ভ্যাট আরোপ করায় ট্যুর অপারেটদের রেজিস্টার সংগঠনগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে এর প্রতিবাদ জানিয়েছে। ট্যুর অপারেটদের দাবী তার গ্রæপ ট্যুরে পর্যটকদের কাছ থেকে নেয়া ধার্যকৃত খরচের মধ্যে সল্প পরিমাণের আয় নির্ধারণ করে থাকেন। সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান ভেদে তা ১০ থেকে ১৫%। ট্যুর অপারেটদের দাবী তারা গ্রæপ ট্যুরে ধার্যকৃত নির্ধারি মূল্য থেকে যাতায়াত, খাবার ও আবাসিক খরচ মেটাতেই ভ্যাট পরিশোধ থাকে। নতুন করে ট্যুর অপারেটিং-এ ভ্যাট নির্ধারণ করা হলে তা হবে একই পণ্যে দুই বার ভ্যাট দেয়ার মত অযৌক্তিক ঘটনা। জানাগেছে, বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড এ বিষয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, ট্যুর অপারেটিং-এর ক্ষেত্রগুলোতে ক্রয় রশিদ থাকলে আলাদা করে আর ভ্যাট দিতে হবেনা।
বেসরকারী পর্যায়ে গড়ে ওঠা রাঙামাটির হোটেল, মোটেল ও রিসোর্টে পর্যটকসহ যে কাউকে অবস্থান করতে হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ১১দফা নির্দেশনা মেনে হোটেলের এন্ট্রি বুকে সঠিক ভাবে সব তথ্য দিয়ে স্বাক্ষর করতে হয়। কিন্তু হোটেলের রুম ভাড়া কত ? এন্ট্রি বুকে তার উল্লেখতো থাকেই না, রশিদও দেয়া হয়না। অপর দিকে রেস্টুরেন্ট-রেস্তোরাঁগুলো থেকেও গ্রাহকদের কোনো রশিদ দেয়া হয়না। এসব ক্ষেত্রেও ভ্যাট ফাঁকির ঘটনা ঘটছে। আর রাঙামাটির রাজস্ব কর্তৃপক্ষ গড়পর্তায় যে ভাবে ভ্যাট আদায় করে থাকেন তাতে করে এ অঞ্চলটি পর্যটন অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃত হলেও এখানে বেসরকারী পর্যায়ে আলাদা করে পর্যটনশিল্প চিহ্নিত হচ্ছে না। এ বিষয়ে সরকারকে নতুন করে ভাবতে হবে।

আঞ্চলিক রাজনীতি ও সাম্প্রদায়ীক ইস্যুতে
পার্বত্য চট্টগ্রামের পর্যটনশিল্পের বর্তমান পরিস্থিতি :


মেধাভিত্তিক চাকুরিতে মুক্তিযুদ্ধ কোটা বাতিল আন্দোলন থেকে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে ‘জুলাই-আগস্ট বিপ্লব ২০২৪’ এর পর ২৭শে সেপ্টেম্বর বিশ^ পর্যটন দিবস ঘিরে পার্বত্য চট্টগ্রামের পর্যটনশিল্প ব্যবসায়ীরা আশায় বুক বেধেছিলেন, যেহেতু- ড. মুহাম্মদ ইউনুস দেশের অন্তর্বতীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টাসহ একই সাথে বেসরকারী বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের দ্বায়িত্বে থাকায় তারা পেছনের ক্ষতি পুশে আর্থিক দৈন্যতা ফেরাতে পারবেন। কিন্তু তা আর হলোনা।

এই প্রতিবেদন প্রকাশের সময় রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান এই তিন পার্বত্য জেলায় সর্ব শেষ ৮ থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত পর্যটকদের ভ্রমণ না করার পরামর্শ দিয়েছে প্রশাসন। একি সময় তিন জেলার জেলা প্রশাসকেরা এই নির্দেশনা জারি করেন। গত ৮ অক্টোবর থেকে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়। এর আগে ৩ অক্টোবর রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নের সাজেকে পর্যটকদের না যেতে পরামর্শ দিয়েছিল জেলা প্রশাসন।
কারণ হিসেবে জানাগেছে, গত ৬ অক্টোবর রোববার ২০২৪, দুপুরে রাঙামাটি বনরূপা মৈত্রী বিহারে সংবাদ সম্মেলন করে পার্বত্য চট্টগ্রাম বৈদ্ধ সম্প্রদায়ের বড় ধর্শীয় উৎসব ‘কঠিন চীবরদান’ অনুষ্ঠান না করার সিদ্ধান্ত নেয় পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্মিলিত ভিক্ষু সংঘ। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে পার্বত্য ভিক্ষু সংঘের সভাপতি ভদন্ত শ্রদ্ধালংকার মহাথের বলেন, সম্প্রতি খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় বিহারে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাটসহ শতাধিক দোকানপাট ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় চারজন আদিবাসী ব্যক্তি নিহত হন। আহত হয়েছে অসংখ্য মানুষ। এ পরিবেশে পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধ সমাজ ও ভিক্ষুসংঘ খুবই উদ্বিঘ্ন ও শঙ্কিত হয়ে এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়। সংবাদ সম্মেলনে তিন পার্বত্য জেলার ১৫টি বৌদ্ধ ভিক্ষু সংঘের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। ফলে প্রশাসনও এ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়।
উল্লেখ করা প্রয়োজন, আশ্বিনী পূর্ণিমাকে প্রবারণা পূর্ণিমা বলা হয়। প্রবারণা পূর্ণিমার পর থেকে এক মাসের জন্য কঠিন চীবরদাননুষ্ঠান উদযাপন করা হয়। এক মাস ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় দুইশ বিহারে ধারাবাহিকভাবে কঠিন চীবরদাননুষ্ঠান উদযাপন করা হয়। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তুলা থেকে সুতা, সুতা থেকে চীবর (ভিক্ষুদের পরিধেয় কাপড়) তৈরি করা হয়। এই অনুষ্ঠান ঘিরে পার্বত্য চট্টগ্রামে এক মাস ধরে উৎসব পালিত হয়। আশ্বিনী পূর্ণিমা থেকে কার্তিকী পূর্ণিমা পর্যন্ত এই অনুষ্ঠান চলে।
এর আগের বছর নতুন সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট- কেএনএফের তৎপরতার কারণে ২০২২ সালের ২০ অক্টোবর বান্দরবানের রুমা, থানচি ও রোয়াংছড়ির দুর্গম এলাকায় প্রথম পর্যটকদের ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। পরে রুমা ও থানচি থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হলেও রোয়াংছড়িতে পর্যটকদের ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ বহাল ছিল। এরপর খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে দুই দফা সহিংসতার কারণে রাঙামাটির সাজেক ভ্রমণে নিরুৎসাহিত করেছিল প্রশাসন।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি শহরে মোটরসাইকেল চুরির অভিযোগ এনে গণপিটুনিতে মামুন নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি জেলায় পাহাড়ি-বাঙালি সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে। গত মঙ্গলবার দুপুরে খাগড়াছড়িতে ধর্ষনের অভিযোগ এনে এক স্কুলশিক্ষককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার পর পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে সহিংসতা ঠেকাতে ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন। পরদিন বুধবার বেলা তিনটার দিকে পৌর এলাকা থেকে ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করা হয়। সহিংস এসব ঘটনার প্রভাবে তিন পার্বত্য জেলার পর্যটন ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।


সাম্প্রতিক সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ার পেছনে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ছিলো বলে ধারণা করা হয়। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পর অতি উৎসাহি কতিপয় ছাত্র-জনতা ঢাকা বিশ^বিদ্যলয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ভিক্ষোভ সমাবেশ করে নতুন একটি সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ভারতকে এই বলে হুশিয়ার করে যে, ‘যদি- ভারতীয় উস্কানিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিতিশীলতা তৈরি হয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে আলাদা রাষ্ট্র তৈরির চেষ্টা করে তাদের পাহাড়ের দিকে চোখ তুলে তাকায় তা হলে তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে ভারতের যে মুরগি আছে তাদের গলা চেপে ধরবেন। এছাড়া এর কয়েক দিন পর জাতীয় প্রেসক্লাবেও এমন হুশিয়ারি দিয়ে একটি সংগন বক্তব্য দেয়। এদিকে চুরির অভিযোগে গণপিটুনিতে মামুনকে হত্যার কারণে সাম্প্রদায়ীক দাঙ্গার হিসাব মেলানো যাচ্ছে না। কেননা, খাগড়াছরিতে মামুন হত্যা মামলায় আসামির তালিকায় উপজাতিরা অজ্ঞাতনামা। পুর্ব শত্রুতার জেরে সংগঠিত এ হত্যা কান্ডে প্রকাশিত আসামিরা বাঙালি সম্প্রদায়ের লোক।
পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটনশিল্প প্রতিষ্ঠান এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ঠ সেবামূলক প্রতিষ্ঠাগুলো উন্নয়নের ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা একই সাথে পর্যটনশিল্প ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠাগুলোর বড় লোকসানের একমাত্র কারণ পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনীতির অস্থির পরিবেশ। আঞ্চলিক এ রাজনীতির নেপথ্য কথা এ প্রতিবেদনে আগেই বর্নণা করা হয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের মর্ম না বুঝে নিজেদের মধ্যে দ্ব›েদ্ব জড়ানোর ঘটনায় পাহাড়ি-বাঙালি উভয়ই এর জন্য কোনো না কোনো ভাবে দায়ী। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসে ভূমির অগ্রাধিকার প্রশ্নে- পাহাড়ি-উপজাতি সম্প্রদায়ের আদিবাসি স্বীকৃতির দাবীর প্রতিউত্তরে বাঙালিদের আদিবাসি হিসেবে দাবীর সে আন্দোলন এ অঞ্চলের পর্যটনশিল্পকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। পাহাড়ি উপজাতি সম্প্রদায়ের আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর নেতৃবৃন্দ পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটনশিল্পে অস্তিত্ত¡ স্বীকার না করলেও মূলত: পাহাড়ি-উপজাতি সম্প্রদায় পর্যটনশিল্পের ব্যপক সুফল ভোগ করছেন। এটি তারা অনুধাবন করছেন না।

রাঙামাটির পর্যটন খাতে শত কোটি টাকার লোকসান :
প্রধান উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি
বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর ও পর্যটন সমৃদ্ধ পার্বত্য জেলা রাঙামাটি এখন সংকটে রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘাত ও নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতির ফলে পর্যটন শিল্পে ধস নেমেছে। কটেজ, হোটেল-মোটেল, রেস্টুরেন্ট ও পর্যটন-নির্ভর অন্যান্য ব্যবসায়ীদের প্রতিটি সংগঠন দৈনিক ৫০ থেকে ১ কোটি টাকার বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে। যা জুলাই-আগস্ট বিপ্লব থেকে আগামী ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত শত কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
বাঘাইছড়ির সাজেক ভ্যালিকে বলা হয় রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলায় পর্যটক আকর্ষণের প্রাণকেন্দ্র। এখানে মেঘের সঙ্গে পাহাড়ের মিতালি দেখার জন্য সারাবছর পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে। তবে গত ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া পাহাড়ি-বাঙালি সংঘাত এবং প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞার কারণে সাজেক পুরোপুরি পর্যটকশূন্য হয়ে পড়েছে। সাজেক রিসোর্ট মালিক সমিতির হিসাব মতে এখানে দিনে প্রায় ২ কোটি টাকার লোকসান হচ্ছে।
রাঙামাটির সাধারণ আবাসিক হোটেলগুলোর প্রতিটিতে প্রতিদিন ৭০-৮০ হাজার টাকা লোকসান হচ্ছে। রাঙামাটি লঞ্চ মালিক সমিতির সভাপতি মঈন উদ্দিন সেলিম গণমাধ্যমকে জানান, পর্যটনের ভরা মৌসুমে প্রতিদিন ১ কোটি টাকার বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। এদিকে রাঙামাটির পর্যটন খাতের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত তাঁত শিল্পও এই সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। স্থানীয় তাঁতের তৈরি কাপড় সাধারণত পর্যটকদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। তবে বর্তমানে তাঁত পণ্য বিক্রি না হওয়ায় তারাও আর্থিক সংকটে পড়েছে।

এই পরিস্থিতিতে রাঙামাটিসহ তিন পার্বত্য জেলায় পর্যটকদের ভ্রমণে নিরুৎসাহিত করায় রাঙামাটির পর্যটন সংশ্লিষ্ট ১০টি সংগঠন গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে গত ৭ অক্টোবর সোমবার বিকেলে রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছেন।
সংগঠনগুলোর নেতৃবৃন্দ অবিলম্বে পর্যটক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারসহ চার দফা দাবি জানিয়ে স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে- আগামী ৮ থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত পর্যটক ভ্রমণে নিরুৎসাহিত করায় আমরা গভীরভাবে উদ্বেগ ও হতাশা প্রকাশ করছি। আসন্ন শারদীয় দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে পর্যটকরা যখন দেশব্যাপী ভ্রমণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তখন এ ধরনের ঘোষণা ভ্রমণপিপাসুদের কাছে পার্বত্য জেলাগুলোর বিষয়ে অত্যন্ত নেতিবাচক বার্তা দেবে। যা এ অঞ্চলে গড়ে ওঠা পর্যটন খাতকে আবার খাদের কিনারায় নিয়ে যাবে। এ কারণে আমরা পেশা ও বিনিয়োগ বিষয়ে গভীর অনিশ্চয়তায় ভুগছি।

বিবৃতিতে সংগঠনের নেতারা চার দফা দাবি পেশ করেন। দাবিগুলো হচ্ছে- অনতিবিলম্বে তিন পার্বত্য জেলায় ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা, পর্যটন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে এ খাতের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে পরামর্শ করা, পর্যটন খাতে আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য প্রণোদনার ব্যবস্থা করা এবং পর্যটন খাতের উন্নয়ন ও বিকাশের জন্য অব্যাহতভাবে নিজের অর্থ সমাপ্ত নীতি ও আর্থিক সমর্থন সমুন্নত রাখা।
পর্যটন সংশ্লিষ্ট দশটি সংগঠন হলো- রাঙামাটি রিসোর্ট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন, হাউজ বোর্ড ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন, আবাসিক হোটেল মালিক সমিতি, পর্যটনশিল্প সমবায় সমিতি লিমিটেড, টোয়ার, পর্যটন ঘাট ট্যুরিস্ট বোট মালিক সমিতি, রিজাব বাজার ঘাট ট্যুরিস্ট বোট মালিক সমিতি, সমতা ঘাট ট্যুরিস্ট বোট মালিক সমিতি, রেস্টুরেন্ট মালিক সমিতি এবং রাঙামাটি লঞ্চ মালিক সমিতি।

রাজনৈতিক কারণে বাতিল হয় রাঙ্গামাটির বিশেষ পর্যটন অঞ্চল প্রকল্প :
জাতীয় মাস্টার প্লানে আছে ৩১টি পর্যটন স্পট
রাঙ্গামাটিতে ‘এক্সক্লুসিভ ট্যুরিজম জোন’ বা ‘বিশেষ পর্যটন অঞ্চল’ গঠন করার উদ্যোগ ছিলো বিগত সরকারের আমলে। এ লক্ষে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের মাধ্যমে ১২শ’ কোটি টাকার একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করার কাজ হাতে নেয়। এর পর মাস্টার প্লানসহ ডিপিপি প্রস্তাবনা পাঠানো হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে। দীর্ঘ সময় প্রকল্পটি মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের অপেক্ষায় থেকে অবশেষে স্থানীয় রাজনৈতিক কারণে তা বাতিল হয়।
বিভিন্ন সূত্র মতে জানা গেছে, ২০১৬ সালের প্রথম দিকে রাঙ্গামাটিতে বিশেষ পর্যটন অঞ্চল গঠনের এ উদ্যোগ নেয় হয়। সরকারের নির্দেশনায় শুধু রাঙামাটির জন্য এর মাস্টার প্লান তৈরি করে ততকালীন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বৃষ কেতু চাকমার নেতৃত্বে তা বাস্তবায়নে ১২শ’ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়। রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের ততকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী কাজী আবদুস সামাদের তত্ত¡াবোধানে ২০১৭ সালের ২৯ মে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে এ প্রকল্পের প্রস্তাবনা পাঠানো হয়। এর আগের বছর জেলা পরিষদে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে বিভিন্ন মহলের পরামর্শ মতে এ প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়।
এ প্রকল্পে জেলার ১০টি পয়েন্টে পর্যটন স্থাপনা নির্মাণের নক্শাসহ মাস্টার প্লান তৈরি করা হয়। আর তা হলো- শহরের ফিশারিঘাট থেকে পুরাতন বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত সংযোগ সড়কের দুই পাশে পর্যটকদের জন্য আন্তর্জাতিক মানের গ্যালারি নির্মাণ, উভয় দিকের আশেপাশের দ্বীপগুলোকে সংযুক্ত করতে আধুনিক মানের ক্যাবল ব্রিজ নির্মাণ ও ক্যাবল কার সংযোগ স্থাপন করাসহ কাপ্তাই হ্রদের ভাসমান টিলাগুলোতে রেস্টুরেন্ট ও গেস্ট হাউস নির্মাণ, শহরের পর্যটন মোটেল এলাকায় আধুনিক মানের বিনোদন স্পট, সুইমিং পুল, ক্যাবল কার সংযোগ স্থাপন, প্যাডল বোট, ওয়াটার ট্যাক্সি চালু, শহরের জিরো পয়েন্টের লাভপয়েন্ট স্পট উন্নয়ন, লুসাই পাহাড়ে আবাসিক গেস্ট হাউস নির্মাণ করা। পাশাপাশি বালুখালী হর্টিকালচার এলাকায় কমিউনিটি সেন্টার ও ক্যাবল ব্রিজ নির্মাণ, শহীদ মিনার এলাকায় ৪০ কক্ষের একটি আবাসিক হোটেল নির্মাণ, সুবলং ঝর্ণা স্পট উন্নয়ন এবং নির্বাণপুর বৌদ্ধ বিহার স্পট উন্নয়নে কাজ করা।
এছাড়া শহরের প্রবেশমুখ মানিকছড়ি এলাকায় পর্যবেক্ষণ টাওয়ার, আসামবস্তি-কাপ্তাই সড়কে গ্যালারি স্টেট ভিউ সাইট, ঘাগড়ায় ক্যাফেটরিয়া এবং কাপ্তাই নতুনবাজার এলাকায় থ্রি স্টার হোটেল নির্মাণের পরিকল্পণা করা হয়েছিলো।


এ প্রকল্পটি বাতিলের পর পর্যটনশিল্প উন্নয়নে বিগত সরকারের নেয়া জাতীয় মাস্টার প্লান প্রজেক্টে রাঙামাটির পার্বত্য জেলার ৩১টি পর্যটন স্পট উন্ননের আওতায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে বলে জানাগেছে। যে ৩১টি পর্যটন স্পট মাস্টার প্লানে রয়েছে সেগুলো হলো- চাকমা রাজবাড়ি, চিদলাং খুম, চিতমোরোম প্যগোডা (বৈদ্য বিহার), ধুপ্পানি ঝর্ণা, দুমলং পর্বত, পার্বত্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট, ফুরমোন পাহাড়, গাছ কাটাছড়া ঝর্ণা, হাজাছড়া ঝর্ণা, কাপ্তাই ন্যাশনাল পার্ক (প্রশান্তি পার্ক), কাপতাই লেক, কংলাক পাহাড় (সাজেক). মাস্টার পাড়া-চাকমা ভিলেজ, ধুপ্পোছড়া ঝর্ণা, নন্দিরহাট জমিদার বাড়ি, ন্যাড়ামূখ মারমা পাড়া বাজার, নিলাদরি রিসোর্ট এন্ড পার্ক, নকাটা (নওকাটা) ঝর্ণা, প্যানোরমা ঝুম রিসোর্ট এন্ড পিকনিক স্পট, পেদা টিং টিং, রাজবন বিহার, রাঙামাটি ঝুলন্ত ব্রিজ, সাইজাম পাড়া, মারিশ্যা পাড়া- সাজেক, সাজেক ভ্যালি, সিতা পাহাড়, শ্রীমতি চা বাগান, সুভলং ঝর্ণা, সিকাম তৈসা ঝর্ণা (কংলাক ঝর্ণা), মন্দিরাছড়া ও নাবাছড়া গ্রাম।
পর্যটন খাতকে আরো সমৃদ্ধ করতে শিগ্ররই ট্যুরিজম মাস্টার প্লান চূড়ান্ত হবে বলে জানিয়েছেন বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসরীন জাহান। ‘বিশ্ব পর্যটন দিবস-২০২৪’ উপলক্ষে (গত ২৬ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার) সচিবালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি একথা জানান। সচিব বলেন, পর্যটন শিল্প পৃথিবীর একক বৃহত্তম শিল্প হিসেবে স্বীকৃত। পৃথিবীর প্রায় সব দেশে পর্যটন এখন অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার খাত। দেশের সব মানুষকে নিয়ে পর্যটনবান্ধব বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চাই। ‘বিশ্ব পর্যটন দিবস’ আমাদের সে সুযোগ উন্মোচন করবে।
তিনি জানান, দেশের মোট জিডিপির শতকরা ৩ দশমিক ০২ শতাংশ এই শিল্প থেকে আসে। জাতীয় শিল্পনীতি ২০২২-এ পর্যটনশিল্পের ১২টি উপখাতের উল্লেখ রয়েছে। যেখানে অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। নানা ধরণের চ্যালেঞ্জ ও সংকট কাটিয়ে পর্যটনশিল্পে নতুন উদ্যোগ ও ভাবনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে নতুন আঙ্গিকে কাজ চলছে। ধীর গতিতে হলেও বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের অগ্রগতি হচ্ছে। পর্যটনশিল্পের সার্বিক উন্নয়নের জন্য নীতিমালা হালনাগাদকরণসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। ট্যুরিজম মাস্টার প্লান চূড়ান্ত করার কাজ ক্রিয়ায় রয়েছে, অনুমোদন এবং তার আলোকে অগ্রাধিকার নির্ণয় করে বিনিয়োগের মাধ্যমে পর্যটন খাতে দৃশ্যমান উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হবে।
আমাদের প্রস্তাব :
সরকারের কাছে আমাদের প্রস্তাব হলো- সরা দেশে রাজস্ব খাতে ভ্যাট-ট্যাক্স প্রদানের ক্ষেত্রে সরাসরি পর্যটনশিল্প প্রতিষ্ঠান এবং পর্যটনশিল্পে সেবাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো আলাদাভাবে চিহ্নিত করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের নিয়ন্ত্রণে থাকবে হবে। উভয় প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল পদ্ধতিতে পর্যটন খাত থেকে রাজস্ব আদায়ের অবাদ তথ্য নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করবে।


আলাদা ওয়েবসাইট এর মাধ্যমে রাজস্ব বোর্ড পর্যটন খাত থেকে আদায় করা ভ্যাট-ট্যাক্স এর তথ্য সংরক্ষণ করবে। সাধারণ নাগরিকসহ রাষ্ট্রের যে কোনো সংস্থা বা মিডিয়া চাইলে তথ্য অধিকার আইনে সে তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে। ধারনা করা হচ্ছে, এতে করে রাজস্ব ফাঁকি এবং ঘুষ-দূর্নীতি কমে রাজস্ব খাত সমৃদ্ধ হবে।
যেমন- একটি বাস রাঙামাটি থেতে ঢাকা বা আরো দূরে যাকনা কেনো কাউন্টার থেকে কতটি টিকিট কাটা হলো, বিনিময় কতটাকা আসলো, তার বিপরিতে এজেন্টের কতিশন কত ? তা হেড অফিস থেকে তৎক্ষণাত সে হিসাবসহ প্রয়োজনীয় সব তথ্য নেয়া হয়। এতে করে লোকাল এজেন্ট মালিক পক্ষকে ফাঁকি দিতে পারে না।
আমাদের বোধগম্য নয়, রাষ্ট্রের চালিকা শক্তির অন্যতম হচ্ছে রাজস্ব। এক্ষেত্রে গোপনীয়তা থাকবে কেন ? মূলত: এই গোপনীয়তাই ঘুষ-দূর্ণীতিকে প্রশ্রয় দেয় বলে মনে করা হয়।

 

ইতিহাস-ঐতিহ্যে রাঙামাটির পর্যটনশিল্প :

পাহাড়-ঝর্ণা আর বিশ^খ্যাত মৎস্য উতপাদনক্ষম কাপ্তাই হ্রদ পরিবেষ্টিত সবুজ-শ্যামল প্রকৃতি ঘেরা পার্বত্য জেলা রাঙামাটি। ব্রিটিশ উপনিবেসিক আমল থেকে পার্বত্য জেলা রাঙামাটি ভ্রমণ বিলাসি পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় একটি পর্যটন অঞ্চল। সেই থেকেই উচ্চাবিলাসি পর্যটকরা রাঙামাটিতে ভ্রমণ করতে আসতেন। তবে তা ব্যবসাভিত্তিক ছিলো না।


১৮৬০ সালের ২০ জুন রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান- এই তিন পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা গঠিত হয়। জেলা গঠনেরর পূর্বে চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলের নাম ছিল কার্পাস মহল। তখন এ অঞ্চলে প্রচুর কার্পাস তুলা উৎপাদন হতো। ১৯৮১ সালে বান্দরবান এবং ১৯৮৩ সালে খাগড়াছড়িকে পৃথক জেলা হিসেবে গঠন করা হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার মূল অংশ রাঙ্গামাটিও আলাদা পার্বত্য জেলা হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায়। ব্রিটিশ পূর্বকাল থেকে প্রথাগত ভাবে রাজস্ব আদায় ব্যবস্থা রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা চাকমা রাজ পরিবারের নিয়ন্ত্রনে ছিলো। এখনো আনেক ক্ষেত্রে সেই প্রথা চালু আছে।
ব্রিটিশদের আগমনের পূর্বে কার্পাস মহল ছিল ত্রিপুরা, মুঘল, চাকমা ও আরাকানের রাজাদের যুদ্ধক্ষেত্র। ইতিহাস মতে চাকমা রাজা বিজয়গিরি রাজ্য জয় করতে করতে এক সময় এই অঞ্চলটিও জয় করে নেন এবং এখানে তাঁর রাজ্য স্থাপন করেন। ১৬৬৬ সালে এই অঞ্চলের কিছু অংশে মুঘলদের অনুপ্রবেশ ঘটে এবং চাকমা রাজার কাছে তারা পরাজিত হন। এই যুদ্ধে মুঘলদের দুইটি কামানের মধ্যে ‘ফতেহ্ খাঁ’ নামক একটি কামান চাকমা রাজার হস্তগত হয়। চাকমা রাজার বীরত্বের প্রতীক হিসেবে মুঘল কামান ‘ফতে খাঁ’ এখনো রাঙ্গামাটি রাজবাড়ির আঙ্গীনায় সংরক্ষিত আছে।

১৭৬০-৬১ সালে ইংরেজ ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ এই অঞ্চলে স্থাপনা গড়ে তোলে প্রায় ২০০ বছর ধরে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত রাজত্ব করেন। ভারত স্বাধীন হলে হিন্দু-মুসলিম জাতি সত্ত¡ার ভিত্তিতে পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব বঙ্গকে পূর্ব পাকিস্তান নাম দিয়ে আলাদা করে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন করা হয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ কর। এর আগে ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধ তৈরির পর হ্রদকে ঘিরে পর্যটন এলাকা গড়ে তোলার পরিকল্পনা ততকালীন সরকারের ছিল। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হলে স্বাধীনতার স্থপতি বঙবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের উন্নয়-অগ্রগতীর লক্ষ্যে পর্যটনকে ব্যবসাভিত্তিক শিল্পে রূপান্তরিত করার লক্ষ্যে ডেলে সাজানোর পরিকল্পণা গ্রহণ করেন।

১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনতা অর্জনের পূর্বে এবং পরের সময়টুকু বেসামরিক বিমান চলাচল সংক্রান্ত বিষয়গুলো তৎকালীন যোগযোগ মন্ত্রণালয় এবং পর্যটন খাত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে ছিল। ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিমান পরিবহন বিভাগ সৃষ্টি করে ঐ বিভাগসহ জাহাজ চলাচল, অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় নামে একটি মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করা হয়। ১৯৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে পুনরায় এ মন্ত্রণালয়কে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের একটি বিভাগ হিসেবে রূপান্তর করা হয়। ১৯৭৭ সালের ডিসেম্বর মাসে পৃথকভাবে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে বিলুপ্ত করে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যস্ত করা হয়। ১৯৮৫ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের পর্যটন আইকন রাঙামাটির ঝুলন্ত ব্রিজটি নির্মাণ করে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন। রাঙামাটি সদর উপজেলার তবলছড়ি এলাকায় ৩৩৫ ফুট দীর্ঘ দৃষ্টিনন্দন এ সেতুটির অবস্থান। দুই পাহাড়ের মাঝখানে দুটি পিলারের ভর করে দাঁড়িয়ে থাকা দৃষ্টিনন্দন এ সেতুটি দেখতে জলপথে ও স্থলপথে যে কোন মাধ্যমে সহজে যাওয়া যাবে। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে একটি পরিচিত নাম রাঙামাটির ঝুলন্ত ব্রিজ।
১৯৮৬ সালে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে পুন: প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনকে এ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যস্ত করা হয়। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন আদেশ ১৪৩ অনুযায়ী ১.০০ কোটি টাকা অনুমোদিত মূলধনের বিপরীতে পাঁচ লক্ষ টাকা পরিশোধিত মূলধন ও ছোট ছোট ৬ টি ইউনিট নিয়ে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করে। তার মধ্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে রাঙ্গামাটি পর্যটন হলিডে কমপ্লেক্স ও কক্সবাজারস্থ হোটেল উপল ও প্রবাল, খুলনার হোটেল সেলিম, জাতীয় পর্যায়ে রেন্ট-এ কার, সাকুরা রেস্তোরাঁ ও বার প্রতিষ্ঠা পায়।


এদিকে ১৯৭৪ সালে বঙবন্ধুর বাঙালি জাতিয়সত্ত¡ার বক্তব্যে প্রতিবাদি হয়ে পাহাড়ি-বাঙালি ইস্যুতে পার্বত্য উপজাতি ও বাম রাজনৈতিক নেতা সর্গীয় শ্রী মানোবেন্দ্র নারায়ন লারমার নেতৃত্বে উপজাতিয়সত্ত¡ার পক্ষে আন্দোলন এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর দেশে বার বার সামরিক আইন জারির ফলে গঠিত শান্তিবাহিনীর কার্যততপরতা অতিমাত্রায় বেড়ে গেলে রাঙামাটিসহ পার্বত্য চট্টগামের পর্যটন কার্যক্রম স্থিমিত হয়ে যায়। এর পর সামরিক পরিস্থিতির কারণে রাঙামাটির পর্যটন বলতে আলোচিত ঝুলন্ত সেতুতেই সিমাবদ্ধ্য থাকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত। ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর নির্বাচনী ইশতেহার মতে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার শান্তিবাহিনীর সাথে সমজোতা স্বাক্ষর করে পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্টের সাথে আঞ্চলিক অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিসমাপ্তি ঘটাতে সক্ষম হন। ১৯৯৭ সালের সে চুক্তির বিষয়ে দেশবাসী খুব ভালো করেই জানেন। যা, পার্বত্য চুক্তি বা শান্তিচুক্তি নামে পরিচিত।

প্রতিবেদনের পরিশেষ :
এই প্রতিবেদনে পরিশেষে জানাতে চাই, এখানকার দিগন্ত বিস্তৃত বনরাজির দিকে তাকালে ভাবুক মন বুঝবেন- ‘সবুজের কত রং হতে পারে’। সবুজের শেষ প্রান্তে মেঘ বালিকার মিতালি, উঁচু-নিচু, আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ, সবুজের বুক চিরে বয়ে যাওয়া কাচালং নদী আর পাহাড়ি ছড়া,ক্ষণিকের জন্য হলেও যে কোনো নিরস মনকেও ভাবুক বানিয়ে দেয়। নগর জীবনের আয়েসী জীবন যাপনে অভ্যস্ত মানুষ এই রূপ ভুলতেই পারেন না। রাঙামাটি জেলা সদরের প্রবেশদ্বারে রয়েছে সাপছড়ির ফুরমোন পাহাড়, আর শেষ প্রান্তে ডিসি বাংলো।


প্রকৃতির রাণী রাঙামাটিতে ভ্রমণ করার জন্য বর্তমানে যে সব দর্শনীয় স্থান রয়েছে, এর মধ্যে সুখী নীলগঞ্জ এবং ফুরমোন পাহাড় অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান। এ ছাড়া কাপ্তাই হ্রদ, পর্যটন মোটেল, ডিসি বাংলো, ঝুলন্ত ব্রিজ, সাজেক, পেদা টিংটিং, সুবলং ঝর্ণা, রাজবাড়ি, রাজবন বিহার, উপজাতীয় জাদুঘর, কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ প্রকল্প, কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
কিন্তু পার্বত্য শহর রাঙামাটি পর্যটকদের কাছে অতি প্রিয় একটি নাম হলেও রাঙামাটি শহরকে এখনো পর্যন্ত পর্যটকদের জন্য খুব বেশি একটা আকর্ষনীয় করে গড়ে তোলা যায়নি। বিগত কয়েক দশকেও এই অঞ্চলে পর্যটকদের জন্য সরকারিভাবে গড়ে উঠেনি পর্যটন সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো। সম্ভাবনা থাকার পরও রাঙামাটির পর্যটন খাতের উন্নয়ন হয়নি। ফলে আগ্রহ হারাচ্ছে পর্যটকরা। স্থানীয়দের অভিযোগ, সরকারের উদ্যোগ পরিকল্পনার বৃত্তে আটকে থাকায় কাঙ্খিত উন্নয়ন হচ্ছে না। দেশের পর্যটনশিল্প উন্নয়নে বিগত সরকার (১১তম সংসদীয় সরকার) যে মেঘা প্রকল্প হাতে নিয়ে ছিলো তাতেও রাজনৈতিক কারনে রাঙামাটি অন্তর্ভূক্ত হয়নি।
সব সময় পর্যটন মৌসুমে রাঙামাটিতে কয়েক লাখ পর্যটকের আগমন ঘটে। কিন্তু রাঙামাটিতে একদিন অবস্থানের পর পর্যটকদের সময় কাটানো বা বিনোদন পাওয়ার জন্য তেমন আর কেনো ব্যবস্থা থাকেনা। বিদেশী পর্যটকদের আসার ক্ষেত্রে নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সার্বিক সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করে রাঙামাটির পর্যটন খাতকে আরো সম্মৃদ্ধশীল করার ক্ষেত্রে স্থানীয় বাসিন্দা ও ট্যুরিজম ব্যবসার সাথে জড়িতদের দাবি থাকলেও তার বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে না। তাদের মতে হ্রদ ও পাহাড়ের মনোরম প্রকৃতি কাজে লাগিয়ে রাঙামাটিতে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা সহজ। কিন্তু তা হচ্ছে না। হবে হয়তো। সে দিনের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের নৃ-গোষ্ঠির সাংস্কৃতিক বৈচিত্রকে পুঁজি করে সরকারী উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতায়, বিশেষ করে শিল্পকলা একাডেমি ও শিশু একাডেমির মাধ্যমে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হলে সরা বছর রাঙামাটির শহর কেন্দ্রিক পর্যটক আগমন ঘটানো সম্ভব। কেননা, দেশের পর্যটন বোদ্ধ্যারা মনে করেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের পর্যটনশিল্প উন্নয়নের আধার হচ্ছে পার্বত্য নৃ-গোষ্ঠির সাংস্কৃতিক বৈচিত্র। তাঁদের সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র দেশের পর্যঠকদে দারুনভাবে আকৃষ্ট করে। তবে এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। আর তা হলো আদিবাসি-বাংঙালি ইস্যূভিত্তিক আঞ্চলিক রাজনীতি। এ বিষয় দেশের মানুষ সব জানেন।

এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করে স্থানীয় সকল জনগোষ্ঠির (সে পাহাড়ি-আদিবাসি বলি বা পাহাড়ি-উপজাতি বলি, কিংবা বর্তমান রাজনীতির বাঙালি আদিবাসি ? যে ভাবেই বলি না কেন) শিক্ষিত বেকারদের পর্যটন খাতের সাথে সম্পৃক্ত করলে রাঙামাটির পর্যটন খাত সমৃদ্ধ হয়ে এখানকার মানুষের জীবনমানেও আমূল পরিবর্তন আসবে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষক মহল। এই প্রত্যাশা আমাদেরও।

লেখক, সাংবাদিক- শামিমুল আহসান
ঢাকা ব্যুরো প্রধান, দৈনিক রাঙামাটি

তথ্য সূত্র ও অনুসন্ধান- জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন, বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড, আনোয়ার আল হক, সম্পাদক- দৈনিক রাঙামাটি, ইন্টারনেট-ইউকিপিডিয়া ও অনলাইন নিউজ পোর্টাল ।