রাঙামাটিতে বিদ্যুত প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণের জন্য অতিরিক্ত মূল্য দেখিয়ে মনিন্দ্র চাকমা চক্রের ৪ কোটি টাকা লোপাট : প্রকল্প বাস্তবায়নে বাধা

363

Untitled-1

আলমগীর মানিক, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, দৈনিক রাঙামাটি : রাঙামাটি সদর উপজেলার শুকরছড়ি এলাকায় ১৩০/১৩২ কেবি (গ্রীড সাব) বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র স্থাপন প্রকল্পের নামে প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা নয়ছয় করে পকেটস্থ করার এক চাঞ্চল্যকর অভিযোগ উঠেছে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে। কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, উপকেন্দ্র স্থাপনের লক্ষ্যে অধিগ্রহণ করা কৃষি জমি বাবদ সরকারিভাবে  সাড়ে ছয় কোটি টাকার অধিক অর্থ পরিশোধ করা হলেও জমির মালিকরা পেয়েছেন মাত্র এক কোটি ৭৬ লক্ষ টাকা। অবিশিষ্ট টাকা একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা আত্মসাৎ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে ক্ষতিগ্রস্থ জমির মালিকরা প্রশাসনে লিখিত অভিযোগ দায়েরের পর প্রাথমিক তদন্তে টাকা নয়ছয়ের প্রমাণ পেয়েছেন তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। তবে আইনের মারপ্যাঁচে আত্মসাৎকারীরা পার পেয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন বলেও অভিযোগ করেছেন কয়েকজন জমির মালিক।

জানা গেছে, মোট ৫ একর ৩৫ শতক জমি অধিগ্রহণ বাবদ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পাওয়ার গ্রীড কোম্পানী মোট ৬ কোটি ৬১ লাখ ৮৫ হাজার ৭০৭ টাকা পঞ্চাশ পয়সা ক্ষতিপূরণ প্রদান করে। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্থ জমির মালিকদের প্রদান করা হয়েছে ১ কোটি ৭৬ লক্ষ টাকা। প্রশাসন থেকে এই টাকার চেক বুঝে নেয় জনৈক মনিন্দ্র চাকমা। জমির মালিকরা ক্ষতিপুরণের টাকায় সন্তুষ্ট হতে না পেরে এখন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যক্রম পরিচালনায় বাধা সৃষ্টি করছে। এতে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে অন্তত দশ কোটি টাকা ব্যয় সাপেক্ষ এই বিশেষ প্রকল্প।

আরো জানা যায়, দুই কিস্তিতে এই ক্ষতিপুরণের টাকা পরিশোধ করা হয়। প্রথম পর্যায়ে জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জেলার দুই সংসদ সদস্যের উপস্থিতিতে ৫ কোটি ৭৬ লক্ষ্য টাকার চেক প্রদান করা হয়। ক্যামেরার সামনে এই চেক বুঝে নেন সাপছড়ি ইউপি চেয়ারম্যান শিমুল চাকমা। কিন্তু চেক বুঝে নেওয়ার পরই তা তুলে দেন জনৈক মনিন্দ্র চাকমার হাতে। দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রায় ৮৬ লাখ টাকার চেক প্রদান করা হলে তাও মনিন্দ্র চাকমাই বুঝে নেন। টাকা পরিশোধের প্রায় একমাস পর সমুদয় ক্ষতিপূরণের টাকা না পাওয়ার অভিযোগ করেন জমিদাতা পরিবারগুলো। তারা ক্ষতিপুরণের ৪ কোটি টাকাই পাননি বলে অভিযোগ তুলেছেন। জেলা প্রশাসক বরাবরে করা অভিযোগপত্রে ক্ষতিপুরণের টাকা না পাওয়া পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ স্থগিত রাখার অনুরোধ জানানোর প্রেক্ষাপটে জেলা প্রশাসন বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখেন।

জানা যায়, জমি অধিগ্রহণের নামে প্রকল্পের বেশীর ভাগ টাকা ব্যয় করে ফেলা হয় এবং এই জমিরি প্রকৃত মূল্যে ১০ গুণ মূল্যায়ন দেখিয়ে টাকাটি আত্মসাৎ করে প্রভাবশালী মনিন্দ্র চক্র। এই চক্রে জড়িত রয়েছে বিদ্যুৎ সাব স্টেশন প্রকল্পের কয়েকজন কর্মকর্তা, স্থানীয় রাজনৈতিক একটি সিন্ডিকেট, জেলা প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা এবং অধিগ্রহণ কার্যক্রমে জড়িত কয়েকজন মধ্যসত্বভোগী।

ক্ষতিগ্রস্থ মালিকরা তাদের আবেদনে বলেন, ৫ একর ৩৫ শতাংশ জায়গার মোট মুল্য ছিলো ৫ কোটি ৭৬ লক্ষ টাকা। বর্তমানে এই জায়গায় বিক্রয় বাবদ ১ কোটি ৭৬ লক্ষ টাকা পাওয়া গেলেও অপর ৪ কোটি টাকা এখনো তাদের হাতে এসে পৌছায়নি। তাই এই জায়গায় বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের কাজ শেষ হয়ে গেলে সরকারের কাছ থেকে আমরা কোন টাকা পাবো না। তাই উক্ত ৪ কোটি টাকা দেয়ার পর কাজ শুরু করার জন্য আবেদন করা হয়।

এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ভূক্তভোগী জানান, তাদের কাছ থেকে জোর পূর্বক পাওয়ার অব এটর্নিতে স্বাক্ষর নেয়া হয়। এজন্য তাদের নানারকম ভয় ভীতি দেখানো হচ্ছে। এদিকে শহরের বাইরে শুকুরছড়ি মৌজায় জায়গার এই দাম দেখে অবাক হয়েছে অনেকই। এ বিষয় রাঙামাটির সাধারণ জনগনের বিস্ময় দেখা দিয়েছে। সাধারণ জনগণ বলেন, রাঙামাটি জেলা প্রশাসনের ভূমি শাখা, বিদ্যুৎ সাব ষ্টেশন প্রকল্প কর্মকর্তা ও মধ্যসত্ব ভোগীরাই এই টাকা আত্মসাতের পিছনে জড়িত রয়েছে। এই বিষয়ে ১৩০/১৩২ কেবি গ্রীড সাব বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র রাঙামাটি অফিসের কর্মকর্তা প্রনয়ণ খীসার সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এই বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিষয়টি সম্পর্কে বলতে পারবে।

অধিগ্রহণকৃত জায়গার মালিকানা নিয়ে সমস্যা রয়েছে বলে জানিয়েছে একটি পক্ষ। সূত্রমতে জায়গার বিশাল অংশের মালিক নানিয়ারচর উপজেলার চেয়ারম্যান এডভোকেট শক্তিমান চাকমা। শক্তিমান চাকমার সাথে কথা বললে তিনি জানান, জেলা প্রশাসনের কতিপয় কর্মকর্তা ও স্থানীয় আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের কয়েকজন নেতা ও স্থানীয় কয়েকজন মিলে আমার অনুপস্থিতিতে আমার জায়গাটি দূর্নীতির মাধ্যমে নিয়ে নিয়েছে। আমাকে ক্ষতিগ্রস্থদের তালিকায়ও রাখেনি। তিনি বলেন, এই প্রক্রিয়ার সাথে স্থানীয় হেডম্যান থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সরকারের দায়িত্বশীল লোক জড়িত থেকে তারাই এই কাজটি করেছে। দীর্ঘ ১৮/১৯ বছর আগে ক্রয় সূত্রে প্রাপ্ত জমিটি উদ্ধারে তিনি মামলা করবেন বলেও জানিয়েছেন।

রাঙামাটি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) তানভীর আজম সিদ্দিকীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, সম্পূর্ণ আইনানুগ পদ্ধতি অনুসরণ করে সংশ্লিষ্ট সকল প্রকার কাগজ পত্র যাচাই-বাছাই করেই পাওয়ার অব এটর্নির হাতে উক্ত জায়গা অধিগ্রহণের চেক হস্তান্তর করা হয়েছে। এতে করে যদি কেউ মধ্যসত্ত ভোগী হিসেবে জমির প্রকৃত মালিকদের টাকা মেরে খায়, সেখানে প্রশাসনিকভাবে আমাদের তেমন কোনো করনীয় নেই। তিনি বলেন, যে কোন প্রকল্পের জন্য জায়গা অধিগ্রহণ করে রাঙামাটি জেলা প্রশাসন। কিন্তু এই জায়গাটি বিদ্যুৎ সাব ষ্টেশন নির্মাণের সাথে জড়িত প্রকল্প কর্মকর্তা এবং পাওয়ার অব এটর্নি মনিন্দ্র লাল চাকমা নিজেরাই এসে এই জায়গা অধিগ্রহণের জন্য আমাদের তাগাদা দেয়। সেই সুত্র ধরে আমরা জায়গাটি অধিগ্রহণের জন্য অফিসের লোক পাঠাই। তিনি বলেন, আইনগত দিক থেকে জেলা প্রশাসনের আর তেমন কোনো করনীয় নেই। কেউ বঞ্চিত হয়ে থাকলে তাকে আইনের আশ্রয় নিতে হবে।

বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করা হলে পাওয়ার গ্রীড কোম্পানীর দায়িত্বশীল কর্মকর্তা দেবাশীষ জানিয়েছেন, সারাদেশের দশটি প্রকল্পের একটি হলো রাঙামাটির শুকুরছড়ির প্রকল্পটি। এই প্রকল্পের জন্য আমরা অধিগ্রহণকৃত জায়গাটির জন্য সাধ্যের বাইরে গিয়ে এর মূল্য পরিশোধ করেছি। এতে করে ক্ষতিগ্রস্থরা যদি তাদের প্রাপ্যতা থেকে বঞ্চিত হয় তাহলে বিষয়টি অতীব দুঃখজনক।

অধিগ্রহণকৃত জমির মালিকদের পক্ষে পাওয়ার অব এটর্নি হিসেবে টাকা বুঝে নেওয়া মনিন্দ্র চাকমা জানিয়েছেন, তিনি জমিদাতাগণের সাথে চুক্তি করে সেই মোতাবেক সমুদয় টাকা পরিশোধ করে দিয়েছেন। এসময় চুক্তির কপি দেখতে চাইলে প্রতিবেদককে আজ না হয় কাল এমন করে তিনদিন পর্যন্ত সময়ক্ষেপন করেও তিনি তার চুক্তিনামাটি দেখাতে পারেননি। এক প্রশ্নের জবাবে মনিন্দ্র জানান, বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে আমার সাথে যোগাযোগ করলে আমি অনেক খোঁজাখুঁজি করে উক্ত জমিটি কিনে দিয়েছি। জমিটি কতো দামে কেনা হয়েছে ? এমন প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যান মনিন্দ্র চাকমা।
এদিকে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের দেখভালের দায়িত্বে থাকা বিদ্যুতের কর্মকর্তাসহ প্রশাসনের রেজিষ্ট্রি অফিসের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রত্যক্ষ যোগশাজসে অতিরিক্ত দাম দেখিয়ে উক্ত জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। আর এতে করে ক্ষতিগ্রস্থরা নামমাত্র মূল্য পেলেও  মোট মূল্যের অন্তত সাড়ে চার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে মধ্যসত্ত্বভোগি একটি চক্র।

সম্পাদনা- শামীমুল আহসান, ঢাকা ব্যুরোপ্রধান