॥ আলমগীর মানিক ॥
এক থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকায় রাঙামাটির অন্ততঃ তিনটি উপজেলায় মিলছে সহযোগি মুক্তিযোদ্ধার সনদ। এমন অভিযোগ খোদ মুক্তিযোদ্ধারা।
রাঙামাটির লংগদু উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় এই সনদপত্র বিক্রি করছেন জনৈক গোলাম মোস্তফা। স্থানীয় বাসিন্দাদেরকে চাকুরিসহ বিভিন্ন ধরনের সরকারি সুযোগ-সুবিধা আনিয়ে দেওয়ার কথা বলে সহযোগি মুক্তিযোদ্ধা পরিষদ নামীয় সংগঠনের সদস্য করছেন তিনি। ওই মোস্তাফা সহযোগী মুক্তিযোদ্ধার সনদ দেওয়ার নাম করে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাঙামাটির লংগদু উপজেলায় গোলাম মোস্তফা নামের এই লোক বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে ৭১ এর সহযোগি মুক্তিযোদ্ধা পরিষদের নামে বৈঠক করে স্থানীয়দের নিয়ে কমিটি গঠন করছে।
তিনি প্রত্যেক সদস্যের কাছ থেকে ফরম পূরণসহ সহযোগি মুক্তিযোদ্ধার সনদপত্র পাইয়ে দেওয়া বাবদ এক থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত নিচ্ছেন। লংগদু’র ইসলামাবাদ, কালাপাকুইজ্জা, ভাসাইন্যাআদমসহ প্রায় সবগুলো এলাকায় এই প্রক্রিয়ায় টাকার বিনিময়ে সহযোগীর সনদপত্র তুলে দেওয়া হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সনদপত্র সংগ্রহকারিদের অনেকেরই বয়স এখনো পঞ্চাশের কোটা পূর্ণ হয়নি।
এদের মধ্যে বেশ কয়েকজন নারী ও পুরুষ জানিয়েছেন, আমাদেরকে জানানো হয়েছে যে, সহযোগি মুক্তিযোদ্ধা হলে মুক্তিযোদ্ধাদের মতোই সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যাবে। এই কারনে তাদের ছেলে-মেয়েরা আগামীতে এর সুফল ভোগ করবে এই আশ্বাসের ভিত্তিতে মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতির আশায় লংগদু উপজেলায় এপর্যন্ত দুই শতাধিক লোক টাকার বিনিময়ে সহযোগি মুক্তিযোদ্ধা পরিষদের সদস্য হয়েছে।
সনদ সংগ্রহকারিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, একেক জনের কাছ থেকে একেক রকম অর্থ আদায় করা হয়েছে। যার পরিমাণ সর্বনিন্ম এক হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত। শনিবারও এই ধরনের একটি বৈঠক করেছেন গোলাম মোস্তফা। উপজেলার ভাসাইন্যা আদম এলাকার ডাঃ রফিক এর দোকানে উক্ত বৈঠকের আয়োজন করেন গোলাম মোস্তফা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে লংগদুতে সনদ প্রদানকারি গোলাম মোস্তফা জানিয়েছেন, একাত্তর সালে আমি মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, কিন্তু সার্টিফিকেট সংগ্রহ করি নাই। এরপর ছেলেমেয়েকে বড় করে শিক্ষিত করে চাকুরির বেলায় অনুভব করলাম মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট না থাকায় তারা সুযোগ পাচ্ছে না। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে, আমি সহযোগি মুক্তিযোদ্ধা পরিষদে যোগদান করি।
এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই এলাকায় কমিটি গঠন করে যারা যারা ইচ্ছুক তাদেরকে নির্দিষ্ট ফি’র মাধ্যমে সদস্যপদ প্রদান করি এবং গাড়িভাড়া বাবদ এক থেকে দেড় হাজার টাকা নিয়ে ঢাকা থেকে সনদপত্র সংগ্রহ করে এনে দিই।
তিনি স্বীকার পুরো উপজেলায় তার মাধ্যমে দুই শতাধিকের মতো লোক সদস্য হয়েছে। অতিরিক্ত টাকা নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি ঢাকা থেকে সনদপত্র সংগ্রহ করতে শুধুমাত্র গাড়ি ভাড়া নিয়েছি; অন্যকোন টাকা নিইনি।
এদিকে প্রতিবেদকের কাছে ফোন করে সাংবাদিক ও কলামিষ্ট পরিচয়দানকারি সরদার গোলাম মোস্তফা নিজেকে ৭১ এর সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা পরিষদ এর চেয়ারম্যান দাবি করে জানান, আমি কিছুদিনের মধ্যেই বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় জয়েন্ট করবো।
এরপর তিনি জানান আমার সংগঠনটিকে সরকারের মন্ত্রী-এমপি সকলেই স্বীকৃতি দিয়েছে। তাই আমি সংগঠনকে গোছানোর লক্ষ্যে রাঙামাটির বরকল, বাঘাইছড়ি ও লংগদুতে সদস্য সংগ্রহের কাজ চালাতে কয়েকজনকে দায়িত্ব দিয়েছি। তিনি বলেন, আমার সংগঠনের সদস্যপদ পেতে হলে একশ’ টাকা ফি দিতে হয়। পরবর্তীতে ঢাকা থেকে সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়।
এক পর্যায়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে ঘরেই সহযোগি মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী যদি বিদেশীদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিতে পারে এবং ভাত রান্না করার জন্য তারামন বিবি’কে খেতাব দিতে পারে তাহলে আমরা যারা সহযোগিতা করেছি তাদেরকে কেন সহযোগি মুক্তিযোদ্ধা ঘোষণা করতে পারবেনা। এমন প্রশ্ন তুলে সরদার গোলাম মোস্তফা বলেন, তাই আমিও সারাদেশের বিভিন্ন এলাকায় কমিটি গঠন করে সহযোগি মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রাঙামাটিতে অনেকের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার বিষয়টি আমিও শুনেছি, এটা মোটেও ঠিক করেনি তারা। তিনি বলেন, কিছুদিন আগে আমি আমার স্বাক্ষর করা ২০/২৫টি সার্টিফিকেট খালি অবস্থায় রাঙামাটির লংগদুতে নিয়ে গেছিলো। হয়তো সেগুলো দিয়েই এসব করা হচ্ছে।
বিষয়টি নিয়ে রাঙামাটি জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার রবার্ট রােনাল্ড পিন্টুর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে, তিনি জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার-আল বদর ও পাকিস্তানের দোসররা ছাড়া পুরো দেশের জনগনই আমাদের সাহায্য করেছে। আমরা এদের সকলকেই মুক্তিযুদ্ধের সহযোগি হিসেবে দেখে আসছি।
কারন তাদের সহযোগিতা ছাড়া আমাদের লড়াই অসম্ভবপর ছিলো। কিন্তু সহযোগি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে টাকার বিনিময়ে সনদপত্র বিতরণ করা খুবই অন্যায় এবং এটি আমাদের জন্য লজ্জাজনক। এই ঘটনার সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে সকলকে সজাগ থাকার পরমর্শ দেন তিনি।