খাগড়াছড়িতে প্রতিবন্ধীদের নিয়ে নতুন শিক্ষালয়ের যাত্রা শুরু

655

॥ খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি ॥

“প্রতিবন্ধীরা সমাজের বোঝা নয়, যদি তাদের উপযোগী করে সুযোগ সৃষ্টি এবং অধিকার নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাদের প্রতিভার বিকাশ ঘটানো যায়। এ প্রতিপাদ্যকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কারিতাস আলোঘর (লাইটহাউজ) প্রকল্প বিগত মার্চ ২০১৫ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ৫ জন প্রতিবন্ধী শিশুকে নিয়ে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার পৌরসভা ১ নং ওয়ার্ড সিঙ্গিনালা একীভূত শিক্ষা কার্যক্রম আলোর দিশারী শিক্ষালয়ের যাত্রা শুরু করেছে।এ শিক্ষালয়ে ছাত্রদের লেখাপড়ার পাশাপাশি, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক চর্চা ও মানবিক মূল্যবোধের শিক্ষা দেয়া হবে।

৫ জন শিক্ষার্থী নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রমের শুরু। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২ জন দৃষ্টি ও ৩ জন শারীরিক প্রতিবন্ধী। থোয়াই অংগ্য মারমা (১৪) তৃতীয় শ্রেণী (দৃষ্টি প্রতিবন্ধী) উচিমং মারমা (১২) দ্বিতীয় শ্রেণী (শারিরীক প্রতিবন্ধী)  উথোয়াইচিং মারমা (১২) প্রথম শ্রেণী (দৃষ্টি প্রতিবন্ধী) শহীন্দু ত্রিপুরা (১০) প্রথম শ্রেণী (শারিরীক প্রতিবন্ধী) ও থুইসানু মারমা (১০) প্রথম শ্রেণী (শারিরীক প্রতিবন্ধী)।

৫ জন শিক্ষার্থী সকলেই বেশ উদ্যোমি, তন্মধ্যে থোয়াইঅংগ্য মারমা একটু ব্যতিক্রমি।  বিগত প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় অংশগ্রণ করে (ব্রেইল পদ্ধতিতে) বাংলা ,সাধারণ গনিত ও ইংরেজী বিষয়ে (এ গ্রেড) পেয়েছে । লেখাপড়ার পাশাপাশি গান বাজনা সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে তার প্রবল ইচ্ছা। যেহেতু  দেখতে পায়না তাই মোবাইল থেকে শুনে আধুনিক, দেশাত্ববোধক ও বিভিন্ন গান মুখস্ত করেছেন এবং নিজে  গান গাইতে পারেন। আলোর দিশারী শিক্ষালয়ে ভর্তির পূর্বে লেখাপড়ার সুযোগ পায়নি।

আলোর দিশারী শিক্ষালয়টি গতানুগতিক শিক্ষাকেন্দ্রের চেয়ে ব্যতিক্রমি। এখানে ছাত্রদের জন্য উন্নত আবাসন ব্যবস্থা, পুষ্টিমান সম্বৃদ্ধ খাবার পরিবেশন ও চিত্ত বিনোদনের ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতিবন্ধী এ সকল শিশুরা কখনও প্রত্যাশাও করেনি, তারা লেখাপড়া শিখবে। আলোর দিশারী শিক্ষালয় তাদের জন্য দ্বার উম্মোচন করে দেয়াতে তারা এখন স্বপ্ন দেখে সু-শিক্ষিত হয়ে পরিবারের বোঝা কমানো এবং অন্য প্রতিবন্ধীদের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে।

আলোর দিশারী শিক্ষালয়ে একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধি শিক্ষক, একজন অফিস সহকারী ও একজন কেয়ার টেকার কাম কুক কর্মরত রয়েছেন। উক্ত শিক্ষালয়ের শিক্ষক রহিমং মারমা জম্মগত ভাবে দৃৃষ্টি প্রতিবন্ধী। তিনি জন্মের পর থেকে পৃথিবীর আলো দেখার সুযোগ পাননি। তবে তার দুটি চোখ  না থাকলেও  তার দৃঢ় মনোবল, একাগ্রতা, উদ্যোমী মনোভাব তাকে ধমিয়ে রাখতে পারেনি।

মাটিরাঙা সম্বনিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী স্কুল থেকে ব্রেইল পদ্ধতিতে লেখাপড়া করে মাটিরাঙা ডিগ্রি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। বর্তমানে  আলোর দিশারী শিক্ষালয়ে শিক্ষক হিসাবে কর্মরত: রয়েছেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি খাগড়াছড়ি ডিগ্রি কলেজে বি,এ পড়াশুনা করছেন। তিনি বলেন, প্রতিবন্ধীরা সমাজে এবং পরিবারে কতোটা অবহেলার পাত্র নিজেই ভূক্তভোগী। তাই তার স্বপ্ন প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে নিজেকে সক্রিয় অংশীদার করা ও  প্রতিবন্ধীদের মাঝে  শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়া।

আলোরদিশারী শিক্ষালয় কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য সাত সদস্য বিশিষ্ট একটি পরিচালনা কমিটি রয়েছে। কমিটির সভাপতি মি: প্রজ্ঞাবির চাকমা একজন প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক। তিনি বটতলী উচ্চ বিদ্যালয় ও খাগড়াছড়ি মিউনিসিপ্যাল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা।

তিনি বলেন, অনেক বছর শিক্ষকতা করার ফলে ছাত্রছাত্রীদের নিজের সন্তানের মতো মনে হতো। একজন মানুষ গড়ার কারিগর হিসাবে জীবনে অনেক ছাত্রছাত্রীকে জ্ঞানের আলো দিয়ে সু- শিক্ষিত করেছি। এখন আমার স্বপ্ন বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন প্রতিবন্ধী শিশুদের কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দেয়া। সমাজের সবচেয়ে পিছিয়েপড়া বিশেষকরে বিভিন্ন ধরণের প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক পর্যায়ে মানসম্মত মৌলিক শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা এবং তাদের মূলস্্েরাতধারায় ফিরিয়ে এনে কার্যকরী একীভূত শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করা।

বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষা সম্প্রসারণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও কারিতাস ফ্রান্সের সহায়তায় কারিতাস বাংলাদেশ আলোঘর  (লাইট হাউস) প্রকল্প খাগড়াছড়ি এরিয়ার আর্থিক ও কারিগরী সহায়তায় প্রকল্পটি পরিচালিত হচ্ছে। যা থেকে প্রতি মাসে ৪০,০০০ (চল্লিশ হাজার) টাকা করে অনুদান পেয়ে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা, চিকিৎসা, আহার, আবাসন, কেন্দ্রভাড়া, কর্মীদের বেতন ও  ছাত্রদের বিনোদনের জন্য ব্যয় করা হয়।

খাগড়াছড়ি জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন এর প্রতিবন্ধী বিষয়ক কর্মকর্তা মো.শাহজাহান বলেন , খাগড়াছড়ি জেলায় অনেক বেসকারী এনজিও সংস্থা কাজ করছেন স্বাস্থ্য ,শিক্ষা কারিগরি শিক্ষা , ঋন কার্যক্রম ও নানা ধরণের কাজ করলেও প্রতিবন্ধীদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য একমাত্র কারিতাস আলোঘর (লাইট হাউস) প্রকল্প ব্যতিত অন্য কোন বেসরকারী সংস্থা তেমনভাবে এগিয়ে আসেনি। বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসকারী এনজিও সমূহ যদি প্রতিবন্ধী শিশু ,প্রবীণ ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করে তাহলে সমন্বিতভাবে প্রতিবন্ধীদের উন্নয়ন সম্ভব। কারিতাস আলোঘর প্রকল্পের কার্যক্রম ও মহতি উদ্যোগ সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে তিনি মনে করেন।

কারিতাস আলোঘর (লাইট হাউস) প্রকল্প খাগড়াছড়ি জেলার এরিয়া কো অর্ডিনেটর মো.মোজাম্মেল হক বলেন , একটি প্রকল্পের শুরু যেমন রয়েছে তেমনি শেষও রয়েছে, তাই আগামী নভেম্বর ২০১৭ খ্রীষ্টাব্দ তারিখ হতে দাতা সংস্থার সাথে চুক্তি অনুযায়ী প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে। যদি নতুন কোন দাতা সংস্থা হাত না বাড়ায় বা অন্য কোন উৎস সৃষ্টি না হয় তাহলে প্রকল্প কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে।