বঙ্গবন্ধুকে হত্যাকারীদের পূণর্বাসনের পরিণতি

688

॥ আনোয়ার আল হক ॥

‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ইতিহাসের বরপুত্র তিনি। ইতিহাস তাঁকে সৃষ্টি করেছে, তিনিও সময়ের অনিবার্যতায় ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁরই নেতৃত্বে এবং নির্দেশে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের।

বাঙালি জাতিসত্ত্বার বিকাশে অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে শাণিত করা ধর্মনিরপেক্ষতা ও শোষণমুক্তির অঙ্গীকারে তিনি নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। সে লক্ষ্যে দুঃখী, শোষিত, বঞ্চিত মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে তিনি বৈপ্লবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এই পদক্ষেপকে তিনি অভিহিত করেছিলেন ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ হিসেবে।

তাঁর  এই দ্বিতীয় বিপ্লবের বৈপ্লবিক কর্মসূচি নস্যাতেই দেশি-বিদেশি শোষকগোষ্ঠী প্রতিক্রিয়াশীল ও স্বাধীনতাবিরোধী চক্র জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে পুনরায় দেশকে পাকিস্তানী ভাবধারা ও ব্যবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যায়। ফলে দেশে গণতন্ত্রের পরিবর্তে স্বৈরতন্ত্র, শোষণমুক্তির পরিবর্তে লুটেরাতন্ত্র, দুর্নীতি এবং দুর্বৃত্তায়ন ও জঙ্গীবাদ আমাদের জাতীয় জীবনকে নানাভাবে ব্যাহত করেছে এবং পিছিয়ে নিয়ে গেছে।

কিন্তু এই জাতির দুর্ভাগ্য যে, জাতির এই সূর্য সন্তানকে নৃসংশভাবে হত্যা করা হলেও সময় মতো তার বিচার হয়নি। বরং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় হত্যাকারীদের সে সময় পূণর্বাসন করা হয়েছিল। আইনজ্ঞদের একটি সর্বজনবিদীত মত হলো কোনো অপরাধের যখন বিচার হয় না বা বিচার বিলম্বিত হয় তখন আরো অপরাধের দার উন্মোচিত হয়। বলা হয়ে থাকে সময়মতো বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার না হওয়ার কারণেই পরে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হত্যার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের সাহস পেয়েছিল চক্রান্তকারীরা।

বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করার পর হত্যাকারীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেরিয়েছে বছরের পর বছর। শুধু বিচার প্রক্রিয়া শুরু হতেই লেগে যায় ২১ বছর। আর এই প্রক্রিয়া শেষ হতে সময় লাগে আরো ১৪ বছর। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু হত্যার ৩৪ বছরের মাথায় তার হত্যাকারীদের মধ্যে পাঁচজনের ফাঁসি কার্যকর করা সম্ভব হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ১২ জন আসামীর মধ্যে একজন ইতোমধ্যে মৃত্যুবরণ করলে আরো ছয়জন এখনও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদন্ড পাওয়া যে পাঁচ আসামির ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। এরা হলেন আর্টিলারি কোরের অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল মহিউদ্দিন, অবসরপ্রাপ্ত মেজর বজলুল হুদা, বরখাস্ত হওয়া কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও ল্যান্সার ইউনিটের অবসরপ্রাপ্ত লে.কর্নেল একেএম মহিউদ্দিন। ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি রাত বারোটা এক মিনিটে কারা কর্তৃপক্ষ এই পাঁচজনের ফাঁসি কার্যকর করে।

সেই কালো রাত সম্পর্কে আমাদের নতুন প্রজন্ম অনেক কিছুই জানেনা। তাদের বিষয়টি সম্পর্কে জানানো আমাদের দায়িত্ব। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বাঙালি জাতির ইতিহাসে ঘটে জঘন্যতম এক হত্যাকান্ড। বরখাস্ত হওয়া একদল সেনা সদস্যের সাথে হাত মিলিয়ে চাকরিরত কিছু বিপথগামী সেনাসদস্য হত্যা করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। সেই কালোরাতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে খুনিরা মেতে উঠেছিল হত্যার উল্লাসে। বঙ্গবন্ধু, তার স্ত্রী, ছেলে, পুত্রবধু, ভাই, ভাগ্নে, ভাগ্নের স্ত্রী, কাজের লোকসহ ২১ জনকে হত্যা করা হয় সে রাতে।

সেইদিন গুলির শব্দে ভোরের আযানের আগেই ঘুম ভাঙ্গে বঙ্গবন্ধুর। যা তিনি কখনো কল্পনাও করেননি সেই বিষয়টিই চরম বাস্তব হয়ে ওই কালো রাতে ধরা দেয় তার চোখে। গোলাগুলির শব্দে দোতলা বাড়ির উপর তলা থেকে ঘুমঘুম চোখে নীচে নেমে আসেন বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামাল। মুহুর্তেই স্টেনগানের গুলিতে ঝাঝরা হয়ে যান তিনি। এরপর এলোপাথারি গুলি চলে কিছুক্ষণ।

কালো পোশাকধারী কয়েকজন দোতলা থেকে নিচে নামিয়ে আনছিল সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে। বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে কামালের বন্ধু ছিলেন মেজর নূর। ছেলের বন্ধুও ১৫ই আগস্টের রাতে হাত মিলায় খুনি চক্রের সাথে। বঙ্গবন্ধু সিঁড়ির শেষ ধাপে আসতে না আসতেই গর্জে ওঠে নূর-বজলুল হুদার রাইফেল।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর খুনিচক্র মেতে ওঠে রক্তের হোলি খেলায়। দোতলায় তারা হত্যা করে বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, শেখ জামাল, বঙ্গবন্ধুর দুই পুত্রবধু আর তার ভাই শেখ নাসেরকে। পরিবারের সবচেয়ে ছোট ছেলে শেখ রাসেলের বয়স ছিল নয়। বাড়ির নিরাপত্তা রক্ষীদের সাথে তাকে আগেই বন্দি করে খুনিরা। উপরে গুলির শব্দ শুনে মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য আকুতি করে ছোট্ট অবুঝ ছেলেটি। কিন্তু তাকেও বাঁচতে দেয়নি খুনিরা। সেইদিন বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা আর শেখ রেহেনা ছিলেন বিদেশে। আর সে কারণেই বেঁচে যান তারা। এভাবেই ১৫ই আগস্ট কালোরাতে বাঙালি হারিয়েছিল তার প্রিয়নেতাকে, জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের নায়ককে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলায় হাইকোর্টের রায়ে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া ১২ আসামির ৬জনই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিয়ে আছেন। কেউ যুক্তরাষ্ট্র, কেউ কানাডা, পাকিস্তান বা থাইল্যান্ডে। তবে বেশির ভাগ পলাতক শুধু আত্মগোপনে নয়, প্রতিনিয়ত দেশ ও জায়গা পরিবর্তন করছেন। পলাতক অবস্থায় মারা গেছেন বাকি একজন। সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী বিদেশে পলাতক ৭ আসামির মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল আজিজ পাশা জিম্বাবুয়েতে অবস্থান করার সময় মারা গেছেন বলে জানা গেছে।

বাকি ৬ জনের মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা লে. কর্নেল খন্দকার আবদুর রশিদ পাকিস্তানে, লে. কর্নেল নূর চৌধুরী ও লে. কর্নেল শরিফুল হক ডালিম কানাডায় এবং রিসালদার মোসলেমউদ্দিন থাইল্যান্ডে অবস্থান করছে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ধারণা করছে, অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল এম এ রাশেদ চৌধুরী দক্ষিণ আফ্রিকায় এবং অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন আব্দুল মাজেদ কেনিয়ায় অবস্থান করছেন।

স্মরণযোগ্য যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর ওই ঘটনায় মামলা দায়ের করতে লেগেছিল দুই যুগেরও বেশি সময়। বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অবিসংবাদিত এই নেতাকে হত্যা পর ক্ষমতায় বসা ওই সময়কার আওয়ামী লীগ নেতা ও বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ জারী করেন দায়মুক্তি অধ্যাদেশ। আর সেই অধ্যাদেশ বাতিল করতে সময় লাগে ২১ বছর।

১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হলে ওই বছরই নভেম্বর মাসে বাতিল করা হয় এই অধ্যাদেশটি। আর একই বছরের অক্টোবরের ২ তারিখে বঙ্গবন্ধুর আবাসিক ব্যক্তিগত সহকারী আ ফ ম মুহিতুল ইসলাম ধানমন্ডি থানায় এই হত্যাকান্ডের ঘটনায় ২৪ আসামির বিরুদ্ধে মামলা করেন। চার আসামী মারা যাওয়ায় ১৯৯৭ সালের ১২ই মার্চ, ঢাকার দায়রা জজ আদালতে ২০ জনের বিরুদ্ধে ওই মামলার বিচার কাজ শুরু হয় ।

দেড়শ’ কর্ম দিবস শুনানির পর ১৯৯৮ সালে দায়রা জজ গোলাম রসুল ২০ আসামির মধ্যে ১৫ জনের বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেন। ওই রায়ের পর কারাবন্দি চার আসামি অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা মেজর বজলুল হুদা, লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ ও বরখাস্ত লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান হাইকোর্টে আপিল করে।

হাইকোর্টে কয়েকজন বিচারপতি মৃত্যু নিশ্চিত করার এই আপিল শুনতে বিব্রতবোধ করেন। অবশেষে ২০০০ সালের জুনে বিচারপতি মো. রুহুল আমিন ও বিচারপতি মো. এবিএম খায়রুল হকের বেঞ্চে শুনানি শুরু হয়। ৬৩ কর্মদিবস শুনানির পর হাইকোর্ট ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর এ মামলায় বিভক্ত রায় দেয়া হয়। বিচারপতি মো. রুহুল আমিন ১০ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। অপর বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ১৫ আসামির ফাঁসির আদেশ বহাল রাখেন।

২০০১ সালে বিষয়টি নিষ্পত্তি হয় তৃতীয় বিচারপতি মো. ফজলুল করিমের আদালতে। তিনি ১২ আসামির মৃত্যুন্ড বহাল রেখে রায় দেন। চূড়ান্ত রায়ে মৃত্যুদন্ড বহাল থাকা ১২ আসামির মধ্যে পরে ওই বছরই কারাবন্দি চার আসামির আপিল শুনানি শুরুর আবেদন বা লিভ টু আপিল দায়ের করে। ৬ বছর পর ২০০৭ সালে শুরু হয় ওই লিভ টু আপিল শুনানি। ২৫ কর্মদিবস শুনানির পর আসামিদের আপিল শুনানি শুরুর অনুমতি দেন সর্বোচ্চ আদালত।

এরপর প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিচারপতির অভাবে শুনানি শুরু হতে পেরিয়ে যায় আরো ২ বছর। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এলে এই সমস্যার জট খুলে যায়। ২০০৯ সালের ৫ অক্টোবর বিচারপতি তাফাজ্জল ইসলামের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বিভাগে শুনানি শুরু হয়ে চলে ১২ নভেম্বর পর্যন্ত। ১৯ নভেম্বর সর্বোচ্চ আদালত তার রায়ে আসামিদের আপিল খারিজ করে দেয়।  অপরাধের ৩৪ বছর পর ১২ আসামির মধ্যে জেলে থাকা ৫ আসামীর মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়।