যিনি একজন নির্বাচিত জনপ্রতিধি। নির্বাচনে জিতে ইউপি চেয়ারম্যান; পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দলের ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতা। কিছু মানুষের হাতে মার খেয়ে (লোকে বলছে গণপিটুনি) ভর্তি হন হাসপাতালে। স্বাভাবিকভাবেই তার ইউনিয়নে হই হই পড়ে যাবার কথা। কিন্তু বাস্তবতা হলো ইউনিয়নের মানুষ তাকে হাসপাতালে একনজর দেখতে আসা তো দুরের কথা বরং কায়মনবাক্যে প্রার্থনা করেছে তিনি যেন সুস্থ হয়ে আর এলাকায় ফিরে যেতে না পারেন। যদিও সবাই জানে তার আঘাত গুরতর নয়, তবুও চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে কয়েকদিন তারা কিছুটা হলেও স্বস্তিতে থাকবেন বলে মনে করেছে, তার ইউনিয়নের জনগণ, প্রতিবেশী এবং বন্ধুবান্ধব সকলেই।
শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই বাস্তবতা। জনগণের কাছে এমন করুণ ইমেজ গড়ে তোলা এই চেয়ারম্যানের নাম রাসেল চৌধুরী। রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার আমতলী ইউপি’র এই চেয়ারম্যান তার ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের সভাপতিও বটে। কয়েকদিন আগে তারই উপজেলা সদর তথা বাঘাইছড়ি পৌর এলাকায় একটি শালিসে অংশ নিতে গিয়ে প্রতিপক্ষের আক্রমণের শিকার হন তিনি। আহত অবস্থায় প্রথমে বাঘাইছড়ি হাসপাতালে ভর্তি হলেও পরে তিনি সদরের হাসাপাতালে স্থানান্তর আসেন নিজ সিদ্ধান্তে।
তার ইউনিয়নের বাসিন্দা এবং নিজ দলীয় লোকজনের দেওয়া তথ্যমতে, দলের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, দলাদলি, অর্থজালিয়াতি, পরিষদ পরিচালনায় অনিয়ম, দুর্নীতি আত্মসাৎ ছাড়াও, শিক্ষক পেটানো, অন্যের সম্পদ কুক্ষিগত করে নেওয়া, ভয় দেখিয়ে মুখ বন্ধ রাখা, মিথ্যা মামলা দিয়ে এলাকা ছাড়া করা এবং পুলিশের ভয় দেখিয়ে আতংকিত করে তোলা ইত্যকার হেন কোনো অপকর্ম নেই, যা তিনি করেননি। এই বক্তব্য তার পরিষদের অন্যান্য জনপ্রতিনিধি এবং তারই দলীয় লোকজনের পক্ষ থেকে পাওয়া। মাত্র একদশকে একজন ছিচকে মাস্তান থেকে কিভাবে তিনি ডন হয়ে উঠেন তার আদ্যপান্ত সব কিছুই সবার মুখে মুখে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায়না বেঁচে থাকার তাগিদে।
তার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হলেও এলাকার সাধারণ বাসিন্দা থেকে শুরু করে ওই ইউনিয়নের সদস্য এবং দলীয় নেতা-কর্মী সকলেই তার ভয়ে তটস্থ থাকে সারাক্ষণ। বছরের পর বছর তার অত্যাচার নিপীড়ন মুখ বুঝে সহ্য করে গেলেও তার টিকিটিও কেউ ছুঁতে পারেনি।
কারণ ইউপি চেয়ারম্যান হলেও তিনি চলেন ডন স্টাইলে। চেয়ারম্যান হওয়ার আগে থেকেই তার জন্য সব সময় পুলিশি স্কট থাকতো। রাসেল চৌধুরী যা চাইবেন তাই ওই ইউনিয়নে আইন। এমন একটি পরিবেশ তৈরি করেছেন তিনি, তার পোষা রাসেল বাহিনী, পুলিশের সহায়তা এবং জেলা আওয়ামী লীগের উর্দ্ধতন নেতাদের দোহাই দিয়ে।
তিনি বলে থাকেন ‘আমার সাথে দীপংকর দাদা আর বৃষ কেতু দাদা আছেন, তাই অন্য নেতাদের থোড়াই কেয়ার করি আমি’। বাস্তবেও তাই পার্টিতে তার বিরুদ্ধে বার বার অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পায়নি তৃণমূল নেতা কর্মী ও যুগ যুগ ধরে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি করে আসা মুরুব্বী শ্রেণির নেতারা। শেষ পর্যন্ত সম্প্রতি তিনি ছায়া (আশ্রয়স্থল) পরিচয় দেওয়া জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধেও কুৎসা রটনা করে নিজ দলের লোকজনের কাছে কোনঠাসা হয়ে পড়েছেন। পরে তিনি ভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নিয়ে এ যাতা রেহাই পান।
এলাকায় মুখ খোলার সাহস না পেলেও উপায়ান্ত না দেখে শেষ পর্যন্ত মরিয়া হয়েই তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা করেছে এলাকার মানুষ। কিন্তু আইনের ফাঁক ফোকর গলে তিনি বেরিয়ে গেছেন বার বার। কারণ বিজ্ঞ আদালতে মামলার রায় পেতে প্রয়োজন স্বাক্ষ্য প্রমাণ। কিন্তু মামলা করেও যথা সময়ে স্বাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থাপন করতে না পারায় দু’টি মামলা থেকে তিনি ইতোমধ্যেই নিস্কৃতি পেয়ে গেছেন। এর পরও তার বিরুদ্ধে বিজ্ঞ আদালতে একাধিক মামলা চলমান রয়েছে।
তার ইউনিয়নের দলীয় কর্মীরা দলের উর্দ্ধতন নেতার কাছে তার বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য একাধিক অভিযোগ করেছেন। দলীয়ভাবে এ বিষয়গুলো তদন্ত হচ্ছে বলে জানায় বাঘাইছড়ি উপজেলা নেতৃবৃন্দ।
দলীয় তদন্তে নিয়োজিত জেলা আ’লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জমীর উদ্দীনের সাথে এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, শোকাবহ আগষ্ট মাস চলছে। জেলা আওয়ামী লীগ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাত বার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস নিয়ে একমাস ব্যাপী ব্যস্ত সময় পার করছে। যে কারণে জেলা আ’লীগের কার্যকরী সভার বৈঠক না হওয়ায় চেয়ারম্যান রাসেল চৌধুরীর তদন্ত রিপোর্ট নিয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
এদিকে তার ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যরা দাবি করেছেন, রাসেল চেয়ারম্যান মনগড়া ভিজিডি, টি আর, কাবিটা, কাবিখা প্রকল্প বানিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। এমনকি তার কাছে এলাকার কোনো অভিযোগ এলে বিচারের নামে মামলার ভয় দেখিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে তিনি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন বলে জানান তারা।
ওই ইউনিয়নের সদস্যরা গত ০৩ জুলাই বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে জেলা প্রশাসনের কাছে একটি অভিযোগ দায়ের করেন। ওই ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের আব্দুল মালেক, ৫নং ওয়ার্ডের বাবর আলী ৪নং ওয়ার্ডের সহিদুল্লাহ, ৮নং ওয়ার্ডের মো. সুবহান ৯নং ওয়ার্ডের মো. নূর তহিদ ১২৩ নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত মহিলা সদস্য রাবেয়া বেগম, ৪,৫,৬ নং ওয়ার্ডের ছালেহা বেগম ৭,৮,৯ নং ওয়ার্ডের নূর আশা স্বাক্ষরিত জেলা প্রশাসনের কাছে পাঠানো এই অভিযোগ পত্রে জানানো হয়, ২০১৬ সালের ১৬ আগষ্ট থেকে দায়িত্ব পালনকাল থেকে চেয়ারম্যান রাসেল চৌধুরী প্রতিটি ওয়ার্ড ভিত্তিক উন্নয়ন ভিজিডি, টি আর, কাবিখা, কাবিটা প্রকল্প মন মতো করে ইউপি সদস্যদের থেকে জোর করে খালী স্ট্যাাম্পে স্বাক্ষর নিয়ে এসব প্রকল্প দাখিল করে। অভিযোগে বলা হয়, অধিকাংশ ইউপি সদস্যদের সিলমোহর তিনি নিজের আয়ত্বে রাখেন, ফলে তাদের তেমন কিছুই করার থাকে না।
অভিযোগ পত্রে বলা হয়, প্রকল্পের নির্ধারিত ৪০ দিনের কর্মসূচির কাজ না করে নামের তালিকা এবং মজুরীর সকল টাকা অফিস হতে উত্তোলন করে চেয়ারম্যান রাসেল একক ভাবে আত্মসাৎ করে আসছে। সরেজমিনে তদন্ত করা হলে যার প্রমাণ মিলবে। (চলবে…)