॥ আনোয়ার আল হক ॥
একজন অসাধারণ উপস্থাপক, সবার হৃদয় কাড়া একজন সাংবাদিক, একজন দরদি শিক্ষক, পরিশ্রমি ক্রীড়া সংগঠক, স্কাউট আন্দোলনের পুরোধা বা রাঙামাটি স্কাউটের এক পর্যায়ের প্রাণপুরুষ, কলামিস্ট, সমাজ সেবক, ধার্মিক মানুষ কিংবা অমায়িক সুশীল ব্যক্তিত্ব; কি ছিলেন না তিনি ? বন্ধুদের কাছে অতিপ্রিয় একটি নাম, এলাকাবাসীর কাছে নিদানের সাথী, কর্মকর্তাদের কাছে নির্ভরযোগ্য গণমাধ্যম কর্মী, আর রাঙামাটি জেলা ক্রীড় সংস্থার একটি পিলার। গত দুই দশকেরও বেশি সময় তিনি রাঙামাটি জেলা ক্রীড়া সংস্থার বিভিন্ন পদে থেকে দায়িত্ব পালন করেছেন সমান তালে। পোস্ট পজিশন নয়, তিনি প্রাধান্য দিয়েছিলেন দায়িত্বকে এবং ডিএসএর বিভিন্ন ইভেন্টে যে সব উপ-কমিটি মোস্তফা কামালের দায়িত্বে থাকতো সেই কাজ নিয়ে আর ভাবনার কোনো অবকাশ থাকতো না।
আজ মহান বিজয় দিবস; জাতির হৃদয় উৎসারিত একটি স্বর্ণালী দিন। বিজয় দিবস স্বাধীনতা দিবস কিংবা ২ শে ফ্রেব্রুয়ারি এমনি যত জাতীয় দিবস আছে, একটা সময় এমন দিবসগুলোর অনুষ্ঠান মালা মোস্তফা কামাল ছাড়া কল্পনাই করা যেতো না। শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে কিংবা দিবসগুলোর অনুষ্ঠানে যেতে একটু দেরী হলে গিয়ে যদি কানে মোস্তফা কামালের কণ্ঠ ভেসে না আসতো, কোথায় যেন অপূর্ণ অপূর্ণ লাগতো, পরে তিনি স্পীকার হাতে তার স্বভাব সুলভ প্রঞ্জল ভঙ্গিতে ঘোষণা মঞ্চের দায়িত্ব্ নিত মনে হতো এবার বুঝি রাঙামাটির অনুষ্ঠানে বসলাম। সেই মোস্তফা কামালের কণ্ঠ আর ভেসে আসবে না। রাঙামাটি শহীদ মিনার চত্ত্বর, শহীদ শুক্কুর স্টেডিয়াম কিংবা চিংহ্লা মং মারি স্টেডিয়ামের চত্তরে মোস্তফা কামালের কণ্ঠ প্রতিধ্বনিত হবে না। এটা ভাবতেও বিষাদে মনটা ভরে যাচ্ছে। গত দু’বছর যদিও মোস্তফা অনুষ্ঠানাদিতে যাওয়া অনেকটা কমিয়ে দিয়েছিলেন (বন্ধুদের চাপে)। তবে তখন মনে হতো তিনি আবার ফিরে আসবেন তার ভরাট কণ্ঠ নিয়ে, এই মাঠে, এই আঙ্গিনায় কিংবা রাঙামাটির ক্ষুদ্র মিলানয়তনগুলোতে। গত সাত বছর তার জন্য ছিল এক যুদ্ধময় সময়। এই যুদ্ধ যেন মৃত্যুকে পরাস্ত করে বেঁচে থাকার নাম। ক্যানসারকে চোখ রাঙ্গিয়ে বেঁচে থাকা মোস্তফা কামাল দু’দুটি অপারেশনের পরও যখন এতটুকু দমে যাননি তার স্বভাবসুলভ দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেওয়ার সাহসিকতা থেকে। তখন আমরা ধরেই নিয়েছিলাম জীবন সংগ্রামের সাহসী এই সৈনিক- সমাজকে আরো অনেক কিছু দেওয়ার জন্য দ্বিগুণ প্রাণ সঞ্জীবনী নিয়ে ফিরে এসেছেন। মাঝে তিন বছর তার কর্ম চাঞ্চল্য দেখে মনেই হয়নি তার ভিতরে ধীরে ধীরে আরো অন্যান্য রোগ বাসা বাঁধছে।
সাংবাদিকতা জীবনের প্রায় তিন দশক আমরা পাশাপাশি অতিবাহিত করেছি। সুখে- সুখে কাজ করেছি এক সাথে। সেই বাংলার বাণী এবং গিরিদর্পণ দিয়ে কাজ শুরু করা মোস্তফা, বিটিভি প্রতিনিধি হওয়া পর্যন্ত অনেক বাংলা এবং ইংরেজি দৈনিকে কাজ করেছেন। আমার সব সময় মনে হতো (অহংকার করে নয়) আমার মতো করে লিখার যোগ্যতা রাখে যে ক’জন তার মধ্যে মোস্তফা কামাল একজন। কখনও জ্ঞানত মোস্তাফা কামালের সাথে কোনো বিষয় নিয়ে এক মূহুর্তের জন্যও উচ্চ বাচ্য হয়নি। মৃত্যুর মাত্র ২৬ ঘন্টা আগেও (পূর্ব যে রাতে প্রেসার কমে যাওয়ার কারণে তাকে চট্টগ্রামের ম্যাক্স্রের উদ্দেশ্যে যেতে হয় তার মাত্র কয়েক ঘন্টা আগে) একটি জটিল বিষয় নিয়ে তার সাথে কথা হয়। তার বাসায় গিয়েছিলাম এক সহকর্মীসহ। প্রায় ঘন্টা খানেক সময় অতিবাহিত করেছি, প্রিয় বন্ধুর পাশে বসে; ভাবিও ছিলেন পাশে। মোস্তফা ভাই আমাকে দেখেই কেঁদে উঠেছিলেন তার শরীরের প্রচন্ড ব্যথার কথা বলে। একটি বিষয়ে তার সম্মতি চাইলে কোনো দিরুক্তি করেননি। শুধু ভাবি কি বলে জানতে চেয়েছিলেন। ভাবির ইতিবাচক ইঙ্গিত পেয়ে স্বাচ্ছন্দে সম্মতি দিয়েছিলন। অনেক কিছু নিয়ে কথা হলো। কথা বলতে- অনেকটা ইশারা ইঙ্গিতে। সে সময়ও তিনি গলা খুলে কথা বলতে পারছিলেন না। অবস্থা দেখে আমার বার বার মনে হয়েছিল মোস্তফার অবস্থা খুবই শোচনীয়। কিন্তু একবারও মনে হয়নি তার হায়াত মাত্র আর একদিন। তিনি নিজেও হয়তো এমনটা ধারণা করতে পারেননি। কারণ যে সব বিষয় নিয়ে মোস্তফা ভাই আগ্রহ ভরে কথা বলেছিলেন, সে বিষয়গুলো আগামী দিনের কর্ম পরিকল্পনা বিষয়ে এবং তার নিজস্ব পেশাগত বিষয়ে।
শুধু সাংবাদিকতাই একসাথে তাই নয়। ছাত্র জীবনেও আমরা একসাথে অনেক প্রতিযোগীতায় অংশ গ্রহণ করতাম। বয়সে তিনি আমার থেকে বছর তিন চারেকের ছোট হওয়ার কথা। কিন্তু আমরা অনেক প্রতিযোগীতায় কখনও তিনি, কখনও আমি ফার্স্ট সেকেন্ড হতাম। সেটা ৮৬ থেকে ৯০ সময়কালের কথা। আমরা একসাথে বিতর্ক করতাম একজন আর একজনকে হারিয়ে পুরুস্কার ছিনিয়ে নিতাম। কিন্তু পরে সে বিষয়ে কোনো দুরত্ব থাকতো না।
এমন কাছের বন্ধুটি এভাবে অকালে ছেড়ে যাবে মাত্র আট বছর আগেও সেটা ছিল কল্পনাতীত। হায়াত মউত তো আকস্মিক বিষয় এবং আল্লাহ নির্ধারিত। কিন্তু তিনি যখন দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হলেন, তখন সদ্য বাবা হতে যাওয়া একজন যুবক। তার অনাগত সন্তানের কথা ভেবে তখন আমরা দিশেহারার মতো ছুটে বেড়িয়েছি সকল শুভাকাঙ্খীর দুয়ারে দুয়ারে। সচিব থেকে শুরু করে উপসচিব পর্যন্ত যারাই রাঙামাটিতে বিভিন্ন সময়ে দায়িত্ব পালন করে গেছেন, তারা সকলে নির্মল আন্তরিকতা নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন একেবারে মোস্তফার পরম বন্ধুর মতো। সদ্যজাত কন্যা আর স্ত্রীকে হাসাপাতালের বিছানায় রেখে তাকে চলে যেতে হয়েছিল অপারেশনের জন্য। গত আট বছরে কোটি টাকারও বেশী খরচ হয়েছে তার চিকিৎসার জন্য। তার ফেরেস্তাতুল্য সংর্বংসহা বড় শ্যালক তো পাশে ছিলেনই তবে তার সামর্থের বাইরেও টাকার অভাবে মোস্তফার কোনো চিকিৎসা প্রচেষ্টাই সামান্যতম ব্যাহত হয়নি, কখনও। এটা সম্ভব হয়েছে মানুষের দোওয়া ও ভালোবাসায়। তিনি অসুস্থ অবস্থায় রাঙামাটির মসজিদে মসজিদে কত মানুষ চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে দোওয়া করেছেন, তা হয়তো আমরা কখনই ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। এর একটাই কারণ, কোনো সাধারণ মানুষ কোনো বিষয়ে বিপদে পড়ে মোস্তফা কামালের কাছে গিয়ে সমাধান বা সহযোগীতা পাননি এর কোনো নজির নেই। একটি কিশোরের কোনো প্রয়োজনেও তিনি সাথে সাথে ফোন করতেন জেলা প্রশাসক, বা পুলিশ সুপার বা তারও কোনো উর্ধতন কর্মকর্তা বা সামরিক অফিসার কিংবা কলেজের প্রিন্সিপ্যাল, প্রধান শিক্ষক বা জনপ্রতিনিধিদের কাছে।
তিনি অধ্যক্ষ ছিলেন বাচ্চাদের স্কুলের। কিন্তু প্রাইভেট পড়াতেন মাধ্যমিক স্তরের ছেলে মেয়েদের। কোনো ছাত্র পড়ার পর মাসশেষে বেতনের তাগাদা পেয়েছেন এমন নজির নেই। অনেকেই আক্ষরিক অর্থে ফ্রি পড়েছেন। অনেক ছেলে-মেয়ে বছরের পর বছর মোস্তফা কামালের কাছে প্রাইভেট পড়েছেন কোনো দক্ষিনা ছাড়াই। কখনও তাদের বিব্রতও হতে হয়নি, বা এমন আশঙ্কাও মনে উঁকি দেয়নি যে টাকা দিতে না পারায় তার পড়া হবে না। এই উপকার পাওয়া মানুষগুলো আজ নিশ্চয়ই অনেক স্মৃতি মনে করে মোস্তফার জন্য দোওয়া করছেন প্রাণ ভরে, মন উজাড় করে দিয়ে। আমার বিশ্বাস এসব মানুষের দোওয়াই মোস্তফার আখেরাত সহজতর হওয়ার জন্য যথেষ্ট। তিনি ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতেন আমাদের অনেকের চেয়েও কঠোরভাবে। নামাজ-রোজা বা তারাবীর সময় তার উপস্থিতি ছিল সবার জ্ঞাতসারেই। প্রতি শুক্রবারে তিনি নিয়ম করে পাজামা পাঞ্জবী পরতেন; একজন পাঞ্জেগানা মুসুল্লীর চেয়ে দরদ সহকারে। তিন দশকে অসুস্থ সময়টা ছাড়া তার এই নিয়েমের কোনো ব্যত্যয় হতে দেখিনি। তিনি পোষাকে যেমন সৌখিন ছিলেন, তেমনি ছিলেন রুচিশীল।
অকাল প্রয়াণে যাওয়া মোস্তফা কামাল অল্প বয়সেই পার্বত্য তিন জেলা তো বটেই সারাদেশেই কমবেশি পরিচিতি এবং জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। কিন্তু আজ থেকে তিনি স্মৃতিময়। শনিবার দুপুরে তার প্রাণহীন দেহ কবরস্থানের দিকে রওয়ানা হওয়ার পর কারো স্মৃতি বাসা পর্যন্তই থেমে যায়। কেউ শিশু নিকেতন, কেউ বা উন্নয়ন বোর্ডের জানাজা পর্যন্ত সর্বোচ্চ কেউ কবরস্থান পর্যন্ত গিয়ে দু’মুঠো মাটি তার কবরে তুলে দিয়ে এসেছেন। আজকের পরও সূর্য উঠবে, বিটিভির নিউজ প্রচার হবে, শিশু নিকেতনের মাঠ গমগম করবে, প্রেসক্লাবের অনুষ্ঠানাদি চলবে, কিন্তু সেখানে থাকবে না মোস্তফা কামাল। তার জায়গাগুলোও হয়তো অপূর্ণ থাকবে না। কেউ না কেউ চালিয়ে নিবে ওই দায়িত্বগুলো। তবে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় তা হবে না মোস্তফা কামালের মতো করে। সেখানে অপূর্ণতা অপ্রাপ্তি এবং ঘাটতি থাকবেই। তখন হয়তো স্মৃতি কাতর হবে মানুষ। কিন্তু তার কর্ম আজ থেকে স্থবির। স্মৃতি ফিকে হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু। তবে মোস্তফার সকল শুভাকাঙ্খীর কাছে আমার একটাই মিনতি। মোস্তফা অকালে চলে যাওয়ার সময় রেখে গেছে এক জলন্ত স্মৃতি। যে স্মৃতি চলবে, কথা বলবে এবং একদিন মোস্তফার শুভাকাঙ্খীদের দিকে আঙুল তোলার মতো হবে। সে হলো মোস্তফার মেয়ে তোরশা। শনিবার তোরশা মা মনি মন খারাপ করে আমার হাত থেকে আস্তে করে তার হাতটা টেনে নিয়েছিল মায়ের কাছে ছুটে যাবার জন্যে। ফুটফুটে চোখ দুটো দিয়ে ইতিউতি খুঁজছিল কাকে যেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, সে তার বাবাকেই খুঁজছিল। কিন্তু অত মানুষের ভিড়ে হয়তো মুখ ফুটে বলেনি। বাবা হারিয়ে যাওয়ার এই স্মৃতি তার কতটা মনে থাকবে জানি না। কিন্তু সে একদিন ইতিহাস খুঁজবে, মানুষের কাছে বাবার স্মৃতি খুঁজবে আর সমাজের দায়বদ্ধতা এবং দায়িত্বশীলতাকে মূল্যায়ন করবে। সেদিন যেন তার মূল্যায়ন সন্তোষজনক হয়। আমরা এটাই মনে রাখবো সবাই। পর জীবনে ভালো থেকো প্রিয় বন্ধু, জান্নাতের মেহামানদারী তোমার জন্য সুখময় হোক, এই কামনাই করি।