অসচেতনতা ও ড্রেজিংয়ের অভাবে কাপ্তাই হ্রদে দিন দিন মাছ উৎপাদনের হার হ্রাস পাচ্ছে

459

॥ রাঙামাটি রিপোর্ট ॥

দেশে মিঠাপানির মাছের অন্যতম উৎস এশিয়া বিখ্যাত কাপ্তাই হ্রদ ঘিরে মাছ উৎপাদনের যে লক্ষমাত্রা প্রত্যাশা করা হয়েছিল দিন দিন সে সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে। এর জন্য প্রধানত জনগণের অসচেতনতা, দূষণ প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের দুর্বলতা এবং হ্রদের তলদেশ ভরাট হবার পরও ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে পানির গভিরতা না বাড়ানোকেই দায়ী করেছে বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে হ্রদটি পুণঃ খননের মাধ্যমে গভিরতা বাড়ানোসহ দুষণ প্রতিরোধ করা গেলে এই হ্রদ আরো দ্বিগুণ ফলাফল অর্জন করা সম্ভব হবে। তারা জানান এই হ্রদে সময়ের ব্যবধানে কার্পজাতীয় মাছের উৎপাদন কমে যাওয়া ছাড়াও বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে হ্রদ হতে ৬টি প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়েছে বলে গবেষণায় জানা গেছে। আরো কয়েকটি বিরল প্রজাতির মাছ হুমকির মুখে রয়েছে বলেও জানান তারা।

বিশেষজ্ঞরা জানায়, কাপ্তাই হ্রদ কেবল বাংলাদেশেরই প্রধান মাছ উৎপাদন ক্ষেত্র নয়, এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্ববৃহৎ কৃত্রিম জলরাশি। কাপ্তাই হ্রদ সৃষ্টির ফলে মাছ ও বিদ্যুৎ উৎপাদন, নৌ-পরিবহনসহ বিভিন্ন সুবিধা গড়ে উঠেছে। কাপ্তাই হ্রদ জাতীয় সম্পদ। এটিকে রক্ষার জন্য সবাইকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।

কাপ্তাই হ্রদের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ১৬-১৭ অর্থ বছরে কাপ্তাই হ্রদ, পুকুর, ক্রীক, নদীসহ অন্যান্য চাষকৃত জলাশয় থেকে রাঙামাটি জেলায় ১২ হাজার ৬৭ মেট্রিকটন মাছ উৎপাদন হয়েছিল। এর মধ্যে শুধুমাত্র কাপ্তাই হ্রদ থেকে ৮ হাজার ৪২১ মেট্রিক টন মাছ পাওয়া যায়।

সূত্র জানায়, কাপ্তাই হ্রদে খাচায় তেলাপিয়া, পাবদা মাছ চাষের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে খাচায় চাষের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সফল হলে কাপ্তাই হ্রদ থেকে শতকরা ২৫ ভাগ মাছ উৎপাদন সম্ভব হবে। কাপ্তাই হ্রদে উৎপাদিত মাছ যায় সারা দেশে। কিন্তু নানা কারণে হ্রদে মাছের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। হ্রদের নাব্যতা হারানো, অবৈধ উপায়ে মাছ শিকার, মলমূত্র ও বর্জ্যে লেক দূষিত হওয়া এর মূল কারণ। এ তিন বিষয়ে দ্রুত করণীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে হ্রদের পুরনো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব। অন্যথায় পরিস্থিতি আরও আশঙ্কাজনক হয়ে উঠবে।

সূত্রমতে, সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগে রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদে মাছের উৎপাদন আবার বাড়তে শুরু করেছে। ফলে হ্রদ থেকে মাছ আহরণে রাজস্ব আয় বেড়েছে। রাজস্ব আয়ে চলতি বছর অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। তবে প্রাকৃতিক প্রজনন ব্যাহত হওয়ায় এরই মধ্যে হ্রদ থেকে বহু প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বিলুপ্তির পথে আরও বহু প্রাজাতি। বিলুপ্ত প্রজাতির মাছগুলো পুনরুদ্ধারসহ যেসব প্রজাতি বিলুপ্তির পথে সেগুলো রক্ষায় পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কিন্তু কাপ্তাই হ্রদের নাব্যতা ফিরিয়ে আনাসহ হ্রদকে দূষণমুক্ত করা না গেলে এসব পদক্ষেপ সফল বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ উপলক্ষে বুধবার রাঙামাটিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মৎস্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও গবেষকরা এসব তথ্য প্রকাশ করেন।

এ প্রসঙ্গে মৎস্য গবেষণা ইনষ্টিটিউটের উর্দ্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা কাজী বেলাল উদ্দীন বলেন, কাপ্তাই হ্রদে বানিজ্যিক রুই জাতীয় মাছের উৎপাদন ৮১ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে হ্রদে ছোট মাছ শতকরা ৮ শতাংশ থেকে বেড়ে গিয়ে ৯২ শতাংশে পৌছেছে। তিনি আরো বলেন, কাপ্তাই হ্রদে এক সময় ৭৫ প্রজাতির মাছের ছিল। কাচালং চ্যানেলের মাইনিমুখ, বরকল চ্যানেলের জগন্নাথছড়ি, চেঙ্গী চ্য্যানেলের নানিয়ারচর এবং রাইখ্যং চ্যানেলের বিলাইছড়ি এলাকা রয়েছে। ইতোমধ্যে দুটি চ্যানেলের মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র নষ্ট হয়ে গেছে। এর মধ্যে চেঙ্গী চ্যানেলে খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি উপজেলায় রাবার ড্যাম নির্মানের কারণে পানির প্রবাহ আশংকাজনক হারে হ্রাসে পেয়েছে এবং ওই চ্যানেলের বিভিন্ন জায়গায় পানি শুকিয়ে চর জেগে উঠেছে। রাইখ্যং চ্যানেলে পলি জমে চ্যানেলের গভীরতা হ্রাম পেয়েছে এবং কিছু কিছু জায়গায় প্রাক প্রজনন মৌসুমে পানির গভীরতা ২ থেকে ৩ ফুট পর্যন্ত হয়ে যায়। ফলে প্রাক প্রজনন মৌসুমে কার্প জাতীয় মাছ অভিপ্রায়ণ করতে পারে না। এ জন্য হ্রদে রুই জাতীয় মাছ কমে যাচ্ছে।