আজ শুরু হচ্ছে বর্ষ বিদায়ের আনুষ্ঠানিকতা নতুন স্বপ্নের প্রত্যাশায় আসছে নতুন বছর

600

॥ আনোয়ার আল হক ॥

বসন্ত বিদায় নিচ্ছে তার সব রূপ-রঙ নিয়ে। প্রকৃতিতে ধীরে ধীরে বাড়ছে খরতপনের রুদ্রতাপ। এসে গেল আরেক বৈশাখ। মহাকালের রথ তার যাত্রাপথে পেরিয়ে যাচ্ছে বাংলা ১৪২৮ সনের সীমানা। নিয়ত উদয়াস্তের খেলায় সূর্য আজ পূর্ব দিগন্তে লালিমা ছড়িয়ে জানান দিবে দুয়ারে নয়া বছর। আর মাত্র একদিন পরেই ১৪২৮ বঙ্গাব্দ অতীত হবে। আজ মঙ্গলবার ২৯শে চৈত্র; পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ এদিন থেকেই বর্ষ বিদায়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করে। শুরু হচ্ছে সব ঝেড়ে ফেলার দিন, কারণ আজ যে বিজু, আজ সাংগ্রাই, আজ বৈষুক, বিহু, বিষু আর উৎসব। পঞ্জিকার শাসনে মাসের নামটি অপরিবর্তনীয় থাকলেও ধেয়ে আসছে বাংলা নববর্ষ। বিদায় ১৪২৮ বঙ্গাব্দ, খোশ আমদেদ ১৪২৯।

করোনা মহামারির করাল গ্রাসে গত দুইটি বছর পাহাড়ের ঐতিহ্যবাহী বৈসাবি উৎসবের সময় নিতান্তই নিরানন্দে সময় পার করেছে উৎসব প্রিয় নৃগোষ্ঠীর মানুষগুলো। এবার সৃষ্টিকর্তার কৃপায় কেটে গেছে সেই বন্ধাত্ব। এবার তাই উৎসবের আমেজ এক ভিন্ন ব্যঞ্জনা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে পাহাড়ি পল্লী আর শহুরে পাড়াগুলোতে। পুরনো জীর্ণ, হতাশা-ব্যর্থতা, তথা ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনের তাবৎ অমানিশা উতরে সহজাত সুন্দরের প্রয়াস সবার। নতুন দিন, নতুন বছরের সাথে নতুন স্বপ্ন-প্রত্যাশায় জাল বুনছে জাতি। রাজনৈতিক অস্থিরতা কেটে মঙ্গলের বার্তার প্রতীক্ষা সকলের। সকল আঁধার কেটে যাক, আসুক আলো, হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি টুটে যাক বিজু-বৈষুক আর বৈশাখের উৎসব মুখরতায়। গণপ্রার্থনা পেয়েছে কাব্যরূপও- “মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা/ অগ্নি ¯œানে শুচি হোক ধরা।” সত্য-সুন্দরের সম্ভাবনায় শুরু হোক নতুন বছর, নতুন দিন। হাঁস-ফাঁস করা গরমের মধ্যেও পাহাড় জুড়ে চলছে উৎসবের আমেজ, আর বর্ষবরণে বর্ণাঢ্য আয়োজনের ঘনঘটা। আজ ফুল বিজু, এরপর মুল বিজু; যেদিন পাহাড়ের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ঘরে থাকবে সর্বস্তরের জনতার ভিড়। সব নেতাদের বাড়ির আঙ্গিনা থাকবে কানায় কানায় পরিপূর্ণ। আপ্যায়ন হবে সকল পাহাড়ির ঘরেই, পরম মমতায় সাধ্যিক আতিথিয়েতায়। পাহাড়ের দীর্ঘ ঐতিহ্য অনুযায়ী প্রশাসনের কর্মকর্তারাসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ঘুরে ঘুরে সকলের বাসায় গিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় করবেন, গ্রহণ করবেন আতিথিয়েতা।

পহেলা বৈশাখ ঘিরে এবার জেলা প্রশাসনের আয়োজনে থাকছে বর্ণাঢ্য র‌্যালী, পান্তা আসর আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। জেলা প্রশাসন চত্তরে এ আয়োজনে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে সকল শ্রেণির মানুষকে। বাংলা ভাষাভাষী মানুষের জীবনে এলো নতুন বছরের উৎসবের রঙিন দিন। দিনভর সারাটা দেশ মেতে রইবে নাচে-গানে, উৎসবে-আনন্দে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই উৎসবের রঙে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে। এদিন শুধু আনন্দ-উচ্ছ্বাসই নয়, সব মানুষের জন্য কল্যাণ কামনারও দিন। কালের পরিক্রমায় বাংলা ১৪২৪ সালকে বিদায় জানানোর পাশাপাশি নতুনের আবাহনে আনন্দ-উচ্ছাসে মেতে উঠবে জাতি। সুখ-শান্তি-সমৃদ্ধি ও কল্যাণের প্রত্যাশা নিয়েই মহাধুমধামের সঙ্গে বাঙালি উদযাপন করবে নববর্ষ। একে অন্যকে বলবে শুভ নববর্ষ। বাংলা নববর্ষ এখন আমাদের প্রধান জাতীয় উৎসবও। প্রতিবছর এ উৎসব বহু মানুষের অংশগ্রহণে বিপুল থেকে বিপুলতর হয়ে উঠছে। পহেলা বৈশাখ ছাড়া এত বড় সর্বজনীন উৎসবের উপলক্ষ বাঙালির আর নেই। এই উৎসবের মধ্য দিয়ে বাঙালি তার আপন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আলোকে জাতিসত্তার পরিচয়কে নতুন তাৎপর্যে উপলব্ধি করে গৌরববোধ করে। এই গৌরব ও চেতনাই বাঙালিকে প্রেরণা জোগায় আপন অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে।

বাংলা নববর্ষ বাঙালির মনে-প্রাণে নতুন উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। এক সময় খাজনা আদায়সহ রাজকার্যের সুবিধার জন্য মোঘল স¤্রাট আকবর হিজরীর পাশাপাশি বাংলা সাল প্রবর্তন করেন এবং অগ্রহায়ণের পরিবর্তে বৈশাখ থেকে বর্ষ গণনা শুরু করেন। বাংলা মাস পায় রাজকীয় মর্যাদা। এর আগে এই ভূখণ্ডে মহাধুমধামের সাথে ‘নওরোজ’ উৎসব পালিত হতো। বাংলা সালের গণনা শুরু হয় ১৫৫৬ খ্রীস্টীয় সালের ১১ এপ্রিল থেকে। তবে আমাদের দেশে সরকারিভাবে বাংলা সাল-তারিখ ব্যবহার হয় না বললেই চলে। যদিও পহেলা বৈশাখ উদযাপন জাতীয় উৎসবের মর্যাদা পেয়েছে।

পহেলা বৈশাখ; আলোকধারার আশায় বুক বাঁধি সবাই, যে আলোয় দূর হবে সকল কালো। বীকনবাতির মতো আশা দেখি জাতীয় কবিতে। কেননা নববর্ষে কাজী নজরুল ইসলাম সমাজের জঞ্জাল সরাতে ঘোষণা করেছেন নতুনের মহত্তম আহ্বান ‘ঐ নতুনের কেতন ওড়ে… তোরা সব জয়ধ্বনি কর’। রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ বাংলা নববর্ষকে আমন্ত্রণ জানান আরো প্রত্যয় মগ্ন হয়ে গভীর আকুলতায় ‘অগণ্য অসংখ্য বাধা ওড়ায়ে হয় প্রবল কণ্ঠে তুলি পুরুষ হুংকার, হে বৈশাখ এসো…।’ পহেলা বৈশাখ, কেবল জ্যোতির্বিদ্যা নিরূপিত পৃথিবী আহ্নিক গতির ওপর নির্ভরশীল একটি দিন তা নয়। আমাদের জীবনে চেতনা এবং স্বকীয় সংস্কৃতির পরিচয়ও বটে। যদিও অপসংস্কৃতির চর্চার বাড়াবাড়িতে এই দিনটি প্রায় ফসিল হয়ে এসেছে।

বাংলা নববর্ষ বাঙালির মনে-প্রাণে নতুন উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। এক সময় খাজনা আদায়সহ রাজকার্যের সুবিধার জন্য মোঘল স¤্রাট আকবর হিজরীর পাশাপাশি বাংলা সাল প্রবর্তন করেন এবং অগ্রহায়ণের পরিবর্তে বৈশাখ থেকে বর্ষ গণনা শুরু করেন। বাংলা মাস পায় রাজকীয় মর্যাদা। এর আগে এই ভূখণ্ডে মহাধুমধামের সাথে ‘নওরোজ’ উৎসব পালিত হতো। বাংলা সালের গণনা শুরু হয় ১৫৫৬ ঈসায়ী সালের ১১ এপ্রিল থেকে। তবে আমাদের দেশে সরকারিভাবে বাংলা সাল-তারিখ ব্যবহার হয় না বললেই চলে। যদিও পহেলা বৈশাখ উদযাপন জাতীয় উৎসবের মর্যাদা পেয়েছে।