আনারসের রাজধানী খ্যাত নানিয়ারচরে এই ফলের চাষ প্রচুর বেড়েছে

428

॥ গোলাম মোস্তফা ॥

আনারসের রাজধানী খ্যাত রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলার যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই চোখে পড়ে আনারসের বাগান। এাখানকার পাহাড়গুলো সারিবদ্ধভাবে ছেঁয়ে আছে আনারসের বাগানে। আনারস চাষ লাভজনক হওয়ায় দিন দিন বাড়ছে এই পুষ্টিকর ও সুস্বাদু ফলটির চাষ। বাণিজ্যিক ফল হিসেবে দেশের বিভিন্ন বাজারে ফলটির চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আধুনিক চাষ পদ্ধতি ও উন্নত জাতের আনারস চাষ করে অধিক ফলনের পাশাপাশি নায্য মূল্য পাওয়ায় এখানকার আনারস চাষীদের ভাগ্যোন্নয়নে ফলটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। স্থানীয় বাজারে এখন সারাবছরই পাওয়া যাচ্ছে ফলটি। নানিয়ারচরে গত বছরের তুলনায় এবছর উল্লেখযোগ্য হারে আবাদ বেড়েছে। গত বছরের তুলনায় এবছর উৎপাদন বাড়বে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন উপজেলা কৃষি অফিসার মো. ইমতিয়াজ আলম।

কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, নানিয়ারচর উপজেলায় আনারসের আবাদকৃত জমির পরিমাণ গত বছর ছিল ১ হাজার ১’শ ৫০ হেক্টর চলতি বছর আবাদের লক্ষ্যমাত্রা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১হাজার ২ শত ৫০ হেক্টর। গতবছর হেক্টর প্রতি ফলন ৩০ মেট্রিকটন করে সর্বমোট উৎপাদন হয়েছে ৩৪ হাজার ৫০০ মেট্রিকটন। চলতি বছর হেক্টর প্রতি ফলন ধরা হয়েছে ৩২ মেট্রিকটন আর সর্বমোট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪০ হাজার মেট্রিকটন। আধুনিক চাষ পদ্ধতি অবলম্বন করে উন্নত জাতের আনারস চাষ করলে ফলন অনেক বেশি হয় বলে জানিয়েছে সূত্রটি।

আনারস পাহাড়ি অঞ্চলে চাষাবাদের জন্য বেশি উপযোগী। পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন উপজেলায় প্রচুর পরিমাণে আনারসের চাষ হয়। তবে রাঙামাটি জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আনারসের চাষ হয় নানিয়ারচর উপজেলায়। এখানের প্রায় চাষী আনারস চাষের উপর নির্ভরশীল। পুষ্টিমানের দিক দিয়েও আনারসের গুরুত্ব অপরিসীম।

নানিয়ারচরের আনারস চাষী টিক্কা চাকমার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমার ৮ কানি জমিতে এবছর ৯ হাজার আনারসের চাঁরা রোপণ করেছি। আর এই চারা গুলোকে ভালোভাবে পরিচর্যা করছি। ভালো ফলন হলে প্রায় ৯০ হাজার টাকা আয় করতে পারব। তিনি আরো বলেন, আমি নিজ অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই আনারস চাষ শুরু করেছি, কোন সংস্থা বা কৃষি অফিস থেকে সাহায্য সহযোগিতা চাইনি।

এদিকে নানিয়ারচরের আরেকজন আনারস চাষী মোঃ দুলাল বেপারী বলেন, আমি এবছর প্রায় ২ একর জমিতে আনারসের চাষ করছি। আনারস চাষের জমি তৈরি করা থেকে শুরু করে চারা রোপণ এবং বাগান পরিচর্যা করতে আমার ৩-৪ লক্ষ টাকা ব্যায় ধরা হয়েছে। আনারসের ফলন ভালো হলে ও সঠিক ভাবে যদি বাজারজাত করতে পারি এবং নায্যমূল্য পাই তাহলে ৫ থেকে ৭ লক্ষ টাকা আয় করা সম্ভব হবে। তিনি আরো বলেন, কৃষি অফিস বা অন্য কোন সংস্থা থেকে আমরা আনারস চাষীরা কোন ধরনের সাহায্য-সহযোগীতা এপর্যন্ত পাইনি। বর্ষা মৌসুমে আনারস উৎপাদনের সঠিক সময় হওয়ায় আনারস বিক্রিতে আমাদের বিপাকে পড়তে হয়। সরকার বা কোন এনজিও যদি আনারস চাষীদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের দুঃখ লাঘবের জন্য হিমাগারের ব্যবস্থা করে দেয়। তাহলে প্রতিটি আনারস চাষী তাদের ফলনকৃত আনরস নিয়ে আর দুঃচিন্তায় থাকতে হবেনা এবং এখানকার সকল আনারস চাষী উপকৃত হবে।

আনারস চাষ নিয়ে নানিয়ারচর উপজেলা কৃষি অফিসার মোঃ ইমতিয়াজ আলম বলেন, নানিয়ারচর উপজেলা কাপ্তাই লেক বিশিষ্ট একটি পাহাড়ি উপত্যকা। নানিয়াচর উপজেলার অধিকাংশ মানুষের জীবিকার প্রধান উৎস হচ্ছে কৃষি। এখানকার কৃষকরা বেশিরভাগ ফল চাষে নিয়োজিত রয়েছেন। ভূ-প্রকৃতির সাথে মিল রেখে নানিয়ারচরে আনারসের চাষ বেশি হয়ে থাকে এবং বাংলাদেশ ব্যাপি নানিয়ারচর উপজেলার আনারস বিখ্যাত। আনারস চাষের জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কৃষকদের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাবে পরামর্শ দিয়ে আসছে। তিনি আরো বলেন, আনারস চাষে জমি তৈরি করতে অনেক গভীর ভাবে মাটি খোড়া হয় যার ফলে অতিবৃষ্টি হলে পাহাড় ধ্বসের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে কৃষি অফিস মাঠ পর্যায়ের অফিসারদের মাধ্যমে আনারস রোপণের চলমান পদ্ধতি বাদ দিয়ে আড়াআড়ি ভাবে আনারসের চারা রোপণের পরামর্শ দিয়ে আসছে। আনারসের বিকল্প হিসাবে কৃষি অফিস লাভজনক হিসাবে লেবু জাতীয় ফসল চাষের জন্য কৃষকদের পরামর্শ দিয়ে আসছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর লেবু জাতীয় ফসলের সম্প্রসারণ ও সংরক্ষণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে নতুন নতুন কমলা বাগান তৈরি করছে। এছাড়াও পুরাতন বাগান গুলো পরিচর্যার মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করার কাজটিও করা হচ্ছে। কৃষি অফিসের মাধ্যমে চেষ্টা করছে- যাতে আনারস চাষ কমিয়ে লেবু জাতীয় ফসল চাষ বৃদ্ধি করা যায়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে আনারস চাষের জন্য বিশেষ কোন কর্মসূচি বা প্রকল্প না থাকায় আমরা গতানুগতিক ভাবে রোগ, পোকামাকড় থেকে রক্ষার জন্য পরামর্শ দিয়ে আসছি। এখন চাষীরা হরমন ব্যবহার করে সারা বছর আনারস উৎপাদন করছে। তবে যে হরমন ব্যবহার করা হচ্ছে তা সরকার অনুমোদিত কিনা তা আমরা মাঠে গিয়ে প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণ করছি। কৃষি অফিস নিয়মিত আনারসের পাশাপাশি ড্রাগন ফল, লিচু, আম চাষের প্রতি কৃষকদের উদ্ভুদ্ধ করছে। কৃষি বিভাগ থেকে আনারস প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য হর্টিকালচার কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। আনারসের মৌসুমে যেসকল কৃষকরা তাদের উৎপাদিত আনারসের নায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তাদের থেকে আমরা নায্যমূল্যে আনারস ক্রয় করে প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে আনারসের চিপস তৈরি করে বাজারজাত করার ব্যবস্থা করেছি। এছাড়াও নানিয়ারচরের আনারস চাষীদের স্বার্থে আগামীতে আনারসের জুস তৈরির পাশাপাশি ফলটি নিয়ে আমাদের বহুমূখী চিন্তা-ভাবনা আছে।