দশ বছরে লোকসান ৩শ’ কোটি টাকা>>অব্যবস্থানায় কর্ণফুলী কাগজের কল ক্রমেই নির্জীব হয়ে পড়ছে

625

p-1

॥ আনোয়ার আল হক ॥ রাঙামাটিসহ তিন পার্বত্য জেলার গর্ব এশিয়া বিখ্যাত কর্ণফুলী কাগজ কল বিগত দশ বছরে প্রায় ৩শ’ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। চলতি অর্থ বছরে বার্ষিক উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ১৮ হাজার মেট্রিক টন নির্ধারণ করা হলেও লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকও অর্জন সম্ভব হয়নি। ওয়াকিবহাল মহলের বিশ্লেষণে জানা গেছে, তদারকির অভাব, প্রশাসনিক অদূরদর্শিতা, সুষ্ঠু পরিকল্পনা না থাকা, দূর্নীতি, অনিয়ম ও মাথাভারি প্রশাসনের কারণে দেশের বৃহত্তম কাগজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী কাগজ কল (কেপিএম) ক্রমেই নির্জীব হয়ে পড়ছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে কেপিএম যে কোন সময় চিরতরে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। মিলের শ্রমিক-কর্মচারীরা এই বিশ্লেষণের সাথে একমত পোষণ করে বলেছেন আমরা আমাদের রুটিরুজি নিয়ে প্রতিদিন শঙ্কার মাঝে দিনাতিপাত করছি।

কেপিএম সংশ্লিষ্ট নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কর্মকর্তা ও শ্রমিক নেতারা জানান, মিলের উৎপাদনের সহায়ক বিভিন্ন কাঁচামাল সংকটের কারণে উৎপাদন স্বাভাবিক রাখা যাচ্ছে না। প্রতি বছর গড়ে ৭০/৮০ লক্ষ টাকা লোকসান দিচ্ছে মিলটি। সূত্রমতে কর্ণফুলী কাগজ কলে প্রতিবছর ৩৭ লক্ষ মেট্রিক টন কাঁচামালের প্রয়োজন হয়। চলতি অর্থবছরে ৫০ হাজার মেট্রিক টন কাঁচামাল ঘাটতি রয়েছে। প্রতিদিন ১শ’ মেট্রিক টন কাগজ উৎপাদনের সক্ষমতা থাকলেও কাঁচামাল সঙ্কটের কারণে বর্তমানে গড়ে ১০-৩০ মেট্রিক টন কাগজ উৎপাদিত হচ্ছে।

কর্ণফুলী কাগজ কলের কাঁচামাল বাঁশ ও নরম কাঠ (পাল্পউড) কাপ্তাইয়ের রাম পাহাড়, সীতা পাহাড়, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, চিড়িংগা, ঠান্ডাছড়ি, মানিকছড়ি, কাউখালী, কুতুবছড়ি, রাজস্থলী, কাপ্তাই বাঁেধর উপর কাচালং, রাইক্ষ্যং, বাঘাইছড়ি, বরকল, নানিয়াচর, মারিশ্যা, লক্ষীছড়ি, বাঘাইহাটসহ পার্বত্য এলাকার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নদী ও সড়ক পথে কারখানায় সরবরাহ করা হয়। আর্থিক সংকটের কারণে বর্তমানে অধিকাংশ এলাকা থেকে কাঁচামাল সরবরাহ করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন কাঁচামাল সরবরাহকারী ঠিকাদারেরা।

এর কিছুদিন আগে মিলে অনিয়ম ও চেন্ডার আহ্বানে কারচুপির খবর প্রকাশিত হওয়ায় ঠিকাদাররাও এখন মঙ্কিত। এই প্রেক্ষাপটে মিল কর্তৃপক্ষ কাঁচামাল সরবরাহের জন্য একাধিকবার টেন্ডার আহ্বান করলেও ঠিকাদাররা তাতে সাড়া দিচ্ছে না। এতে কাঁচামালের সঙ্কট ব্যাপক আকার ধারন করার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। মিলের সংকটময় মুহূর্তে কারখানা সচল রাখতে কর্তৃপক্ষ বিসিআইসি’র নিকট ২শ’ কোটি টাকা প্রণোদনার জন্য আবেদন করেছে বলে মিল সূত্রে জানা গেছে। এই টাকা পাওয়া গেলে আবার ঘুঁরে দাঁড়ানো সম্ভব বলে জানান মিলের মহা ব্যাবস্থাপক (প্রশাসন) মো. আনোয়ার হোসেন। তবে মিলের পুরোপুরি সক্ষমতা অর্জন করতে আরো বিশাল বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে বলে জানায় সংশ্লিষ্টরা।

প্রসঙ্গত কর্ণফুলী মিলে কাগজ উৎপাদনের মন্ড তৈরীতে মুলত বাঁশ ও নরম কাঠ (পাল্পউড) ব্যবহার হয়। এছাড়াও বিদেশী পাল্প দিয়েও কাগজ উৎপাদন সম্ভব, তবে দেশীয় কাঁচামাল দিয়ে উৎপাদিত কাগজ টেকসই ও মজবুত। কাঁচামাল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান গুলোর মিল কর্তৃপক্ষের কাছে প্রায় ৪০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে বলে জানা গেছে। গত তিন মাসে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে মিল কর্তৃপক্ষ গড়ে দুই শতাংশ করে বিল পরিশোধ করেছে বলে জানা গেছে। যা মূল বিলের তুলনায় খুবই নগণ্য। তা দিয়ে ঠিকাদারেরা শ্রমিকদেরকে নতুন করে কাজে নিয়োগ করতে পারছেনা। আর্থিক সংকটের কারণে মিলের শ্রমিক-কর্মচারীরা ২ মাস বেতন পায়নি এবং ৫ মাসের ওভার টাইম বকেয়া রয়েছে। এ অবস্থায় মেহনতি শ্রমিক কর্মচারী ও অস্থায়ী শ্রমিকরা বেতনভাতা না পেয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর দিনযাপন করছে।

কাগজ উৎপাদনের অন্যান্য কাঁচামাল লবণ, চুন, ট্যালকম পাউডার, সোডা, কস্টিক, এলাম সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মিলের কাছে প্রায় ৫০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। এছাড়া কর্ণফুলী গ্যাস ডিষ্ট্রিবিউশন কোম্পানির প্রায় ৫০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। সব মিলিয়ে মিলটি কোটি কোটি টাকা দেনার ভারে ভারাক্রান্ত। অথচ মিল এলাকায় ৫ হাজার পরিবার অবৈধ ভাবে বসবাস করে মিলের গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ অপচয় করছে। সম্প্রতি ৪০ পরিবারকে উচ্ছেদ করা হলেও সিংহভাগ অবৈধ বসতি উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা অদৃশ্য কারণে বন্ধ রয়েছে। বেসরকারী হিসাব মতে, মিল এলাকায় বসবাসকারীরা মিল থেকে প্রতিবছর প্রায় ৫০ কোটি টাকার গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি ব্যবহার করে মিলকে লোকসানের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এ অপচয় রোধ করা গেলে মিল আর্থিকভাবে লাভবান হবে।

মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী খান জাভেদ আনোয়ার মিলে চলতি অর্থবছরের শুরুতে যোগদান করার পর কয়েকদিনের মধ্যে দৈনিক ৭০/৭৫ মেট্রিক টন কাগজ উৎপাদিত হয়। কিন্তু পরে গাফিলতি, অনিয়ম, দূর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনাহীনতার কারণে একমাসের মাথায় কাঁচামাল সংকটের কারনে মিলটি বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে নামমাত্র উৎপাদনে মিলটি চালু রয়েছে। কাঁচামাল সরবরাহকারীদের পাওনা মিল কর্তৃপক্ষ যথাসময়ে পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় তাদের মধ্যে চরম আর্থিক সংকট ও অসন্তোষ বিরাজ করছে। মিলের কূপ এলাকায় কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হলেও যথাসময়ে বিলের অর্থছাড় না হওয়ায় অধিকাংশ ঠিকাদার পথে বসার উপক্রম হয়েছে। অর্থ সংকটের কারণে ব্যবসার ধারাবাহিকতা ব্যাহত হলে ঠিকাদারদের মুলধন ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। কর্ণফুলী কাগজ কলের উৎপাদনের স্বার্থে ঠিকাদারেরা ধারকর্জ করে মিলে কাঁচামাল সরবরাহ করে আসছে। তাই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পাওনাদি ফেরত পেতে মিল কর্তৃপক্ষের নিকট জোর দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু মিল কর্তৃপক্ষ ঠিকাদারদের সময়মত বিল পরিশোধ না করায় তারা চরম হতাশায় দিনাতিপাত করছেন। ঠিকাদারেরা জানান, পার্বত্য এলাকায় প্রায় ৩ লক্ষাধিক মানুষ বাঁশ, কাঠ কর্তন আহরণ এবং সরবরাহের মাধ্যমে কর্ণফুলী কাগজ কলের সাথে জড়িত রয়েছে। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানগুলো চরম অর্থ সংকটের কারণে মিলে বাঁশ ও কাঠ সরবরাহ করতে হিমশিম খাচ্ছে। ওদিকে ঠিকাদাররা যথাসময়ে টাকা দিতে না পারায় শ্রমিকরাও বেকার হয়ে পড়েছে। গত একবছর যাবত পাহাড়ে কেপিএমের কাজকর্ম স্থবির হয়ে পড়ায় কর্মরত শ্রমিকরা মানবেতর জীবন যাপন করছেন।  কারখানাটি প্রতিবছর সরকারকে ৫শ কোটি টাকা রাজস্ব দিয়ে থাকে। তাই দেশ ও জাতির স্বার্থে কাগজ কলটিকে রক্ষা করতে সরকারের নিকট মেহনতি শ্রমিকরা জোর দাবী জানান।

অপরদিকে, ২০১২-২০১৬ অর্থবছরে অবসরে যাওয়া ২শ শ্রমিকের মিলের কাছে প্রায় ১৫ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। তাদের পাওনা টাকা পাওয়ার দাবিতে গত তিন মাস ধরে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন চালিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে পাওনাদার কয়েকজন শ্রমিক মৃত্যুবরণ করেছেন। এ ব্যপারে একাধিকবার মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী খান জাভেদ আনোয়ারের সাথে যোগাযোগ করা হলেও তার সাড়া মেলেনি।