১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১, ঢাকা ব্যুরো অফিস, দৈনিক রাঙামাটি।
ঢাকার মোহাম্মাদপুর থানার ২/২ লালমাটিয়া নিবাসি নার্গিস বেগমের শেষ লড়াইটা তার গর্ভজাতক সন্তানদের সাথে। তার দুই সন্তান তানভীর আহমেদ সোহেল ও নেয়না আহমেদ শান্তার জননী নার্গিসের লড়াইটা শুরু হয় ২০০৪ সালে স্বামী লুৎফল আহমেদ টিলু মারা যাবার পর থেকে। প্রথমে পারিবারিক যন্ত্রণা ও ষড়যন্ত্রের মধ্যে শিশু সন্তানদের নিয়ে স্বমীর ভিটায় টিকে থাকার লড়াই। দ্বিতীয় লড়াইটা হয় তার স্বামীর কাছ থেকে ভাড়াটিয়াদের পজেশন কেনার মামলার লড়াই। তৃতীয় লড়াইটা হয় ছেলে তানভীর আহমেদ সোহেল স্কুল জীবনে মাদকের ছোবলে বখে যাবার পর থেকে। এ তিনটি লড়াইয়ে তিনি হেড়ে যান। এখন শেষ লড়াইটা চলছে সন্তান তানভীর আহমেদ সোহেল ও মেয়ে নেয়না আহমেদ শান্তার সাথে স্বামীর সম্পত্তিতে নিজের প্রাপ্ত ৮/১ অংশ বুঝে নেয়ার জন্য। দেখা যাক এ লড়াইয়ে তিনি জিতবেন না হেড়ে যাবেন ?
জানা গেছে, নার্গিস বেগমের মেয়ে নেয়নার সাথে গত ৯ মাস আগে মা ও সন্তানদের মঝে বাড়ির ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে পাওয়া ভাড়া নিয়ে দ্ব›দ্ব হয়। এ সময় মেয়ে নেয়না বাড়ির সিসি ক্যামেরা ভেঙ্গে সবার মাঝে আতংক ছড়িয়ে এক ভাড়াটিয়াকে উকিল নোটিস দিয়ে তার মাকে ভাড়া দিতে নিষেধ করেন। এর পর তানভীর, নেয়না তাদের মা নার্গিস বেগমকে বাসা থেকে বের করে দেয়। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, মাদক ব্যবসার গোমড় ফাঁস হয়ে যাবার ভয়ে মূলত: তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়। গত ৯ মাস ধরে নার্গিস বেগমকে অসহায় হয়ে নিজের বাড়ি ছেড়ে এবাড়ি ওবাড়িতে থাকতে হচ্ছে যাযাবরের মত। এমনকি জীবন নাশের হুমকিতে নিজের বাড়িতে অন্যের পজেশন ভাড়া নিয়ে গড়ে তোলা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বারবার ক্লাবেও (ভিআইপি সেলুন) থাকতে পারছেন না তিনি। এ বিষয়ে মোহাম্মাদপুর থানায় তিনটি জিডি করেও নার্গিস বেগম কোনো সুরাহা পাননি। মোহাম্মাদপুর থানার জিডি নং ৭২৮ তারিখ ১০/৩/২০২১, জিডি নং ৬৯৬ তারিখ ১০/৮/২০২১, জিডি নং ৩০, তারিখ ১/৯/২০২১,
মোহাম্মাদপুর থানায় ১০ মার্চ ২০২১ তারিখে নার্গিস বেগমের ৭২৮ নং জিডির সূত্রে জানাযায়, তার মেয়ে নেয়না আহমেদ শান্তা অন্যের প্ররোচনায় অস্বাভাবিক আচরণ করে তার মা’সহ বাড়ির ভাড়াটিয়াদের ভীতিসহ নিরাপত্তাহীনতায় মধ্যে ফেলে দেয়। তার মেয়ে নেয়না এবছর ১৮ জানুয়ারি থেকে ২৭ জানুয়ারি মধ্যে বাড়ির সব সিসি ক্যমেরাগুলো ভেঙ্গে ফেলে। এ ছাড়াও সে তার মাকে লাগাতার গাল-মন্ধ করাসহ অসৌজন্যমূলক আচরণ করে আসছে। ৮ মার্চ রাত আনুমানিক ৯টার দিকে ছেলে তানভীর আহমেদ ফোনে তার হাত কেটে ফেলার হুমকি দেয়। এরপর ১০ আগস্ট ৬৯৬ নং জিডিতে তিনি পূর্বের জিডির কথা ইল্লেখ করে থানা কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেন যে, গত ৭ মাস যাবত তিনি বাসায় থাকতে পারছেন না। ১৯ জুলাই ২০২১, রাত ১০টার দিকে মেয়ে নায়না ও তার স্বামী খান মো. সারোয়ার জাহান, সারোয়ারের ছোট ভাই দিপুসহ বেশ কয়েকজন লোক নিয়ে নার্গিস বেগমের দোকানে (ভিআইপি সেলুন বারবার ক্লাব) এসে তাকে মেরে মাটির সাথে মিশে ফেলার হুমকি দেয়। এসময় সারোয়ার জাহান তার দোকানের কাজের ছেলে এমদাদুল(১০)কে মারধর করে বের করে দেয়। ১ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখের ৩০ নং জিডিতে বলা হয়, এবছর জানুয়ারি মাস থেকে নার্গিস বেগমের ছেলে ও মেয়ে বিভিন্ন সময় তার উপর অত্যাচার করে আসছে। তাদের অত্যাচারে ১৮ জানুয়ারি থেকে তিনি বাসায় থাকতে পারছেন না। ১৮ আগস্ট ভারাটিয়াদের সাথে বৈঠক করে তার স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পত্তিতে প্রাপ্ত ৮/১ অংশ হতে তাকে বঞ্চিত করার ঘোষণা দেয় ছেলে তানভীর আহমেদ সোহেল। তার পরের দিন রাতে দোকান থেকে বের হয়ে খাবার আনতে গেলে অজ্ঞায়াত দুই ব্যক্তি তাকে বাড়ির আশপাশে দেখলে মেরে ফেলা হবে বলে হুমকি দেয়।
সিসি ক্যামেরার ফুটেজে নির্যাতনের উদ্দেশ্যে বাড়িতে তানভীর-নেয়নার আতংক ছড়ানো এবং তানভীরের বাসায় মাদক সেবনের পূর্ব প্রস্তুতির প্রমান পাওয়া গেছে। একটি সূত্র জানিয়েছে, ২০১৪ সাল থেকে নার্গিসের গৃহকর্মী জেনেভাক্যাম্প নিবাসি মঈনুদ্দিন তানভীরের মাদক ব্যবসার মূল যোগানদাতা। আর সরবারহকারী হিসেবে রয়েছেন তানভীর আহমেদ সোহেলের বাসার চিলে কোঠায় বসবাসকারী নামধারী ভড়াটিয়া উবার (হোন্ডা) চালক জামিরুল ইসলাম জামিল। মোহাম্মদপুর থানায় জামিলের নামে আর্থিক প্রতারণার অভিযোগ রয়েছে।
নার্গিস বেগমের ছেলে তানভীর আহমেদ সোহেল ২০০৬ সাল থেকেই মাদক সেবন, মাদক ব্যবসা ও নারী কেলেংকারীর সাথে জড়িত রয়েছেন। ওই বছর তানভীর তার সাবেক স্ত্রী জুবায়দা আহমেদ সপ্নাকে নিয়ে তাদের ২/২ লালমাটিয়ার বাড়ির ছাদের ভাড়াটিয়াকে বিদায় করে সেখানেই নিয়মিত মদ ও নারীর আসর বসাত। ২০১২ সালের ২৮ ডিসেম্বর তার অপকর্মে বাধা দিলে নার্গিসের সাথে তানভীরের স্ত্রী সপ্না ও তার বন্ধু-বান্ধবীদের দ্ব›দ্ব বাধে। এসময় বাড়ির ভাড়াটিয়া ও আশপাশের লোকজন জড়ো হলে তারা পিছু হটে। এর পর নার্গিস তার বাসার ছাদে তালাবদ্ধ করে রাখেন। এক বছর ছেলে ও ছেলের বউয়ের নির্যাতন সহ্য করার পর অদৌর্য হয়ে ২০১৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর থানা পুলিশের সহযোগিতায় তানভীর আহমেদ সোহেলকে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করে চিকিৎসা দেয়া হয়। ২০১৪ সালের ৬ জানুয়ারি, সহকারী পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদপুর জোন-এর দপ্তর থেকে নার্গিস বেগমকে প্রেরিত এক চিঠির জবাবে এ তথ্য জানা গেছে। এছাড়াও পরে আরো তিন বার তানভীরকে লক্ষাধীক টাকা ব্যয় করে ঢাকার বিভিন্ন মাদক নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করে চিকিৎসা দেয়া হয় বলে তানভীরের মা নার্গিস বেগম জানিয়েছেন।
২০০৬ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত তানভীর আহমেদ সোহেলের নামে ঢাকার বিভিন্ন থানায় মাদক সেবন, মাদক সরবারহ, অস্ত্র উদ্ধার ও নারী নির্যাতনের চারটি মামলা চলমান রয়েছে। মামলা নং ২৪/৬৯৪, তারিখ ০৮/ ১০/ ২০০৬ থানা মোহাম্মদপুর, ঢাকা। মামলা নং ২৮/৮৩, তারিখ ২৭,০৩, ২০১৪ থানা শাহ আলী, ঢাকা। মামলা নং ৪২/৩৪৯, তারিখ ১৯/১০/২০১৪ থানা মোহাম্মদপুর, ঢাকা। মামলা নং ০৮/৪১৯, তারিখ ০৮/০৮/ ২০১৫ মোহাম্মদপুর থানা।
সাম্প্রতিক সময়ে লালমাটিয়ার এ বাড়িটিতে মাদকের আড্ডা বেড়ে যায়। তাই নার্গিস বেগম সিসি ক্যামেরায় আড়ি পাততে শুরু করেন। বিষয়টি মাদক সরবরহকারী, গৃহকর্মী মঈনুদ্দিনের জন্য শূভকর নয় বিধায় সে তানভীরের কাছে বিষয়টি জানিয়ে দেন। এতে মায়ের প্রতি ক্ষীপ্ত হয়ে আত্মরক্ষার্থে তানভীর সকলকে ভুল বুঝিয়ে তার বোন শান্তাকে দিয়ে সিসি ক্যামেরা ভেঙ্গে তার মাকে বাড়ি থেকে বেড় করে দেয়। সন্দেহ করা হচ্ছে, উল্লেখিতরা ছাড়াও তানভীরের সাথে সম্পর্কিত এই বাড়ির আরো অনেকে মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত আছেন। যে কারনে অন্যায় ভাবে মাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার পরেও তার পক্ষে কেউ কথা বলছে না। সিসি ক্যামেরায় আড়ি পাতার ক্ষেত্রে নার্গিস বেগম প্রথমে মঈনুদ্দিনের সহযোগিতা নেন। মঈন বর্তমানে তানভীরের সাথে থেকে বাড়ির কেয়ারটেকারের দায়িত্বে রয়েছেন।
মেয়ে নেয়না আহমেদ শান্তা সাবালেগ হবার পর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যান বলে জানিয়েছেন তার মা নার্গিস বেগম। এক পর্যায় মেয়ে নিজের পছন্দে খান মো. সারোয়ার জাহানকে বিয়ে করেন। বিয়ের পরে কখনো তিনি শশুর বাড়িতে থাকেননি। নার্গিস বেগমও মেয়ের শশুর বাড়ির বিষয় কিছুই যানেন না। নি:সন্তান শান্তা সারোয়ার জাহানের দ্বিতীয় স্ত্রী বলে জানা গেছে।
পরিশেষে বলা প্রয়োজন, প্রাপ্যতা আইনে কারো কাছে স্থাবর-অস্থাবর কোনো সম্পত্তি না থাকলেও পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন এবং পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ ও সুরক্ষায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ নির্দেশনা থাকা সত্তে¡ও বারবার থানায় জিডি করে, থানায় গিয়ে পুলিশের কাছে কান্নাকাটি করে, এমনকি আত্বীয় স্বজনদের কাছে শত অনুনয় বিনয়ন করেও কোনো প্রতিকার পাননি নার্গিস বেগম। আশা করি মোহাম্মাদপুর থানা কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লীষ্ট সকলে নার্গিস বেগমের ক্ষেত্রে ন্যায়বিচারের প্রতি নজর দিবেন।
শামীমুল আহসান
ঢাকা ব্যুরো প্রধান- দৈনিক, রাঙামাটি