পবিত্র শবে মিরাজের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

513

মাওলানা ক্বারী মুহাম্মদ ওসমান গনী চৌধুরী
নবুয়তের একাদশ বছরের ২৭ রজব রাত্রে রাহমাতুল্লীল আলামীন হযরত মুহাম্মদ (দঃ) এর জীবনে অতি বিশ্ময়কর দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ আলোকিত অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত হয়, তারই নাম হল মিরাজ।
লাইলাতুন বা শব অর্থ রাত্রি আর মিরাজ অর্থ উর্ধ্ব আরোহন করার সিঁড়ি। এখানে মিরাজ শব্দ দ্বারা উর্ধ্বে আরোহন বুঝানো হয়েছে। এই রাত্রে বিশ^নবী হযরত মুহাম্মদ (দঃ) পৃথিবী থেকে উর্ধ্বে আরোহন করে মহান রাব্বুল আলামীনের খাস দরবারে উপস্থিত হয়েছিলেন বলে এই রাতকে লাইলাতুল মিরাজ বলা হয়।

মহান রাব্বুল আলামীন মহাগ্রন্থ পবিত্র আল কোরআনে সুরা বনি ইসরাইলে ঘোষণা করেন অর্থাৎ “পবিত্র ও মহিমাময় তিনি, যিনি তারঁ বান্দাকে রাতে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন, যার পরিবেশ আমি বরকতময় করেছিলাম তাঁকে আমার নিদর্শনসমুহ দেখানোর জন্য। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্ঠা।”
জীবনে প্রতিটি সময়, প্রতিটি মুহুর্থ কষ্টে জর্জরিত পরীক্ষার পর অগ্নি পরীক্ষা হাসোজ্জল মনে বরণ করে

নবুয়তের এগারোতম বৎসরে পদার্পন শিআবে আবি তালিবের অসহ্য যন্ত্রণা মহান আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করে মহান আল্লাহ তায়ালার প্রশংসায় পঞ্চমূখ হয়ে মস্তক সিজদায় অবনত হয়ে প্রশান্তির নিঃস্বাস ত্যাগ করেন। এমন সময়ে মহান রাব্বুল আলামীন প্রিয় বন্ধু বিশ^নবী হযরত মুহাম্মদ (দঃ) এর অবস্থা অবলোকন করে শবে মিরাজ নামক মহালৌকিক ঘটনা হযরত জিব্রাইল (আঃ) এর মাধ্যমে স্বশরীরে সম্পাদন করেন। যা পৃথিবীর ইতিহাসে মহান আল্লাহ অন্য কোন নবী-রাসুলকে দান করে নাই। যা শুধু হযরত মুহাম্মদ (দঃ) কে দান করে সর্বশ্রেষ্ঠ আসনে সমাসীন করেছেন।

সংক্ষেপে মিরাজের ঘটনা ঃ রাসুল (দঃ) এক রাতে হজরত উম্মেহানি (রা.)-এর ঘরে বিশ্রামে ছিলেন। তার অর্ধনিদ্রা অবস্থায় জিবরাইল (আ.) অন্যান্য ফেরেশতাসহ ওই ঘরে অবতরণ করেন এবং তাকে মসজিদে হারামে নিয়ে যান। জিবরাইল ও মিকাইল (আ.) রাসুল (দঃ) কে জমজমের পাশে নিয়ে বক্ষ বিদীর্ণ করেন এবং ‘কলব’ বের করে জমজমের পানি দিয়ে ধুয়ে ইলম ও হিকমতে পরিপূর্ণ স্বর্ণের পাত্রে রেখে আবার বক্ষে স্থাপন করেন। এরপর তার দুই কাঁধের মাঝে নবুয়তের সিলমোহর স্থাপন করেন। এরপর তারা বুরাক নামক বাহনে করে নবী (দঃ) কে মসজিদে আকসা পর্যন্ত নিয়ে যান। পথিমধ্যে মহানবী (দঃ) মদিনা তায়্যিবা, মুসা (আ.)-এর কথা বলার স্থান সিনাই পর্বত এবং ঈসা (আ.)-এর জন্মস্থান বেথেলহেমে অবতরণ করেন। ওই স্থানগুলোতে তিনি দুই রাকাত করে নামাজও আদায় করেন।

বায়তুল মুকাদ্দাসে অতঃপর বায়তুল মুকাদ্দাসে প্রবেশ করে সেখানে দুই রাকাত তাহিয়্যাতুল মসজিদ নামাজ পড়েন। তারপর মসজিদ থেকে বের হলে জিবরাইল (আ.) তার সামনে এক পাত্র শরাব ও এক পাত্র দুধ নিয়ে আসেন। রাসুল (দঃ) দুধের পাত্রটি গ্রহণ করেন। তখন জিবরাইল (আ.) বললেন, আপনি ফিতরাত (স্বভাবজাত ও প্রকৃত জিনিস) গ্রহণ করেছেন।

অন্য বর্ণনায় এসেছে, বায়তুল মামুরেও রাসুল (দঃ) এর সামনে ওই দুটি পাত্রসহ একটি মধুর পাত্রও আনা হয়েছিল। সেখানেও তিনি দুধের পাত্রটি গ্রহণ করেন।

ধারাবাহিকভাবে আসমান অতিক্রম ঃ অতঃপর জিবরাইল (আ.) নবীজি (দঃ) কে প্রথম আসমানের কাছে গিয়ে দরজা খোলার আবেদন জানান। ফেরেশতারা অভিবাদন জানিয়ে রাসুল (দঃ) কে বরণ করে নেন। এভাবে সপ্তম আসমান অতিক্রম করেন। এ সময় যথাক্রমে প্রথম আসমানে হজরত আদম (আ.), দ্বিতীয় আসমানে হজরত ইয়াহইয়া (আ.) ও হজরত ঈসা (আ.), তৃতীয় আসমানে হজরত ইউসুফ (আ.), চতুর্থ আসমানে হজরত ইদরিস (আ.), পঞ্চম আসমানে হজরত হারুন (আ.), ষষ্ঠ আসমানে হজরত মুসা এবং সপ্তম আসমানে হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। সবাই হুজুর (দঃ) কে অভ্যর্থনা জানান। সপ্তম আসমানে বায়তুল মামুরের কাছে ইবরাহিম (আ.) প্রাচীরের সঙ্গে হেলান দিয়ে উপবিষ্ট ছিলেন।

বায়তুল মামুর, জিবরাইল (আ.) ও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ঃ বায়তুল মামুরে দৈনিক ৭০ হাজার ফেরেশতা প্রবেশ করেন। কিয়ামত পর্যন্ত তাদের পুনর্বার প্রবেশ করার পালা আসবে না। সপ্তম আসমান থেকে রফরফের (সবুজ রঙের গদিবিশিষ্ট পালকি) মাধ্যমে সিদরাতুল মুনতাহায় গমন করেন, যেখানে আল্লাহ তাআলার নির্দেশে স্বর্ণের ও বিভিন্ন রঙের প্রজাপতি ছোটাছুটি করছিল। ফেরেশতারা স্থানটি ঘিরে রেখেছিলেন। সেখানে রাসুল (দঃ) জিবরাইল (আ.)-কে তার স্বরূপে দেখেন, তার ছয় শ পাখা ছিল। নিজ চোখে জান্নাত-জাহান্নাম দেখেন। অতঃপর এক ময়দানে পৌঁছেন, যেখানে ভাগ্যলিপি লেখার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। পরিশেষে আরশে আজিমে গমন করেন। এরপর আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে উপঢৌকনস্বরূপ ৫০ ওয়াক্ত নামাজের বিধান নিয়ে জমিনে প্রত্যাবর্তন করেন। পথিমধ্যে মুসা (আ.)-এর পরামর্শক্রমে কয়েকবার আল্লাহর কাছে গিয়ে নামাজের সংখ্যা কমানোর আবেদন জানান। অবশেষে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের (যাতে ৫০ ওয়াক্তের সাওয়াব পাওয়া যাবে) বিধান নিয়ে বায়তুল মুকাদ্দাসে ফিরে আসেন।

ঊর্ধ্বজগতে যেসব নবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল, তারাও বিদায় সংবর্ধনা জানানোর জন্য তার সঙ্গে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত আগমন করেন। তখন নামাজের সময় হয়ে যায়। জিবরাইল (আ.)-এর ইঙ্গিতে নবীজি (দঃ) কে ইমাম বানানো হয়। তিনি নবীদের সঙ্গে নামাজ আদায় করেন। এরপর বুরাকে সাওয়ার হয়ে অন্ধকার থাকতেই মক্কা মুকাররমায় পৌঁছে যান।

মিরাজের গুরুত্ব ও তাৎপর্য ঃ মিরাজ বিশ^নবী হযরত মুহাম্মদ (দঃ) এর জীবনে যেমন মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এক মহা অলৌকিক নেয়ামত, তেমনি বিশ^নবী হযরত মুহাম্মদ (দঃ) এর সেরা উম্মত হিসেবে মহান আল্লাহর পক্ষ হতে আমাদের নিকট এক মহা মূল্যমান উপটৌকন যা ইসলামের ইতিহাসে অবিস্মরনীয় হয়ে থাকবে।

লেখক: সভাপতি, জাতীয় ইমাম সমিতি, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা।