প্রসঙ্গ- লংগদু হামলা: দৈনিক প্রথম আলোর লেখক সমাজের প্রতি অনুরোধ- পাহাড়ের উপজাতি ও বাঙালি উভয় জনগোষ্ঠির জন্য সহমর্মি হবেন

464

 

মনিরুজ্জামান মনির- ১১ জুলাই ২০১৭, দৈনিক রাঙামাটি:  “তদন্ত বিচার ও পুনর্বাসনঃ আদৌ হবে কি? লংগদু হামলা শিরোনামে প্রথম আলো ১১ জুলাই ২০১৭ সংখ্যায় মতামত পাতায় (১০) এক ঝাঁক বাঘা বাঘা লেখকের তিন কলামের লেখাটি পড়ে বিস্মিত ও মর্মাহত হয়েছি। প্রবীন রাজনীতিক খ্যাত পঙ্কজ ভট্টাচার্য, মেসবাহ কামাল, সঞ্জীব দ্রং, দীপায়ন খীসা, সন্তোষিত চাকমা, গজেন্দ্রনাথ মাহাতো, পল্লব চাকমা ও রোবায়েত ফেরদৌস-এই ৮ জনের যৌথ প্রবন্ধ এটি।

৭/৮ জনের যৌথ লেখা এর আগেও একাধিকার প্রথম আলোতে বিভিন্ন বিষয়ে ছাপা হয়েছিল। পাহাড়ের বাঙালি বিদ্বেষী সা¤প্রদায়িক উগ্র সশস্ত্র সংগঠন জনসংহতি সমিতি ও ইউপিডিএফএর এর মতামতের প্রতিধ্বনী শুনতে পাই ঐসব লেখায়। অর্থাৎ তিন পার্বত্য জেলায় যারা সশস্ত্র বন্দুকযুদ্ধে লিপ্ত, যারা খুন, চাঁদাবাজি লুটপাট ও অসামাজিক কাজে ব্যস্ত, যারা অল্পায়াসে অধিক ধন পেতে অভ্যস্ত, যারা নিজেদেরকে বাঙালি কিংবা বাংলাদেশী হিসেবে স্বীকার করে না, যারা বলে তারা জুম্ম জাতি, পার্বত্য চট্টগ্রামকে যারা স্বাধীন জুমল্যান্ড বানাতে আগ্রহী, যারা জুম্ম জাতির জনক ! বলে (বঙ্গবন্ধুকে জাতির জনক অস্বীকারপূর্বক) এম.এন লারমাকে যাদের শ্লোগান হ’ল- “ঘরে ঘরে দুর্গ গড়, জুমল্যান্ড কায়েমকর” যারা বলে “কাটো কাটো বাঙালি কাটো” যারা জুম্মকন্ঠ, জুম্ম নিউজ বুলেটিন, রাডার, স্যাটেলাইট, কর্ণফুলীর কান্নাসহ অনেকগুলো প্রচার মাধ্যমে বাংলাদেশের অখন্ডতা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিরোধী অপপ্রচারে লিপ্ত, যাদের লেখনীতে পাহাড়ে কর্মরত আমাদের বীর সেনাবাহিনীকে বলা  হয়- “দখলদার, বাংলাদেশী সামরিক জান্তা, জলপাই স্বৈরাচার ! ও টিম্বার জেনারেল। যারা পার্বত্যবাসী বাঙালিদেরকে মানুষ হিসেবেই স্বীকার করে না, তাদেরকে বলে মুসলিম অনুপ্রবেশকারী? রিফুজী, সেটেলার, বর্হিরাগত কিংবা ভূমি দখলকারী হলো বাঙালিদের নাম পরিচয়।

মূলতঃ প্রথম আলোতে ঐসব ৮ লেখকের ভাষ্যে সেসব কথাই ঘুরে ফিরে প্রকাশিত হয়েছে। অথচ এসব লেখকেরা একটিবারও বাঙালিদের নূনতম মানবাধিকার তথা দেশের এক ও অবিচ্ছেদ্য অংশ পার্বত্য চট্টগ্রামের জুমল্যান্ড চক্রান্ত নিয়ে একটি শব্দও উচ্চারণ করেন নাই। কিন্তু, কেন।

পাহাড়ের তরুণ বাঙালি মটর সাইকেল চালক ও যাত্রী পরিবহনকারী যুবলীগ নেতা নয়ন হত্যাসহ শতাধিক ঘটনার শিকার হয়েছেন বাঙালিরা। এক ঢিলে দুই পাখি মারা। অর্থাৎ সন্তুু বাবুদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দ্বৈত লাভের উদ্দেশ্যেই এসব হত্যাকান্ড করা হয়। খোদ লংগদুতে শতাধিক বাঙালি কাঠুরিয়াকে হাত-পা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে টুকরো টুকরো করে পাকুয়াখালীর পাহাড় ও অরন্যের গভীর তলদেশে হত্যা করে ফেলে দেয়া হয়েছিল। সেসময় ও ঐসব লেখকেরা বলেছিলেন- “ওগুলো সব গুজব, মিথ্যা কথা, সাজানো-নিরীহ জুম্মদেরকে হয়রানী করার জন্যই মহলবিশেষের কারসাজিতে এসব হচ্ছে (?)। ওরা এই লংগদুতেই বীর মুক্তিযোদ্ধা ও উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুর রশিদ সরকারকে স্টেনগানের ব্রাশফায়ার করে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল ১৯৮৯ সালে। সেই ঘাতক তথাকথিত শান্তিবাহিনীর নবরূপীভূত হল জেএসএস ও ইউপিডিএফ নামধারী উপজাতীয় ক্যাডার বাহিনী। নিরীহ, সরলপ্রাণ (?) জুম্ম জাতির প্রতিনিধিত্ব ও নেতৃত্ব মূলত তাদেরই হাতে।

নিউটনের সূত্রমতে- “প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীত মুখী প্রতিক্রিয়া আছে”। অর্থাৎ লংগদু উপজেলা পরিষদ মাঠে ৬০জন বাঙালির একটি গণকবর দেখলেই বুঝা যাবে জুম্ম জাতির যুবকেরা কী না পারে? ওদের সুদর্শন উজ্জল চেহারার ভিতরে লুক্কায়িত থাকে জলজান্ত হিংস্র খুনী হায়নার ছায়া! লংগদুতে শত শত বাঙালির রক্তে রঞ্জিত বহু গণকবর ও হত্যা কান্ডের স্বাক্ষী হয়েও অভূক্ত অর্ধভূক্ত হাড্ডিসার বাঙালি প্রজন্ম আজো সেখানকার মাটি আকড়ে ধরে আছে। তরুন যুবক যুবলীগ নেতা নয়নের কি অপরাধ ছিল? তাকে হত্যা না করলে কি হতো না? ওরপ্রিয় মোটর সাইকেলটি নিয়ে গিয়েও তো ওর প্রাণভিক্ষা দেয়া যেত! কিন্তু খুনী রনেল চাকমা ও জুনেল চাকমা সেই সুযোগও দেয়নি। নয়নের বিধবা স্ত্রী এই অকালে সন্তানসহ কোথায় যাবেন? কে দেবে তাদের আশ্রয়? জীব হত্যা মহাপাপ, অহিংসা পরম ধর্মের বনভান্তে সাধুবাবারা এক্ষেত্রে নীরব কেন? পার্বত্যবাসী বাঙালিরা কি মানুষ বা জীব নয়?

প্রথম আলোতে ৮ লেখকের লেখনীতে একবারও পাহাড়ের ভূমি ধসে ২০০ নিহত, বহু আহত ও গৃহহারা ক্ষতিগ্রস্থ জনগনের পুনর্বাসনের দাবী আসেনি। পাহাড়কে জুম চাষ করে আগুন লাগিয়ে, গাছ-পালা-বন-বনানী-পরিবেশ ধ্বংস করার জন্য কারা দায়ী? যারা জুম চাষ করে তাদেরকে বিকল্প পদ্ধতিতে পুনর্বাসনের কথাও আসেনি। কারা বাঙালিদের হাজার হাজার একর চাষ করা আনারস বাগান, আম বাগান, কাঠাল বাগান, সেগুন বাগান, চা বাগান ইত্যাদি কোটি কোটি টাকার সম্পদ রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে, অগ্নিসংযোগ করে ও কেটে কেটে ধ্বংস করে দিয়েছে। তাদের বিচারের কথাও আসেনাই কেন ? ঐ ৮ লেখক কি অন্ধ ? তাদের কি চোখ নেই ?

লংগদু উপজেলায় নয়ন হত্যাকান্ডসহ সকল বাঙালি হত্যাকান্ড যেরূপ নিন্দনীয় ও বিচারযোগ্য, তদ্রুপ উপজাতীয় বাড়ীঘরে কথিত অগ্নি সংযোগের ঘটনাও নিন্দনীয়। আইন সকলের জন্যই সমান। অতীতে অনেকগুলো বাঙালি হত্যাকান্ড হয়েছে, তারও কোন বিচার হয় নাই। বরং খুনীরা ক্ষমা পেয়েছে এবং জুম্ম জাতির কাছে পুনর্বাসিত হয়েছে। সরকারকে উপজেলা চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা রশিদ সরকার হত্যাকান্ড সহ লংগদুতে সকল হত্যাকান্ডে বিচার করতে হবে এবং বাঙালি উপজাতিসহ ক্ষতিগ্রস্থ সবাইকে সমানভাবে পুনর্বাসন করতে হবে। এটি মানবিক বিষয়, এখানে সন্তু বাবুর রাজনীতি অচল।

প্রথম আলোতে লেখা ৮ জনের দাবীর সাথে আমরাও বলতে চাই- পুনর্বাসনের প্রশ্নে বাঙালি জাতি ও জুম্ম জাতি বলে কোন বিভেদ ও বৈষম্য সৃষ্টি করা চলবে না। শুধু লংগদুতেই নয়, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, সিলেট, মৌলভীবাজার, ছাতক, নেত্রকোনাসহ পাহাড়ধ্বস, ভূমিধ্বস, প্রাকৃতিক ধ্বংসলীলায় ক্ষতিগ্রস্থ সকল বাংলাদেশী জনগনের ত্রান ও পুনর্বাসনের জন্য জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ত্রান না গ্রহনের জন্য কোন উপজাতি নর-নারীকে চাপ দেওয়া যাবে না। সরকার সীমিত সামর্থের মধ্যেও যতটুকু সম্ভব সাহার্য্য দিচ্ছে তা গ্রহণ না করাটা একধরনের ধৃষ্টতা, এটি রাষ্ট্রীয় সাংবিধানিক অবকাঠামোকে অশ্রদ্ধার শামীল। নিরিহ সাধারণ উপজাতিদেরকে ত্রাণ গ্রহণের জন্য জেএসএস ও ইউপিডিএফ ক্যাডারদের সহায়তা করা উচিত। পাহাড়ে যুবলীগ নেতা নয়নসহ ৩৫০০০ হাজার বাঙালির খুনীদেরকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। লংগদুতে পাইকারী হারে বাঙালিদের গণগ্রেপ্তার ও দোষারফ করা চলবে না। কারণ- কেউই ধোয় তুলসীপাতা নয়। এক হাতে তালি বাজে না।

অবশেষে দৈনিক প্রথম আলোর ৮ লেখককে এই সত্য অনুধাবনের আহ্বান জানাই। সেই সাথে অনুরোধ করবো- পাহাড়ের উপজাতি ও বাঙালি উভয় জনগোষ্ঠির জন্য সহমর্মি হবেন এবং উপজাতিও বাঙালি উভয় স¤প্রদায়ের মধ্যে যারা গণবিরোধী কাজে লিপ্ত উভয়কেই অতি সত্তর সংশোধন হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য জাতি অপেক্ষা করছে।

লেখক: মনিরুজ্জামান মনির- রাঙামাটি জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার এবং
পার্বত্য চট্টগ্রাম সমঅধিকার আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব ও কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক

পোস্ট করেন- শামীমুল আহসান, ঢাকা ব্যুরো প্রধান ।