ঘনঘোর শ্রাবণের ভরাবর্ষায় উন্মাতাল কলতানে মুখরিত হয়ে উঠেছে আলীকদম উপজেলার অসংখ্য ঝর্ণা ও জলপ্রপাত। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- দামতুয়া ঝর্ণা, ওয়াংপা ঝর্ণা, রূপমুহুরী ঝর্ণা ও নুনার ঝিরি ঝর্ণা।
শুধু এসব ঝর্ণা রাণীই নয় একই সাথে উচ্ছ্বল কলরবে লাফিয়ে চলছে ‘দামতুয়া জলপ্রপাত’ ও তামাংঝিরি জলপ্রপাতের স্বচ্ছ পানির ধরা। এসব ঝর্ণা ও জলপ্রপাতের হিমশীতল জলে সিক্ত হতে প্রতিনিয়ত আসছে দেশের নানা প্রান্ত থেকে ভ্রমণপিপাসু পর্যটক।
সম্প্রতি আলীকদম উপজেলার ৯ তরুন-যুবকের অনুসন্ধানে পাওয়া ‘ওয়াংপা ঝর্ণা’ এবং ‘দামতুয়া ঝর্ণা ও জলপ্রপাত’কে ঘিরে আজকের আয়োজন।
বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার সবুজাভ পাহাড়ের কন্দরে লুকিয়ে আছে অসংখ্য গিরিনির্ঝর। এরমধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে পর্যটকদের নজর পড়েছে ‘ওয়াংপা ঝর্ণা’, ‘দামতুয়া ঝর্ণা ও জলপ্রপাত’ এর ওপর। প্রকৃতির অপরূপ নিদর্শন এ ঝর্ণা ও জলপ্রপাতের উপচেপড়া ভরা যৌবন দেখার মোক্ষম সময় এই শ্রাবণেই।
বর্ষা শুরু হলে ঝর্ণা ও জলপ্রপাতগুলোতে যেন টিকরে পড়ে যৌবন স্রোত। সবুজ পাহাড়ের অন্তর্বিহীন নিস্তব্ধতায় ঝর্ণা রাণীরা যেন আছল বিছিয়ে দেয় পর্যটকদের অভ্যার্থনা জানাতে! তাই সবুজের টানে প্রাণের উচ্ছ্বাসে দেশের নানাপ্রান্ত থেকে প্রতিনিয়ত এসব দেখতে ছুটে আসছেন পর্যটকরা।
আলীকদম-থানচি সড়কের ১৭ কিলোমিটার পয়েন্টের আদু মুরুং পাড়া থেকে ৬/৭ কিলোমিটার দুরে দামতুয়া ঝর্ণা ও জলপ্রপাতের অবস্থান। ১৭ কিলোমিটার পথ জীপ অথবা মোটর বাইকে যাওয়ার পর বাকি পথ যেতে হয় পায়ে হেঁটে। পর্যটকদের সাম্প্রতিক নজরে আসা ‘ওয়াংপা ঝর্ণা’ এবং ‘দামতুয়া ঝর্ণা ও জলপ্রপাত’ প্রকৃতির একটি বিস্ময়। এ ঝর্ণা ও জলপ্রপাতের আকার আকৃতি ও গঠনশৈলী মনোমুগ্ধকর।
পার্বত্যাঞ্চলের অন্যান্য নান্দনিক ঝর্ণার দিক দিয়ে নিঃসন্দেহে এসব অন্যতম। তবে সবচেয়ে মনোহর লাগে দামতুয়া ঝর্ণার কয়েকশ’ গজ উপরে দামতুয়া জলপ্রপাত। এ জলপ্রপাতের পাথুরে মাটির ধাপগুলো আরো বিস্ময়কর। যেন সুদক্ষ রাজমিস্ত্রির নিপুন হাতে সৃষ্ট কোন আল্পনা! ‘দামতুয়া জলপ্রপাত’ এর অনেকগুলো বিচ্ছিন্ন ধাপ প্রমাণ করে যে এটি প্রকৃতির খেয়ালে গড়া অসাধারণ একটি স্থাপত্যশৈলী।
অপরদিকে, ‘দামতুয়া ঝর্ণা’য় দু’দিকের খাড়া পাহাড়ি দেয়াল বেয়ে কলকল, ঝম্ঝম রবে সুরের অনুরনণ তুলে উন্মাতাল স্রোত গড়িয়ে পড়ছে নিচের গভীর জলাশয়ে। পাহাড়ের নিস্তব্ধতা যেন সেখানে ম্লান। উঁচু থেকে পড়া পানির কিছু অংশ আবার জলীয় বাষ্প হয়ে বাতাসে মিশে সেখানে এক ধোঁয়াশাপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। এ যেন পাহাড়ের গভীরে মেঘমালা!
‘দামতুয়া ঝর্ণা’য় নামতে হলে খাড়া পাহাড়ের কিছুটা পথ ডিঙ্গিয়ে নীচে নামতে হয়। তবে দামতুয়া জলপ্রপাতে নামার পথ পাথুরে মাটি। সেখানে নামতে তেমন সমস্যা হয় না। ঝর্ণা ও জলপ্রাপাতের নীচে মাঝারী ধরণের জলাশয় আছে। এ জলশায়ে সাঁতার কাটতে ও গোসল করতে বেশ ভালো লাগে।
‘দামতুয়া ঝর্ণা ও জলপ্রপাতে’ পৌঁছার অন্তত একঘন্টা আগে দেখা মিলবে ‘ওয়াংপা ঝর্ণা’। মূল ‘ওয়াংপা ঝর্ণা’ দেখতে হলে খাড়া পাহাড় বেয়ে নীচে নামতে হবে। চলাচল পথের মাঝে অসংখ্য ছোট বড় পাথরের ভাজে শীতল জল যেন জানান দেয় ওয়াংপা ঝর্ণা জলস্রোত কেমন হবে। ওপর থেকে ‘ওয়াংপা ঝর্ণা’র পানি গড়িয়ে পড়ার দৃশ্য আরো মনোহর লাগে।
প্রকৃতির নান্দনিক তুলিতে আঁকা সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হচ্ছে ভ্রমণপিয়াসী মানুষ। রাতে যদিও সেখানে অবস্থান করা নিরাপদ নয়। তবে তাবু খাটিয়ে অবস্থান করলে বুঝা যাবে রাতের বেলায় চাঁদের আলোয় ঝর্ণার অপরূপ সৌন্দর্য ও কলতান।
প্রকৃতির অপরূপ সৃষ্টি ওয়াংপা ঝর্ণা, দামতুয়া ঝর্ণা ও জলপ্রপাত। যেখানে প্রকৃতি খেলা করে আপন মনে। রুমুঝুম্ ঝুম্ ঝুম্ শব্দে বয়ে চলা ঝর্ণাধারায় গা ভিজিয়ে মানুষ যান্ত্রিক জীবনের অবসাদ থেকে নিজেকে ধুয়ে সজীব করে তুলতে পারে এর হিমশীতল জলে।
ধারণা করা হচ্ছে শতবর্ষ পূর্ব হতেই প্রবাহিত রয়েছে এসব ঝর্ণা ও জলপ্রপাত। এতদিন সড়ক যোগাযোগ না থাকা, বিচ্ছিন্ন পাহাড়ি জনপদ হওয়ায় তা ছিল লোকচক্ষুর অন্তরালে। ফলে তা অনাবিস্কৃতই থেকে যায়।
উদ্যমী তরুন-যুবকরা পাহাড়ের কন্দরে লুকিয়ে থাকা এসব ঝর্ণা রাণী ও জলপ্রপাতকে খুঁজে খুঁজে বের করে আনছে। ফলে পাল্টে যাচ্ছে আলীকদম উপজেলার পর্যটন পরিবেশ। নতুত্বের ছোঁয়া লাগছে পর্যটনখাতে। সরকারি আনুকুল্য পেলে এসব পর্যটন স্পট হয়ে উঠবে পর্যটকবান্ধব।
কিভাবে যাবেন : চট্টগ্রাম কিংবা কক্সবাজার থেকে বাস করে চকরিয়া বাস স্টেশন নামতে হবে। চকরিয়া থেকে বাসে করে আলীকদম বাসস্টেশন নামবেন। সেখান থেকে জীপ গাড়ি ভাড়া নেওয়া যায়।
অথবা বাস স্টেশন থেকে অটো রিক্সায় পানবাজার এসে ভাড়ায় চালিত মোটর বাইক নিয়ে আলীকদম-থানচি সড়কের ১৭ কিলোমিটারের আদু মুরুং পাড়ায় নামবেন। সেখান থেকে স্থানীয় মুরুং গাইড নিয়ে উত্তর দিকে এক ঘন্টা হাঁটলেই পেয়ে যাবেন ‘ওয়াংপা ঝর্ণা’র ওপরের অংশ। ওখান থেকে আপনাকে ‘দামতুয়া জলপ্রপাত ও ঝর্ণা’য় যেতে আরো অন্তত একঘন্টা হাঁটতে হবে।
পথে যেতে যেতে ৩টি স্থানে দেখা মিলবে পাহাড়ের ঢালে সবুজের বুকে ১০/১২টি করে টংঘর। এসব স্থানীয় নৃ-জনগোষ্ঠী মুরুং পাড়া। ভয় নেই। এখানকার মুরুংরা অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ। তারা পর্যটক দেখলে প্রাণখোলা হাসি দেয়। অসংখ্য ঝিরি ও জঙ্গল মাড়িয়ে দেখা মিলবে দামতুয়া জলপ্রপাত। আরো কিছুদুর গেলে দেখা যাবে দামতুয়া ঝর্ণা!
থাকার জায়গা : আলীকদমে গত কয়েকবছর ধরে পর্যটক থাকার স্থানের বড়ই আকাল চলছে। পার্বত্য জেলা পরিষদ নিয়ন্ত্রিত একমাত্র রেস্টহাউজটি বর্তমানে বিজিবি’র কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সুতরাং পর্যটকরা স্থানীয় সেনাবাহিনীকে জ্ঞাত করে পাহাড়ি পরিবেশে মুরুং পাড়ায় থাকতে পারেন।
মনে রাখবেন: চিপসের প্যাকেট, সিগারেটের ফিল্টার, পানির বোতলসহ অন্যান্য আবর্জনা যেখানে সেখানে ফেলবেন না। পাহাড়ের ঝর্ণা ও জলপ্রপাতসমুহ দেশের মানুষের সম্পদ। অপচনশীল এসব আবর্জনা ফেললে পরিবেশ নষ্ট হয়। পথে জোঁক থাকতে পারে, তাই সতর্ক থাকবেন।
লবণ সঙ্গে রাখলে ভালো হয়। জোঁক কামড়ালে লবণ ছিটিয়ে দিলে কাজ হয়। সিগারেটের তামাকও ব্যবহার করা যায়। ঝর্ণায় যাওয়ার রাস্তা অতি দুর্গম। যাঁরা পাহাড়ি পরিবেশে হাঁটতে পারেন না তারা সেখানে না গেলেই ভালো। শিশু, বয়স্ক বা অপ্রাপ্তবয়স্কদের সেখানে না নেওয়ায় সঙ্গত। হাঁটতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটলে দুর্গম পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে ফিরে আসা দুরহ। কাজেই পাহাড়ে হাঁটার অভিজ্ঞতা না থাকলে সেখানে না যাওয়ার সিদ্ধান্তই ভালো।