মানিকছড়িতে অযত্নে অবহেলায় ক্ষয়ে যাচ্ছে মুন্সী আব্দুর রউফের স্মৃতি ম্যুরাল

416


॥ মঈন উদ্দীন বাপ্পী ॥
অনাদর অবহেলায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বীর শ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের স্মৃতি মুরালটি। রাঙামাটি শহরে প্রবেশের মুখেই নির্মিত এই স্মৃতি মুরাল যেমন দেশের সব মানুষের জন্য কাঙ্খীত একটি মুরাল তেমনি রাঙামাটিবাসীর জন্যও গর্ব ও অহংকারের বিষয়টি।

কিন্তু পর্যটন শহরের সৌন্দয্য বৃদ্ধি করা এবং ৭১ এর বীর শহীদের স্মতিচিহ্ন হিসেবে নির্মাণ করা ‘আরক্ষি’ নামের এই ভাস্কর্য সকলের আবেগের অনেকখানি জুড়ে অবস্থান করলেও দুঃখজনকভাবে তার সংরক্ষণ রক্ষণাবেক্ষণ বা দেখভাল করার যেন কেউ নেই।

নির্মাণের পর অনেকদিন পেরিয়ে গেলেও সেখানে কোনো সংস্কার কাজও হয়নি। এতে ছেলে ছোকরারা এখন এটাকে খেলার বস্তুতে পরিণত করেছে। আর দুরন্ত কিশোরের কৌতহলি থাবায় দিনে দিনে ক্ষয়ে যাচ্ছে এর সকল সৌন্দর্য।

ল্যান্স নায়েক মুন্সী আব্দুর রউফ দেশের সাত বীর শ্রেষ্ঠের মধ্যে অন্যতম। ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের এই বীর সেনানী অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কোম্পানীর হয়ে যুদ্ধ করার সময় ৮এপ্রিল রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলার বুড়ি ঘাটে অবস্থান নেয়, যাতে করে রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির মহালছড়ি জলপথে পাকিস্তানী সৈনিকরা প্রবেশ করতে না পারে।ওইদিন এ বীর সেনানীর সাথে পাকিস্থানী হানাদার বাহিনীর তীব্র লড়াইয়ে দেশের এ বীর সন্তান শহীদ হোন।

নতুন প্রজন্মের চিন্তা চেতনায় বীরের পরিচয় তুলেধরাসহ এই বীর সেনানির প্রতি সম্মান দেখিয়েই ২০০৮ সালে রাঙামাটি শহরের প্রবেশ মুখ মানিক ছড়িতে দেশের এই বীর শ্রেষ্ঠের মুর‌্যালটি নির্মাণ করা হয়। এই মুর‌্যাল ঘিরে ইজড় নামে একটি পর্যটন স্পটও গড়ে উঠে। নির্মাণের পর এই পর্যটন স্পট যেমন আগত পর্যটকদের রাঙামাটিতে প্রবেশে উৎসাহিত করেছে।

তেমনি সে সময় রাঙামাটি শহর থেকেও লোকজন বৈকালিক সময় কাটানোর জন্য এখানে যাওয়া আসা করেছে পরম মমতায়। সেখানে নিরিবিলি সময় পার করে একটু স্বস্তি পাওয়ার চেষ্টা করেছে। যতদুর তথ্য পাওয়া গেছে, সে সময় সেনা বাহিনীর উদ্যোগেই এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়।

কিন্তু গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর বীর শ্রেষ্ঠের এ ম্যুরালটি রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যেমন কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। তেমনি যারা এটি নির্মাণ করেছিলেন তারাও ম্যুরালটি সংরক্ষণের বা সংস্কারের কোনো প্রকল্প নেননি। এখন এই প্রকল্প অনেকটা অভিভাবকহীন। এতে দীর্ঘ আট বছর ধরে ম্যুরালটি অযত্নে অবহেলায় বর্তমানে ধ্বংস হওয়ার পথে। প্রতিনিয়িত অবমাননা করা হচ্ছে বীর শ্রেষ্ঠের এ ভাস্কর্যটিকে।
যিনি এ দেশকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষার জন্য নিজের জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন এবং দেশ মাতৃকার জন্য শহীদ হয়েছেন তাঁর ম্যুরালটির এই বেহাল দশা হয়তো অনেককেই ভাবায়, কিন্তু এগিয়ে আসছেন না কেউই।

সরেজমিনে গেলে ওই এলাকায় যাতায়াত আছে এমন লোকজন জানান, স্থানীয় টোকাই এবং ভাঙ্গারী ব্যবসায়ীরা ম্যুরালটির বিভিন্ন অংশ চুরি করে খুলে নিয়ে যাচ্ছে। ম্যুরালটির উপর জুতো পায়ে মানুষেরা উঠে ছবি তোলে, আড্ডা দেওয়াসহ আশাপাশের পরিবেশটি নোংরা করে তোলেছে। একই প্রকল্পাধীন আরও তিন বীর সেনানীর ম্যুরালগুলোও একইভাবে বেহাল দশায় পতিত।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাঙামাটি জেলা পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা এসএম জাকির হোসেন বলেন, প্রকল্পটির সাথে জেলা পরিষদের প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা না থাকায় কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

তিনি জেলার উন্নয়নের জন্য রাঙামাটি জেলা পরিষদ বটে। কিন্তু বর্তমান পরিকল্পনায় মুন্সী আব্দুর রউফের ভাস্কর্যটি রক্ষণা-বেক্ষণ কিংবা সংস্কারের বিষয়টি আসেনি।তিনি জানান, ভবিষ্যতে বিষয়টি চিন্তা করা হবে।

বিদগ্ধ মহলের মতে, মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে, ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে, মা-বোনের সঙ্গম হারানোর মাধ্যমে আমরা স্বাধীন দেশ পেয়েছি। আর এ স্বাধীন দেশে যদি বীর সেনানীরা এবং বীর সেনানিদের প্রতীক বা ভাস্কর্য অবমাননার স্বীকার হয় তাহলে অন্তরে আঘাত লাগে, আমরা ব্যথিত হই। তারা এ ব্যাপারে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, অবিলম্বে এ বীর সেনানীর ভাস্কর্যটি রক্ষণা বেক্ষণ অতীব জরুরী।

স্থানীয়রা জানায় ভাস্কর্য মেরামত করে এখানে পর্যটন স্পটটি চালু করা গেলে একদিকে যেমন মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি আরো মূর্ত হবে, তেমনি নতুন প্রজন্মরা এ বীর সেনানির ভাস্কর্যটিকে দেখে দেশে প্রেমে উদ্বুদ্ধ হবে। একে কেন্দ্র করে পর্যটন শিল্পের বিকাশেরও প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে বলে মত প্রকাশ করেন তারা।