রাঙামাটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটে দুর্নীতির পাহাড়:

354

স্টাফরিপোর্ট- ২৫ জুন ২০১৮, দৈনিক রাঙামাটি:  রাঙামাটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক রুনেল চাকমার বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ উঠেছে। খোদ প্রতিষ্ঠানটির দেখভাল করার দায়িত্বে নিয়োজিত রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য সান্তনা চাকমা এই অভিযোগ তুলেছেন। এ কারণে প্রতিষ্ঠানটির বর্তমানে বেহাল দশা বলে জানিয়েছেন একাধিক কর্মকর্তাও। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন রুনেল চাকমা।

বিভিন্ন অনিয়মের প্রতিকার পেতে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ পাঠিয়েছেন সান্তনা চাকমা। অভিযোগে বলা হয়, জবাবদিহিতা না থাকায় রাঙামাটি ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিিিটউটের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক রুনেল চাকমা নিজের ক্ষমতা অপব্যবহার করে সরকারের বরাদ্দকৃত লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করে চলেছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে ওই প্রতিষ্ঠানে গবেষণা ও প্রকাশনা শাখায় ১ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা ব্যয় দেখানো হলেও কোনো প্রকাশনা বের করা হয়নি। জাদুঘর ও লাইব্রেরী শাখায় ২ লক্ষ ১০ হাজার টাকা ব্যয় দেখানো হলেও সেখানে দৃশ্যমান কোন কাজ হয়নি। প্রশাসন ও অর্থ শাখায় ব্যয় দেখানো হয়েছে ৫ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা।

এরমধ্যে রয়েছে, রেজিট্রেশন ফি ১২ হাজার টাকা, পেট্রোল-লুব্রিকেন্ট ৭০ হাজার টাকা, স্টেশনারি, সিল, ও স্ট্যাম্পস বাবদ ৪৫ হাজার টাকা, প্রচার ও বিজ্ঞাপনে ১৫ হাজার টাকা, ইউনিফর্ম বাবদ ২৫ হাজার টাকা। এছাড়া, অধিকাল ভাতা ৩০ হাজার টাকা, কমিটি মিটিং-কমিশন ১৫ হাজার টাকা, বৃক্ষরোপন ও সংরক্ষণে ৫০ হাজার টাকা, বিবিধ কনটিনজেন্সি ব্যয় ৫০ হাজার টাকা, পুর্ত ও সংরক্ষণ ২ লক্ষ টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে।

অন্যদিকে সংস্কৃতি শাখায় ব্যয় দেখানো হয়েছে ১২ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা। এরমধ্যে রয়েছে, ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠীর নৃত্য-গীত ও চিত্রাঙ্কন প্রশিক্ষণে ২ লক্ষ ১০ হাজার টাকা, জেলা পর্যায়ে বার্ষিক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা, ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠীর স্বল্পমেয়াদী নৃত্য- গীত প্রশিক্ষণে ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা। এছাড়া, মহান বিজয় দিবস উদযাপনে ২৫ হাজার টাকা, মহান শহীদ দিবস ও আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনে ২৫ হাজার টাকা, মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উদযাপনে ২৫ হাজার টাকা, জাতীয় শিশু দিবস উদযাপনে ২৫ হাজার টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। আর বিজু মেলায় ২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা, রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে ৫০ হাজার টাকা, ভিআইপি অতিথি ও বিভিন্ন দিবস উদযাপনে ৫০ হাজার টাকা, জেলার বাইরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা, নৃত্যের পোশাক ও সরঞ্জাম ক্রয়ে ৪০ হাজার টাকা, সঙ্গীত ও বাদ্যযন্ত্রাদি ক্রয় ও মেরামতে ৩০ হাজার টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে।

সাংস্কৃতিক চর্চা, প্রসার ও উন্নয়ন সংরক্ষণ শীর্ষক কর্মসুচির আওতায় জেলার কাউখালী উপজেলার জন্য ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেখিয়ে আত্মসাৎ করা হয়েছে। এছাড়া ২০১৬ সালে ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের উন্মুক্ত মঞ্চ সম্প্রসারণের জন্য রুনেল চাকমাকে ৩ লক্ষ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। দুই বছর পার হয়েছে কিন্তু এখনও মঞ্চ সম্প্রসারণ হয়নি।

এদিকে বিগত ৫ বছর ধরে ওই প্রতিষ্ঠান থেকে কোন প্রকাশনা বের না হলেও প্রকাশনার নামে প্রতিবছর ব্যয় দেখানো হচ্ছে লক্ষাধিক টাকা। এছাড়া ২০১৬ সালে ২৫ লক্ষ টাকার সঙ্গীতের সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি কেনা হয় কিন্তু ক্রয়কৃত সরঞ্জামাদি আজও বিতরণ করা হয়নি বলে জানিয়েছেন জেলা পরিষদের সদস্য সান্তনা চাকমা। ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠানটির প্রাঙ্গণে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীসমুহের স্ব-স্ব জাতিসত্তা সমুহের পরিচয় তুলে ধরতে যেসব ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে সেগুলোতে এখনও রঙের কাজ করেনি ঠিকাদার। নীচে নাম লিখেই ফেলে রাখা হয়েছে। ফলে বাহ্যিকভাবে ভাস্কর্যগুলোতে কার পোশাকের কি ডিজাইন ও রঙ তা জানা সম্ভব হচ্ছে না। এখন নানা মহলে প্রশ্ন উঠছে এর নির্মাণ কাজের যৌক্তিকতা নিয়ে।

জানা গেছে, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদে হস্তান্তরিত ৩০টি বিভাগের সব খুঁটিনাটি দেখার সুযোগ হয়না চেয়ারম্যান বৃষকেতু চাকমার। এই সুযোগে পরিষদের কর্মচারীদের মাধ্যমে দ্রæততার সাথে অনেক ফাইলে অনুমোদন করিয়ে নেন বিভিন্ন দফতরের প্রধানেরা। ফলে দায়িত্বপ্রাপ্ত আহবায়কেরা বিষয়টি জানতেই পারেন না। রুনেল চাকমাও এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন প্রকল্প অনুমোদন করিয়ে নিয়েছেন। আর এসব কারণে চরম সমন্বয়হীনতা ও অব্যবস্থাপনায় রাঙামাটি ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট বর্তমানে বেহাল দশায় পড়েছে।

রাঙামাটি জেলা পরিষদের পক্ষে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট বিষয়ক কমিটির আহবায়ক ও জেলা পরিষদের সদস্য সান্তনা চাকমা বলেন, ‘এসব কেবল কাগজে কলমে আছে; সিংহভাগ টাকাই আত্মসাৎ করা হয়েছে। রুনেল চাকমাসহ প্রতিষ্ঠানটির কয়েকজন কর্মকর্তা কৌশলে এসব টাকা মেরে দিয়েছেন’।
এ ব্যপারে জানতে চাইলে রুনেল চাকমা বলেন- ‘এসব অভিযোগের কোন ভিত্তি নেই। নিয়ম অনুযায়ী সবকিছু করা হয়েছে। আমার অভিভাবক জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। তাঁর অনুমতি নিয়েই সবকিছু হয়। এখানে সদস্য মূখ্য নয়। তাছাড়া ঝামেলা দেখা দেয়ায় বেশ কয়েকবার দায়িত্ব ছাড়ার কথা বলেছি; কিন্তু কর্তৃপক্ষ আমাকে ছাড়ছেন না’।

পোস্ট করেন- শামীমুল আহসান, ঢাকা ব্যুরো প্রধান।