॥ আনোয়ার আল হক ॥
রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ এখন এক আনন্দময় বাস্তবতা। আজ রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের বয়স দু’বছর পূর্ণ হচ্ছে। নানামুখি বাধা, দীর্ঘ অনিশ্চয়তা, আশা নিরাশা আর শিক্ষার্থীদের সকল হতাশা কাটিয়ে ২০১৫ সালের এই দিনেই যাত্রা শুরু করে পাহাড়ের এই দীর্ঘ প্রতিক্ষার বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এই কলেজের কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। সেদিনটি রাঙামাটিবাসীর জন্য যেমন আনন্দদায়ক ছিল, তেমনি দিনটি ছিল সমানভাবে বিভিষিকাময়। একদিকে মেডিকেল কলেজের উদ্বোধন চলছিল অন্যদিকে রাঙামাটি শহরের বনরূপা থেকে জেলা পরিষদ পর্যন্ত স্থানটি ছিল হিং¯্রতা আর উন্মত্ততার বিভিষিকাময় কেন্দ্র। এদিন হিং¯্রতার বেড়াজালে একটি তাজা প্রাণ ঝরে যায়, আহত হয় অসংখ্য মানুষ। হিংসা হানাহানির রেশ ধরে পরিস্থিতি সামাল দিতে রাঙামাটি জেলার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো শহরে কারফিউ জারি করা হয়। তিনদিন রাঙামাটি শহর ছিল নিরব নিস্তব্ধ এবং মৃত্যুপুরির মতো। মানুষ মেডিকেল কলেজ পাওয়ার সাথে সাথে কারফিউ দেখারও অভিজ্ঞতা অর্জন করে। এই ইতিহাস একদিন মানুষ ভুলে যাবে। ইতোমধ্যে অনেকই ভুলেও গেছেন। কিন্তু রাঙামাটি মেডিকেল কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিষ্ঠা ও দৃঢ়তার কারণে এই কলেজ প্রতিষ্ঠায় কোনো বাধাই শেষ অবধি প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি সাবেক পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার, জেলায় সে সময়ে নবাগত ডিসি শামসুল আরেফিন, নবাগত এসপি সাঈদ তারিকুল হাসান, মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডাঃ টিপু সুলতান, সর্বপোরী সেনাবাহিনীর রিজিয়ন কমান্ডার বিগেডিয়ার জেনারেল সানাউল হক পিএসসি, জোন কমান্ডার কর্ণেল শামস, সকল গণমাধ্যম, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং সর্বপোরী সাধারণ মানুষ এবং অকালে প্রাণ দেওয়া নানিয়ারচরের সেই বাঙালি যুবক সকলেই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।
১০ জানুয়ারি মেডিকেল কলেজের ক্লাস শুরু হলেও ছাত্রছাত্রীরা ছিল বন্দীশালায়, তাদের অভিজ্ঞতা আজকের ছাত্রদের কাছে বর্ণনা করলে অনেকের বিশ্বাসও হতে চায় না। অন্যদিকে কলেজের যাত্রা শুরু হলেও এই কলেজ তার যাত্রাপথ কতদুর এগিয়ে নিতে পারবে। সে নিয়ে সবার মনেই সন্দেহ সংশয় এবং আশঙ্কা ছিল অনেকটা প্রকাশ্যেই। কিন্তু আনন্দের সংবাদ হলো মেডিকেল কলেজ বর্তমানে চলছে তার আপন গতিতে। রাঙামাটি জেনারেল হাসাপাতাল কমপ্লেক্সে এর করোনারি কেয়ার ইউনিটের ভবনটিতেই শ্রেণি কার্যক্রম চলছে আর দশটা মেডিকেল কলেজের চেয়ে সুবিধাজনক পর্যায়ে। এই বক্তব্য কলেজ শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের কাছ থেকে পাওয়া। তারা জানান, শ্রেণি কার্যক্রম নিয়ে তাদের কোনো সমস্য নেই। কারণ বিভিন্ন কারণে মাত্র শতাধিক শিক্ষার্থীর ক্লাস নেওয়ার জন্য এই কলেজে বর্তমানে প্রায় অর্ধশত শিক্ষক আছেন। এর মধ্যে অনেক শিক্ষক এতটাই অভিজ্ঞ যে, তার বা তাদের মতো যোগ্যতা এবং শিক্ষাসম্পন্ন শিক্ষক বাংলাদেশে আর দু’একজন আছেন।
শিক্ষা, চিকিৎসা ও যোগাযোগ ক্ষেত্রে দারুণভাবে পিছিয়ে থাকায় পার্বত্য তিন জেলার শিক্ষা চিকিৎসার উন্নয়নে এখানে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার দাবি দীর্ঘদিনের। একই সাথে এখানে একটি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার বিষয়টি আপামর জনসাধারণের একটি ন্যায্য ও প্রাণের দাবি। অবশেষে এই মেডিকেল কলেজের পাঠ কার্যক্রম অব্যাহত থাকায় মানুষের মাঝে স্বস্তি ফিরে এসেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যারা এই কলেজের বিরোধিতা করেছে তাদের সন্তান এবং আত্মীয়রাও এখন এই কলেজে পড়াশুনা করে যোগ্য চিকিসক হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন। সন্তানদের ভর্তির জন্য তদবির করছেন অনেক সুধীজন।
আশা করা হচ্ছে যারা এই কলেজ প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন, তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেই তাদের অবস্থান থেকে সরে এসেছেন। যদিও পাহাড়ের দুইটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলসহ কিছু সামাজিক সংগঠন শুরুতে এই কলেজ প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করেছিলেন। কিন্তু তাদের বক্তব্য বিবৃতি এবং দাবি দাওয়া থেকেও এ কথা স্পষ্ট ছিল যে, পাহাড়ে মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠায় তারা চুড়ান্ত বিরোধী নন। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী কিছু শর্তসাপেক্ষে এই কলেজ প্রতিষ্ঠা করার দাবি ছিল। আরো খোলাসা করে বলতে গেলে তারা বলেছেন, “পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন শেষ করে তার পর উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার প্রতি নজর দেওয়া হোক”। এই দাবি থাকতেই পারে, পাহাড়ে শিক্ষার বিস্তারে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণও যুক্তি সঙ্গত। তবে আঞ্চলিক সংগঠন দু’টির এই দাবির ভিতরগত অবস্থান যাই থাকুক দৃশ্যত তারা ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হতেই দেওয়া হবে না’ এমন ধরণের কোনো বক্তব্য দেওয়ার সাহস পাননি। ফলে দৃশ্যত তাদের আন্দোলন কর্মসূচিতে একান্তই তাদের সাংগঠনিক কিছু লোকজন ছাড়া আপামর জনসাধারণের অংশ গ্রহণ এবং সমর্থন তেমন একটা ছিলনা বললেই চলে। কারণ হাজারও বছরের সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে কোনো সভ্য জাতিই শিক্ষা ও উন্নয়নের বিরোধিতা করতে পারে না। সমাজের সচেতন অংশ তো নয়ই। তাই চুড়ান্ত বিচারে আবহমান ইতিহাসের সাবলীল পথ ধরেই আজ রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ এগিয়ে চলেছে। যদিও সূচনাটা হয়েছিল নানা বাধার বিন্দা পেরিয়ে। এ জন্য অবশ্য গণমাধ্যমগুলো প্রশংসার দাবিদার। গণমাধ্যমের অকুণ্ঠ সমর্থনের কারণেই মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার বিষয়টি অপেক্ষাকৃত স্বল্প সময়ের মধ্যেই আলোর মুখ দেখেছে বলে মনে করে পাহাড়ের মানুষ।
একটি বিষয় বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পাহাড়ের প্রতিটি প্রান্তের মানুষ মনে প্রাণে চেয়েছে এই মেডিকেল কলেজটির যাত্রা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শুরু হোক। কারণ একটি মেডিকেল কলেজ মানে শুধু একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, মেডিকেল কলেজ মানেই তার সাথে প্রতিষ্ঠা হবে একটি আড়াই’শ শয্যার পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল। যেখানে নানা জটিল রোগের চিকিৎসার জন্য যেমন বেশ কিছুু ইউনিট থাকবে, তেমনি থাকবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও অভিজ্ঞ চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের পদচারণা। এই চিকিৎসা কেন্দ্র ঘিরে শহর হবে আরো জমজমাট এবং প্রাণবন্ত। নানামুখি বাণিজ্যের দার উন্মুক্ত হবে, আর সুযোগ সৃষ্টি হবে নানামুখী কর্মসংস্থানের। যোগাযোগের দুর্গমত এবং অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার কারণে পাহাড়ের মানুষ দীর্ঘদিন সুচিকিৎসা বঞ্চিত ছিল। আবার যাদের পকেটে মোটামুটি খরচের যোগ্যতাটুকু আছে তারাও এখনও খুব সামান্য জটিল কোনো রোগে আক্রান্ত হলেই বাধ্য হয়ে চট্টগ্রাম যেতে হয়। মেডিকেল কলেজে চিকিৎসা সুযোগ বাড়ার পাশাপাশি কলেজ ঘিরে চিকিৎসা সার্জন, ক্লিনিক, চেম্বার ইত্যকার নানা সীমাবদ্ধতাও কেটে যাবে এই জেলা থেকে।
কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য কথা যে, কলেজটি শ্রেণি কার্যক্রম ভালোভাবে চালিয়ে গেলেও অন্যান্য সমস্যাগুলির কিছুই এখনও সমাধান হয়নি। গড়ে উঠে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো। এমনকি তা শুরুও করা যায়নি। যন্ত্রপাতির সঙ্কট তো রয়েছেই, তার সাথে রয়েছে শিক্ষার্থীদের আবাসন সঙ্কট। প্রতিষ্ঠাকালে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরা এ বছর তৃতীয় বর্ষে পদার্পণ করতে যাচ্ছে। এ বছর থেকেই তাদের হাসাপাতালে বাস্তব অভিজ্ঞতা নেওয়ার কথা। কিন্তু বিদ্যমান হাসাপাতালটির সে অবস্থা নেই। শিক্ষার্থীদের জীবন এ ক্ষেত্রে অনিশ্চিত। অন্য হাজার সমস্যা এবং মেডিকেল নিয়ে রাঙাজনগোষ্ঠীর অপ্রাপ্তির হতাশা এখানে না আনলেও- বলা যায়, অনেক সীমবদ্ধতা রয়েছে এই কষ্টে পাওয়া প্রতিষ্ঠান ঘিরে। মানুষ আশাবাদী এ সঙ্কট কেটে যাবে। তবে কারো ক্ষতি না হওয়ার আগেই যদি সঙ্কট কাটানো যায় সেটাই হবে সবদিক থেকে মঙ্গলময়।
পাহাড়ের অভিজ্ঞ মহলের মতে কলেজের সার্বিক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে গেলে এর সাফল্যের বাতাসে আঞ্চলিক সন্দেহ, অবিশ্বাস আর দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিশ্চয়ই এক সময় কেটে যাবে। আর পাহাড়ের উন্মোচিত হবে নতুন নতুন সম্ভাবনা ও সুযোগের দিগন্ত। রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক, সামাজিক, প্রশাসনিক এবং একেবারে সাধারণ শ্রেণির মানুষ আজ সেই প্রত্যাশা নিয়েই দিন অতিপাত করছে।