আনোয়ার আল হক- সম্পাদক, দৈনিক রাঙামাটি : ২ ডিসেম্বর ২০১৫, পার্বত্য শান্তি চুক্তির ১৮তম বর্ষপূর্তি। দীর্ঘ দেড় যুগ একটি বিষয়ের জন্য যথেষ্ট সময়। একজন মানুষ এই বয়সে পরিপূর্ণতা অর্জন করে। কিন্তু চুক্তির এতোবছর পরও দেশিবিদেশি গবেষক, পাহাড়ের মানুষ, রাজনৈতিক দল ও পর্যবেক্ষকেরা অন্বেষণ করছেন পাহাড়ের শান্তি কতটা স্থায়ী হয়েছে। চুক্তি নিয়ে সরকারের নানা পদক্ষেপ, চুক্তি বাস্তবায়নে বিভিন্নমুখি সংস্কার কতটা কাজে এসেছে তা নিয়ে চলছে জল্পনা কল্পনা। ১৯৯৭ সালে এদিনেই বাংলাদেশ সরকারের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির চুক্তি সম্পাদিত হয়। ‘পার্বত্য চুক্তি’ নামের এই চুক্তিটি চিহ্নিত হয় শান্তিচুক্তি নামে। চুক্তির পর দীর্ঘদিনের অবরুদ্ধ পার্বত্যাঞ্চল বিশ্ববাসীর কাছে মুক্ত হয়। শান্তির বার্তা নিয়ে এই চুক্তি বাস্তবায়ন করা হয়। প্রাথমিকভাবে শান্তিবাহিনীর সদস্যরা অস্ত্র জমা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। সরকারও তাদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে। সাময়িকভাবে পাহাড়ে স্থমিত হয় রক্তের হোলিখেলা, অস্ত্রের ঝনঝনানিও যায় অনেকটাই। কিন্তু বছর যেতে না যেতে প্রতিষ্ঠা হয় চুক্তিবিরোধী সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস্ ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট(্ইউপিডিএফ)। এরপর শুরু হয় পাহাড়ে দুই আঞ্চলিক দলের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। থেমে থেমে চলে দুই সংগঠনের হত্যা পাল্টা হত্যা। ২০০১ সালে তিন বিদেশী অপহরণের মাধ্যমে শুরু হয় পাহাড়ে অপহরণ বাণিজ্য। পরে ২০০৭ সালে জনসংহতি সমিতি থেকে বের হয়ে আরেক আঞ্চলিক সংগঠন জেএসএস(এমএন লারমা) সৃষ্টি হয়। এরপর বিভিন্ন সময় তিন পক্ষের কর্মী, সমর্থক হত্যার মাধ্যমে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চলে।
তবে আপাত দৃষ্টিতে তিন পক্ষের কর্মী, সমর্থকদের হত্যা চললেও এসময় পাহাড়ে ১৯৯৭ সালের পূর্বের চাইতে অনেকটা শান্তি স্থাপন হয়। পাহাড়ে অর্থনৈতিক ¯্রােত বৃদ্ধি পায়। বিশ্ববাসীর কাছে পার্বত্যাঞ্চলের পর্যটনও ব্যাপক সুনাম অর্জন করে। এসময়ে পাহাড়ে প্রচুর যোগাযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই ১৮ বছরে প্রচুর বিদ্যালয়, কলেজসহ সাধারণ মানুষের উন্নয়নে সরকারও প্রচুর কাজ করে গেছে। ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠান নিয়ে হয়েছে অনেক বিতর্ক- সম্পদ ও রক্তক্ষয়।
সন্তু লারমা অসহযোগের কর্মচসূচি পালনের মাধ্যমে পার করেছে একটি বছর। আর সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিগণ অনবরত বলে গেছেন পাহাড়ে সন্ত্রাস চাঁদাবাজী ও অস্ত্র উদ্ধারের কথা। সরকার বলছে চুক্তির বেশিরভাগ বাস্তবায়িত হয়েছে, জনসংহতি বলতে তেমন কিছুই হয়নি। বিদেশীরা গবেষণা করছে কোনটা কতটুকু ঠিক। এই প্রেক্ষাপটে জেএসএস পাহাড়ের একটি সংসদীয় আসন ও অন্তত ৬টি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পদ অর্জনের মধ্য দিয়ে নিজেদের শক্তির প্রমাণ দিতে ব্যস্ত।
কিন্তু চুক্তির এতো বছর পর এসেও চুক্তি বাস্তবায়ন না করার জন্য জেএসএস সরকারকে দোষারোপ করেই চলেছে। চুক্তির ধারা বাস্তবায়ন নিয়ে চলছে দুই পক্ষের তর্কযুদ্ধ। এই আঠার বছর জেএসএস চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলনে রাজপথে বেশিরভাগ সময় সক্রিয় ছিলো, পক্ষান্তরে ইউপিডিএফ সাংবিধানিক স্বীকৃতিসহ, পার্বত্যাঞ্চলে স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবিতে আন্দোলন করে গেছে। অন্যদিকে জেএসএস(সংস্কার পন্থী) পক্ষও চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলনে লিপ্ত রয়েছে।
পার্বত্য নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান বলেন, কোনো সরকারই চুক্তির মৌলিক ধারাগুলো এখনো বাস্তবায়নে আন্তরিকতার পরিচয় দেয়নি। চুক্তিতে পার্বত্যাঞ্চলকে বিশেষ অঞ্চল, উপজাতীয় বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ ও আঞ্চলিক পরিষদের সমন্বয়ে বিশেষ শাসনব্যবস্থার কথা উল্লেখ থাকলেও এখনো তা বাস্তবায়িত হয়নি। আঞ্চলিক পরিষদের হাতে ক্ষমতার কথা বলা হয়েছে চুক্তির এতো বছর পরও কতটুকু ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে? জেলা পরিষদে কয়টি বিভাগ হস্তান্তর করলো তা বড় বিষয় নয়। জেলা পরিষদ হস্তান্তরিত বিভাগসমূহকে সমন্বয়ের জন্য যে আইন সংশোধন, সংযোজনের কথা এখনো তা হয়নি। গত ২২ বছর পরিষদের কোনো নির্বাচন হচ্ছে না। তাই চুক্তির এতোবছর পরও পাহাড়ের মানুষের যতটুকু উন্নয়ন বা সুফল পাওয়ার কথা তা থেকে এখনো তারা বঞ্চিত।
ইউপিডিএফের মুখপাত্র মাইকেল চাকমা বলেন, চুক্তির ফলে অনেক পরিবর্তন হয়েছে এটা সত্য। কিন্তু পরিবর্তনটা সাধারণ মানুষের হয়নি। হয়েছে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল ও দালালদের। তিনি বলেন, চুক্তির ফলে সন্তু লারমার পরিবর্তন হয়েছে। তিনি সরকারি বেতন-ভাতা ভোগ করছেন। এছাড়া পাহাড়ে এখন শান্তিবাহিনী নাই। তাই সেটেলারদেরও আগমন উন্মুক্ত হয়েছে। এখন তারা সেনাবাহিনীর সহায়তায় পাহাড়ের নতুন নতুন জায়গা দখল নিতে পারছে।
তিন পার্বত্য জেলার সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য ফিরোজ বেগম চিনু বলেন, শান্তি চুক্তির পর পাহাড়ের অশান্ত পরিবেশ শান্ত হয়ে আসে। চুক্তির পূর্বে তিনটার পর রাঙামাটি থেকে গাড়ি আসা-যাওয়া করতো না। পথে পথে চেক চলতো। মুক্তভাবে চলাফেরা করতে পারতো না। চুক্তির পর সাধারণ মানুষ স্বাধীনভাবে যেকোনো এলাকায় যাতায়াত করতে পারছে। তবে কিছু উগ্র কুচক্রীমহল পরিস্থিতি ঘোলাটে করে ঘোলা পানির মধ্যে মাছ শিকারের চেষ্টা চালাচ্ছে।
রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী দীপংকর তালুকদার বলেন, পাহাড়ে যতদিন অবৈধ অস্ত্র থাকবে ততদিন এ অঞ্চলে চাঁদাবাজি, অপহরণ বন্ধ হবে না। কারণ সন্ত্রাসীরা অবৈধ অস্ত্র দিয়ে সবকিছু জিম্মি করে নিচ্ছে। তিনি সরকারের কাছে পার্বত্যাঞ্চলে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের অনুরোধ জানান।
পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা জানান, চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে আসার স্বপ্ন দেখেছিল পার্বত্যবাসী। আশা করেছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের মাধ্যমে বিশেষ শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে এতদাঞ্চলের মানুষের শাসনতান্ত্রিক অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা পাবে। এই শাসনতান্ত্রিক অংশীদারিত্বের মাধ্যমে এতদাঞ্চলের পাহাড়ি-বাঙালি স্থায়ী অধিবাসীরা নিজেদের উন্নয়ন নিজেরাই নির্ধারণ করার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা তৈরি হবে। কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষরের পর ১৮ বছরেও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে আজ অবধি পার্বত্যবাসীর সেই শাসনতান্ত্রিক অংশীদারিত্ব যেমনি নিশ্চিত হয়নি, তেমনি অর্জিত হয়নি পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সেই কাাক্সিক্ষত রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধান।
পোস্ট- ১ ডিসেম্বর ২০১৫