॥ স্টাফ রিপোর্টার ॥
রাঙামাটি শহরের রজনী গন্ধা মহিলা কল্যান সমিতির সদস্যরা তাদের সঞ্চিত টাকা হারানোর শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছে। খেয়ে না খেয়ে ধার করে সমিতিতে সঞ্চয়ের টাকা জমা করলেও এখন দু’একজন ধান্ধাবাজ ও বাটপার কর্মকর্তার লোভের শিকার হয়ে পুঁজি হারানোর শঙ্কায় রয়েছে তারা।
সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে প্রতারণার দায়ে ইতোমধ্যে এক নারীর সাজা হলেও তার অনুসারীরা এখনও প্রতারণার পায়তারা করছেন বলে অভিযোগ করেছে সদস্যরা। মামলা নং- ২৬/২০২১ মূলে ২০২১ সালের ১২ ডিসেম্বর সমিতির পক্ষে করা এক মামলায় ওই নারীর বিরুদ্ধে ২বছর কারাদন্ডাদেশ দেন বিজ্ঞ আদালত। পাশাপাশি আসামীর ৫ হাজার টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে আরো ৪মাসের সাজা ভোগের আদেশ দেওয়া হয়। এ মামলার রায় ঘোষণা করেন, রাঙামাটি জেলা জর্জ কোর্টের অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. সাহাবুদ্দিন।
সমিতির সদস্যরা জানায়, রজনী গন্ধা মহিলা সমিতির তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদিকা রেনু বেগম সমিতি থেকে ৪কিস্তিতে ৩লক্ষ টাকা ঋণ গ্রহণ করেন। ২শতাংশ হারে ঋণ পরিষোধের কথা থাকলেও কোন টাকা পরিষোধ না করায় বাধে বিপত্তি। পরে তা স্থানীয় শালিশি এবং বিষয়টি নিয়ে হাতাহাতি ও মারামারির এক পর্যায়ে তা গড়ায় থানা অব্দি।
তারা জানায়, রেনু বেগম প্রথমে ঘর মেরামতের জন্য ৩লক্ষ টাকা ঋণ নেয় ও পরে তা পরিশোধ করতে অস্বীকৃতি জানায়। পরে স্বাক্ষী প্রমাণের ভিত্তিতে ও পুলিশি তদন্ত প্রতিবেদন সাপেক্ষে এই মামলার রায় দেওয়া হয়। এদিকে এই ঘটনায়, আতঙ্কে ভুগছে রজনী গন্ধা মহিলা সমিতির পক্ষে করা মামলার বাদী সাবিয়া লিলি ও তার পরিবার।
এবিষয়ে সাবিয়া লিলি প্রতিবেদক কে জানায়, তবলছড়ি মসজিদেও খাদেম ও বিয়াম ল্যাবরেটরি স্কুলের নাইট গার্ড মোহাম্মদ হোসেন খোকনের স্ত্রী ও তৎকালীন রজনী গন্ধা মহিলা সমিতির তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদিকা রেনু বেগম আমাদের সমিতি থেকে ৩লক্ষ টাকা ঋণ নেয়। এছাড়া ইসপা, ব্রাক ও পদক্ষেপ সমিতি থেকেও ঋণ নেয়। এসব টাকা নিয়ে সে একটি বাড়ি তৈরী করে। এর কদিন পর থেকেই সে কারো সাথে যোগাযোগ করা বন্ধ করে দেয়। তার বাড়িতে টাকা চাইতে গেলে তার স্বামী দা বটি নিয়ে পাওনাদারদের কে ভয় ভীতি দেখাত। পরে আমরা (রজনী গন্ধা মহিলা সমিতি) সামাজিক শালীশ বৈঠকে বসি। কিন্তু সে শালীশ না মানায় এক পর্যায়ে মামলা পর্যন্ত গড়ায়। মামলার রায়ের পর তার স্বামী আমাদের হুমকি প্রদান করছে। আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। সমিতির এসব টাকা গরিব দুঃখী সংগঠনের টাকা। এসব টাকা তুলে সমিতিকে বুঝিয়ে দিতে পারলে আমি দায় মুক্ত হতাম।
তিনি আরো বলেন, জেলা যুবদলের সভাপতি ও ৪নং ওয়ার্ড কমিশনার নুর নবী ও মহিলা কমিশনার নির্মলা দেওয়ান মামলার রায়ের আগে থেকেই আমাদের হুমকি দিয়ে আসছে। বিষয়টি নিয়ে এর আগে আমরা তাদের দারস্ত হয়েছি। তারা বিষযটি সুরাহা না করে উল্টো আমাদের কে দোষারোপ করে বলে যে এসব সুদের টাকা না দিলে কিছু হয়না। আমরা এই টাকা ফেরত পাবো না।
রেনু বেগমের দেবর ওয়ার্ড কমিশনার হওয়ার পর থেকে লোন পরিষোধের কথা বললেও সেবিষয়ে কোন প্রকার ভ্রুক্ষেপ করেনি তারা। মসজিদে ও স্কুলের চাকুরী এবং জনপ্রতিনিধির প্রভাব দেখিয়ে তারা কোন সংগঠনের লোন পরিষোধ করেনি তারা। আসামীর স্বামী হোসাইন আমাদের কে তার ভাই নুর নবী ও নির্মলা দেওয়ানের ভয় দেখাচ্ছে। আমরা যেন তাদের কথা মেনে নেই বলেও যোগ করেন তিনি।
এদিকে সাবিয়া লিলি জানায়, ইসপা সমিতি থেকে রেনু বেগম ৬০হাজার টাকা ঋণ নিয়ে সময় মত পরিষোধ না করায় গ্যারান্টার হিসেবে তাকে সেই টাকা পরিষোধ করতে হচ্ছে। লোনের কিস্তি দিতে গিয়ে তিনি জানতে পারেন বহিরাগত রাহুল দাশ নামের এক যুবক কে স্বামী পরিচয়ে রেনু বেগম ওই ৬০হাজার টাকা লোন তোলেন বলেও জানান রজনী গন্ধা মহিলা সমিতির এই সভাপতি। লিলি আরো জানায়, শুধু ওই নারীই নয়, বিভিন্নভাবে প্রতারণা করেন তার স্বামী হোসাইন খোকন। মসজিদের নাম করে এই সমিতি থেকে টাকা উত্তোলন করে সমিতি কে জমা না দিয়ে খোকন নিজেই সেই টাকা ভোগ করেছেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এদিকে সাবিয়া লিলির স্বামী সেলিম খান জানান, এই পরিবার হতে সাবধান! ৪ নং ওয়ার্ড এডিসি কলোনী বাসিন্দা রাঙামাটি কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের খাদেম ও বিয়াম ল্যাবরেটরি স্কুলের নৈশপ্রহরী হোসাইন খোকনের স্ত্রী রেনু বেগম রজনীগন্ধা মহিলা কল্যাণ সমিতি হতে ০৩ লক্ষ টাকা ঋণ নিয়ে ও এলাকার অনেকের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে আত্মসাৎ করে। টাকা না দেওয়ায় কোতোয়ালি থানায় অভিযোগ করা হলে কোতোয়ালি থানার ওসি কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা শরীয়ত উল্লাহকে সালিশের মাধ্যমে বিষয়টি সমাধানের দ্বায়িত্ব দেয়। সালিশে ইমাম সাহেব, তৎকালীন ৪নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মিজানুর রহমান বাবু, হোসাইন খোকন, তাহার ছেলে মেহরাজ জয়, আলামীন মাঝি সহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন। এসময় তারা সমিতির টাকার কথা স্বীকার করে। পরে ইমাম সাহেব বাবু কমিশনারকে সমিতির বিষয়টি সমাধান করে দিতে বলেন। পরে কমিশনারের বাসায় বৈঠক হয়। বাদী-বিবাদী ও এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের কাছে সমিতির টাকার কথা স্বীকার করেন কিন্তু টাকা না দেওয়ার বাধ্য হয়ে আদালতে মামলা দায়ের করা হয়। মামলায় ২ বছর জেল এবং ৫,০০০ টাকা জরিমানা হয়। অনাদায়ে আরো ৪ মাসের জেল হয়। আসামি বেনু বেগম এক হিন্দু ছেলেকে স্বামী বানিয়ে ইসপা সমিতি থেকে ৬০,০০০ টাকা ঋণ নিয়েও আত্মসাৎ করেন। তিনি আরো অভিযোগ করে বলেন, আসামীর স্বামী হোসাইন খোকন একজন নেশাগ্রস্থ লোক। যা এলকার সবাই জানে। তার পরেও তাকে মসজিদের খাদেম হিসাবে রাখা হয়েছে বলে তিনি অপরাধের ফিরিস্তি তুলে ধরেন-জুমা বারের ব্যাগের জনগণের দানের টাকা চুরি, মসজিদের জায়নামাজ কেনার জন্য রজনীগন্ধা সমিতি থেকে দেওয়া ৫,০০০ টাকা আত্মসাৎ, সমিতি থেকে রমজানের ইফতারের জন্য দেওয়া ১০০০ টাকা, মসজিদের মোটর মেরামতের জন্য ১,২০০ টাকা আত্মসাৎ করেন। সেলিম খান আরো অভিযোগ করেন- হোসাইন খোকন বিয়াম ল্যাবরেটরি স্কুলের ইট, বালু, সিমেন্ট, কংকর চুরি করে বাসায় নিয়ে নিজের ঘরের কাজ করেছে। তাই তিনি হোসাইন খোকন কে মসজিদের খাদেমের দায়িত্ব থেকে অপসারণের দাবি জনান। সমতির সদস্যরে কষ্টে জমানো টাকা ফেরত পাওয়ার জন্যে যা যা করার দরকার তা সমিতির পক্ষ থেকে করা হয়েছে। সমিতির সদস্যদের টাকা ফেরৎ পেতে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা কামনা করেন।
এবিষয়ে জানতে চাইলে আসামীর স্বামী মোঃ হোসাইন জানায়, আমার স্ত্রী সমিতি থেকে ৩০হাজার টাকা লোন নিয়েছিলো। পরবর্তিতে সমিতি থেকে ৩লক্ষ টাকার কথা বলা হয়। সাবিয়া লিলির মিথ্যা ও হয়রানীমূলক মামলার কারণে আজ আমার স্ত্রী জেল খাটছে। সাবিয়া লিলির বাসায় আমার স্ত্রী কাজ করত। ওই সময় কত টাকা উত্তোলন করেছে এবং কোথায় কত টাকা উল্লেখ করা অবস্থায় স্বাক্ষর করেছে তা সে নিজেও জানেনা। কারণ সে পড়ালেখা জানতো না। হয়ত তারা এটার সুয়োগ ব্যবহার করেছে।
মসজিদের টাকা আত্মসাতের ব্যপারে জানতে চাইলে তিনি জানান, আমি একজন মসজিদের খাদেম। মসজিদ থেকে ৭৫০০টাকা ও রাতে বিয়াম ল্যাবরেটরি থেকে ৪হাজার বেতন পাই। এই টাকা দিয়ে দিনে ও রাতে কঠোর পরিশ্রম করে আমি দিনাতিপাত করি। আমার নামে মিথ্যা কথা রটিয়ে বেড়াচ্ছে। তারা আমার স্ত্রীর নামে আরো একটি মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চালাচ্ছে।
এবিষয়ে জানতে চাইলে ৪নং ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার মিজানুর রহমান বাবু বলেন, আমি কশিমনার থাকাকালীন বিষয়টি নিয়ে আমরা বৈঠক করেছি। আমরা একটা সিদ্ধান্ত দিয়েছিলাম। তাদের সম্মতি আমাদের কে জানাবে বলেও আর জানাইনি। পরে আদালতে একটা রায় হয়েছে বলে আমি জেনেছি।
জানতে চাওয়া হলে পৌরসভার ৪, ৫ ও ৬নং ওয়ার্ডের মহিলা কমিশনার নির্মলা দেওয়ান বলেন, আমাদের কোন হস্তক্ষেপ নেই। আমরা কোন প্রকার হুমকিও দেয়নি। বিষয়টি নিয়ে আমরা বৈঠকে বসে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা লাভাংশের টাকা মওকুফ করে ৩লক্ষ টাকা পরিষোধের কথা বলি। রজনী গন্ধা মহিলা সমিতি সেটা মানেনি। পরে মামলার নির্ধারিত তারিখে রেনু বেগম টাকা পরিষোধ করতে না পারায় ২বছর জেল ও ৫হাজার টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে আরো ৪মাসের জেল সাজার রায় দেয় আদালত।
তিনি আরো বলেন, রেনু বেগম অত্যন্ত গরিব মানুষ। আমরা জেনেছি রেনু বেগম সাবিয়া লিলির বাসায় কাজ করত। এমন মহিলা কে কোন সমিতি ৩লক্ষ টাকা লোন দেয় কিভাবে। ১০, ২০ ও ৪০হাজার টাকা করে ধাপে ধাপে লোন নেয় রেনু বেগম। লোন পরিশোধ না করার পরেও ৩লক্ষ টাকা লোন দেওয়ার তো কোন যুক্তি নেই।
বিষয়টি নিয়ে মুঠোফোনে কথা হয় ৪নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর নুর নবি‘র সাথে। তিনি বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে আমি জেনেছি। তবে হুমকির বিষয়ে আমি অবগত নই। মামলার রায় হয়েছে। আমি এবিষয়ে আর কোন কথা বলিনি বলেও জানান এই জনপ্রতিনিধি।