আমাদের জাতীয় পতাকার মর্যাদা রক্ষায় সচেতনতা জরুরি

366


॥ আনোয়ার আল হক ॥
দীর্ঘ ৯ মাসের মহান মুক্তিযুদ্ধ, ৩০ লাখ শহীদের রক্ত আর অসংখ্য মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমরা পেয়েছিলাম এই স্বাধীন ভূখন্ড; আমাদের গর্বের বাংলাদেশ।

মুক্তিযোদ্ধাদের এই দীর্ঘ ত্যাগের বিনিময়ে আমরা শুধু একটি দেশই পাইনি, পেয়েছি নিজস্ব স্বকীয়তা। অর্জন করেছি আলাদা জাতিসত্তা। বিশ্বের বুকে নিজেদের পরিচিত করিয়েছি নতুন উচ্চতায়। আর সেই আলাদা জাতিসত্তা আর নিজস্ব স্বকীয়তা বিশ্ব দরবারে উঁচু করে করে তুলে ধরার প্রতীক হিসেবে পেয়েছি আমাদের স্বাধীন দেশের জাতীয় পতাকা।

আমাদের অর্জিত জাতীয় পতাকার মর্যাদা এক অনন্য উচ্চতায় অভিষিক্ত। এর মূল্যও বাঙালির কাছে তাৎপর্যময়। এই পতাকা বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাস লিখেছে নতুন করে। স্বাধীনতার চেতনায় উদ্ভাসিত বাঙালি, জাতীয় পতাকা বুকে ধারণ করে জাতিসত্তার স্বকীয়তার প্রমাণ রেখেছে সেই ১৯৭১ সালেই। সেই পতাকা বহনের গর্বিত উত্তরাধিকার পেয়েছে আজকের নতুন প্রজন্ম। কাল থেকে কালান্তরে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে কোটি বাঙালি বুকে ধারণ করে চলবে এই লাল-সবুজ পতাকার গৌরব।

কিন্তু আমরা জেনে বা না-জেনে! প্রতিনিয়ত জাতীয় পতাকার অবমাননা করে চলেছি প্রায় সবখানে সকল আঙ্গিকে। অনেক সময় আবেগাপ্লুত দেশপ্রেম দেখাতে গিয়ে অপমান করে ফেলি নিজের অস্তিত্ব আর অর্জিত পতাকাকে। এখন বিজয়ের মাস। দেখা যায় বিজয়ের মাসে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েই অনেকে বাসা-বাড়িতে-গাড়িতে-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পতাকা উত্তোলন করে বসে আছেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা হয় কিন্তু পতাকা নামে না, সুর্য্যদয় থেকে নিকশ কালো রাত পর্যন্ত পতাকা উড়ছে তো উড়ছেই। কিন্তু সন্ধ্যার পর যে জাতীয় পতাকা না নামালে তার অবমাননা হবে তা আমরা মনেই রাখি না।

লাল-সুবজ পতাকা হৃদয়ে ধারণ করেই একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, অর্জিত হয়েছিল নিজস্ব পাতাকা। জাতির মর্যাদার প্রতীক এই ‘জাতীয় পতাকা’ নিজের ইচ্ছেমত মাপে, রঙে বানিয়ে আখাম্বা একটা খুঁটিতে উড়িয়ে দিলেন। আর রোদ-ঝড় বৃষ্টি, ধুলায় রঙ জ্বলে ফ্যাকাসে হয়ে পঁচে নষ্ট না হওয়া পর্যন্ত পতাকা সেই খুঁটিতেই রয়ে গেল, এমন নজিরও আমাদের দেশে রয়েছে।

সাধারণত পতাকার সাথে এ ধরনের আচরণের পেছনে ব্যক্তির কু-উদ্দেশ্য কাজ না করলেও, তার অজ্ঞতাবশত অবমাননাকর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। কখনও কখনও মানুষ দেশপ্রেমে উদ্বেল হয়েও পতাকার অবমাননা করে ফেলে। তবে মনে রাখতে হবে, প্রতিটি দেশের জাতীয় পতাকার ব্যবহারবিধি ও পতাকা ব্যবহারের আচরণবিধিগুলোকে সংজ্ঞায়িত করে তা অগ্রাহ্য করার শাস্তি নির্ধারণ করে দেয়া থাকে।

অনেক দেশেই জাতীয় পতাকার অবমাননা অবৈধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যদি ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ এ ধরনের কাজ করে, তবে তার জন্য শাস্তির মেয়াদ আরো বেড়ে যায়। তাই আমাদের জাতীয় পতাকার অবমাননা হোক এটা যেমন কেউ চান না। তেমনি সবার সচেতন থাকা উচিৎ কোনোভাবেই যেন আমাদের জাতীয় পতাকার মর্যাদা সামান্যতমও ক্ষুন্ন না হয়।

বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা সবুজ আয়তক্ষেত্রের মধ্যে লাল বৃত্ত। সবুজ রং বাংলাদেশের সবুজ প্রকৃতি ও তারুণ্যের প্রতীক, বৃত্তের লাল রং উদীয়মান সূর্য, স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারীদের রক্তের প্রতীক। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার এই রূপটি ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারি সরকারীভাবে গৃহীত হয়।

তবে ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় প্রায় একই রকম দেখতে একটি পতাকা ব্যবহার করা হতো, যেখানে মাঝের লাল বৃত্তের ভেতর হলুদ রঙের একটি মানচিত্র ছিল। পতাকার উভয় পাশে সঠিকভাবে মানচিত্রটি ফুটিয়ে তোলা কষ্টকর হওয়ায় পতাকা সহজ করাসহ বেশ কিছু বিষয় বিচেনায় নিয়ে ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারী বাংলাদেশের পতাকা থেকে মানচিত্রটি সরিয়ে ফেলা হয়।

প্রসঙ্গক্রমে বলে নেওয়া প্রয়োজন যে, প্রথম পতাকাটি এঁকেছিলেন তৎকালীন ছাত্রনেতা শিবনারায়ণ দাস। সে সময় পতাকা তৈরির জন্য কাপড় সংগ্রহ করা হয়েছিল ঢাকা নিউমার্কেটের অ্যাপোলো টেইলার্স থেকে। টেইলার্সের মালিক বজলুর রহমান লস্কর কাপড় দিয়েছিলেন। পতাকা তৈরির পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমান কলা ভবনের সামনের পশ্চিম ফটকে বাংলাদেশের প্রথম পতাকাটি উত্তোলিত হয়। দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ২ মার্চ। ছাত্রনেতা আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বে এবং অপর তিন ছাত্রনেতা নূরে আলম সিদ্দিকী, আবদুল কুদ্দুস মাখন এবং শাজাহান সিরাজের অংশগ্রহণে পতাকাটি উত্তোলন করা হয়।

জাতীয় পতাকার বিষয়ে আমাদের সংবিধানের দিকনির্দেশনার বাইরেও আলাদা আইন রয়েছে। ১৯৭২ সালেই পতাকা আইন করা হয়। ২০১০ সালের জুলাই মাসে আইনটি সংশোধিত হয়, যার পেছনে মূল পর্যবেক্ষণ ছিল বিশেষত নাগরিকদের অজ্ঞতার কারণে জাতীয় পতাকার অবমাননা। সংশোধনীতে সর্বোচ্চ ২ বছর পর্যন্ত শাস্তি এবং ১০ হাজার টাকা অর্থদন্ডের বিধান রাখা হয়।

আমাদের জাতীয় পতাকার যে ব্যবহারবিধি রয়েছে, তা আমাদের অনেকেরই জানা নেই। ফলে বিভিন্ন সময় আমরা ভুল করে থাকি। এ থেকে বেরিয়ে এসে সঠিক ব্যবহারবিধি অনুযায়ী পতাকা ব্যবহারের মধ্য দিয়ে এর প্রতি যথাযথ সম্মান দেখানো সকল নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব।