পার্বত্যাঞ্চলের নির্যাতিত মানুষ জিম্মীদশা থেকে মুক্তি চায় >পাহাড় থেকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের দাবিতে রাঙামাটিতে স্মরণকালের বৃহৎ মহাসমাবেশ

624

॥ স্টাফ রিপোর্ট ার॥

সন্ত্রাসী, চাাঁদাবাজ ও অস্ত্রধারীদের হাতে জিম্মীদশা থেকে মুক্তি চায় পার্বত্যবাসী। পাহাড়ের নিরীহ মানুষের জীবন জীবিকা নিরাপদ করতে তাই অনতিবিলম্বে চিরুনী অভিযানের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সকল ধরণের অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা হোক, অন্যথায় সাধারণ মানুষ আমরণ অনশনে যেতে বাধ্য হবে। রোববার রাঙামাটিতে অনুষ্ঠিত স্মরণকালের এক বৃহত্তম মহাসমাবেশ থেকে এই দাবি জানায় নেতৃবৃন্দ। ‘নির্যাতিত নীপিড়ীত পার্বত্যবাসীর’ ব্যানারে আয়োজিত মহা সমাবেশ রাঙামাটি শহরের জিমনেশিয়াম চত্তরে অনুষ্ঠিত হয়।

পাহাড় থেকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের দাবি এবং সন্ত্রাস, চাঁদাবাজী, খুন, গুম ও অপহরণের প্রতিবাদে আয়োজিত এই মহাসমাবেশে আগত অগণিত নারী পুরুষের শ্লোগানে রোববার দিনভর রাঙামাটির আকাশ বাতাস প্রকম্পিত ছিল। সকাল থেকে জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে নানা বয়সের নারী-পুরুষ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রংবেরঙের ব্যানার ফেস্টুনসহ মিছিল নিয়ে শহরের আসতে থাকে। সকাল ১১টা নাগাদ জিমনেশিয়াম চত্ত্বর কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠে। পরে সমাবেশে জায়গা না পেয়ে প্রতিবাদী মানুষ রাস্তায় অবস্থান নেয়। এসময় রাঙামাটি শহরে সকল ধরণের যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সমাবেশে আগত মানুষের ঢল দেখে দোকন-পাট বন্ধ করে ব্যসায়ীরা মিছিলের সাথে একাত্ম হয়ে যায়।

বেগম নুরজাহানের সভাপতিত্বে এতে বক্তব্য রাখেন, মহাসমাবেশ প্রস্তুতি কমিটির আহবায়ক জাহাঙ্গীর আলম মুন্না, ব্যবসায়ী মোঃ জাহাঙ্গীর কামাল, এডভোকেট পারভেজ তালুকদার, এডভোকেট আবছার আলী, মোঃ ইউনুছ, মোঃ নাদিরুজ্জামান, রূপ কুমার চাকমা, মার্গারেড পাংখোয়া, ইঞ্জিনিয়ার সাহাদাৎ ফরায়জী সাকিব, জাহাঙ্গীর আলম, উজ্জল পাল, আলমগীর হোসেন, সোহেল রিগ্যান, আব্দুল মান্নান ও মোর্শেদা বেগমসহ বিভিন্ন উপজেলা থেকে আগত ছাত্র ও যুব নেতৃবৃন্দ। এতে স্বাগত বক্তব্য দেন বিশিষ্ট শ্রমিক নেতা কাজী মোঃ জালোয়া।

সমাবেশে বক্তারা বলেন, আমরা অত্যন্ত উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার সাথে লক্ষ করছি, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ ও অস্ত্রধারীদের অত্যাচারে নিপীত পার্বত্য বাসী যখন প্রায় জিম্মী হয়ে পড়েছে, পাহাড়ে প্রতিনিয়ত হত্যা-গুমসহ অপহরণের ঘটনা ঘটেই চলেছে, তখনও এক শ্রেণীর অতি উর্বর মস্তিস্কের বুদ্ধিজীবী নির্যাাতিত মানুষের দুঃখ দুর্শশার কথা তুলে না ধরে উল্টা সন্ত্রাসীদের পক্ষ নিয়ে বক্তব্য বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছেন। মানবাধিকার কমিশনসহ মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো সন্ত্রাসীদের পক্ষে বিতর্কিত অবস্থান নিচ্ছেন। যা সভ্য সমাজে শোভনীয় নয়। বক্তারা ক্ষোভের সাথে বলেন আমরা দেখতে পাচ্ছি ছাদেকুল ও মোহিনী ত্রিপুরার মতো নির্মম হত্যাকান্ড নিয়ে এসব মানবাধিকার সংস্থা রহস্যজনকভাবে নিরব ভূমিকা থাকছেন, পক্ষান্তরে অস্ত্রবাজদের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার বিষয়ে তারা সোচ্চার ভূমিকা পালন করছেন। তারা জাতীয় নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে পার্বত্যবাসীর দুঃখ দেখার জন্য আপনার পাহাড়ে কয়েক রাত কাটিয়ে যান, আমাদের জীম্মীদশা স্বচক্ষে দেখতে পাবেন।

বক্তারা প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও গণমাধ্যম কর্মীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন,  পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বিক পরিস্থিতি, দীর্ঘ সময়ের রক্তাক্ত ইতিহাস, সবুজ পাহাড়ে বারুদের গন্ধ, শান্তি প্রচেষ্টায় সরকারের উদ্যোগ, আর্থ সামাজিক উন্নয়ন এবং পিছিয়ে পড়া এ অঞ্চলের স্বপ্ন এবং পরিকল্পনা কোনো কিছুই আপনাদের অজানা নয়। আপনারা এও জানেন প্রায় তিন দশক সময়কাল পার্বত্য চট্টগ্রামে চলা রক্তের হোলিখেলার মাঝে যখন সরকার পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল তখন থেকেই পার্বত্যবাসী আশায় বুক বেঁেধছিল অপার সম্ভাবনায় পার্বত্য চট্টগ্রাম এবার উন্নয়নের মহাসড়কে সংযুক্ত হওয়ার পাশাপাশি আপামর জনসাধারণ নির্ভয়ে, স্বস্তিতে এবং নিরাপত্তার সাথে দিনাতিপাত করবে।

কিন্তু আমরা অত্যন্ত পরিতাপের সাথে জানাচ্ছি যে, চুক্তির বিনিময়ে সরকার প্রত্যাগত শরনার্থীদের পুণর্বাসনসহ, আত্মসমর্পণ করা অস্ত্রধারীদের সকলকে এবং তাদের নেতাদের প্রভূত সুযোগ সুবিধা দেওয়ার পরও তারা তাদের সন্ত্রাসী অভ্যাস পরিত্যাগ করতে পারেননি। বরং চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সরকারের প্রতি ক্রমাগত চাপ সৃষ্টির বিনিময়ে নানা সুযোগ সুবিধা আদায় করে আদায়কৃত অর্থ অবৈধ অস্ত্র ক্রয়ের পিছনে ব্যয় করছে।

চুক্তি সম্পাদনের প্রায় দুইদশক সময় পার হয়ে গেলেও পাহাড়ে কাঙ্খীত শান্তিতো আসেইনি বরং খুন, রাহাজানি, গুম, অপহরণ, সন্ত্রাস এবং চাঁদাবাজি দিনদিন বেড়েই চলেছে। তারা ছোট টং ঘরের দোকান থেকে শুরু করে মাছ ধরার জাল, বোট চালক, অটোরিক্সা, চালক এমনকি ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল চালকদের উপর পর্যন্ত বার্ষিক চাঁদা নির্ধারণ করে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, দুধের গাভি, যেকোনো ধরণের কৃষিপণ্য, বাঁশ এমনকি কলা এবং করলা গাছের উপরও সন্ত্রাসীদের চাঁদা দিতে হচ্ছে। পাহাড়ের আয়ের অন্যতম খাত কাঠ ব্যবসা এবং উন্নয়নের মুল কেন্দ্রবিন্দু ঠিকাদারী ব্যবসার উপর সীমাহীন চাঁদার বোঝাতো বর্ণনারও অতীত। এসব চাঁদাবাজীর খপ্পরে সাধারণ বাঙালি জনগোষ্ঠীতো বটে, গ্রামীণ প্রান্তিক পাহাড়ি পরিবারগুলোও আজ দিশেহারা। তারা না পারছে পাহাড় থেকে বের হতে আর না পারছে এটা কাউকে বলতে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এসব চাঁদাবাজী সম্পর্কে গণমাধ্যমে বিচ্ছিন্ন কিছু রিপোর্ট এলেও তা ঢাকায় বসে থাকা একপেশে বুদ্ধিজীবীদের যুক্তির মুখে জাতীয় পর্যায়ে তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারছে না। অথচ পাহাড় থেকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের দাবি আজ নতুন নয়। এ নিয়ে পার্বত্যবাসী অনেক কর্মসূচি পালন করেছে। বারবার প্রতিবাদ জানিয়েছে, এবার আর প্রতিবাদ নয় আমাদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে, জনগণের নিরাপত্তা দিতে না পরলে আপনারা বলুন, আমরা প্রাণের বিনিময়ে পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করবো।

বক্তারা আরো বলেন, পাহাড়ের সকল জনগোষ্ঠী তথা পাহাড়ি-বাঙালি সকল পর্যায়ের মানুষ আজ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, পাহাড় থেকে শুধুমাত্র অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের মাধ্যমে এসব সন্ত্রাসী কর্মকান্ড অর্ধেক কমিয়ে আনা সম্ভব। সন্ত্রাসীদের হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নিতে পারলে তবেই তারা সু-পথে আসার জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ প্রশাসন এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দ্বারস্থ হতে বাধ্য হবে। এর রেশ ধরে চাঁদাবাজী ও সন্ত্রাস ধীরে ধীরে কমে যাবে এবং পাহাড়ের মানুষ স্বস্তিতে ঘুমাতে পারবে। তাই গণমাধ্যমের কাছে আমাদের নিবেদন এসব চাঁদাবাজী খন্ডিত চিত্র নয়, বরং অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের মাধ্যমে এই রিপোর্ট ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করুন।  এরপরও যদি সরকার ও নীতি নির্ধারক মহলের টনক না নড়ে আমাদের ব্যবস্থা আমরাই করবো।

সমাবেশের আগে একটি বিশাল বিক্ষোভ মিছিল রাঙামাটি পৌরসভা চত্তর থেকে শুরুহয়ে দীর্ঘ পথ অতিক্রমের পর জিমনেশিয়াম চত্ত্বরে গিয়ে সমাবেশে মিলিত হয়। সমাবেশ শেষ হওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন উপজেলা থেকে খন্ডখন্ড মিছিল সহকারে এসে মানুষ সমাবেশে যোগদান করে।